খুলনা, বাংলাদেশ | ৩০ কার্তিক, ১৪৩১ | ১৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  রাজধানীর হাজারীবাগে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে আহত কিশোরের মৃত্যু
  আগুন নিয়ন্ত্রণে, খুলনায় পাট গোডাউনসহ ১০ দোকানের কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই
শেষ স্প্যানটি বসল পদ্মা সেতুতে

চ্যালেঞ্জ জয় বাংলাদেশের

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বপ্নের পদ্মা সেতু ঘিরে দেশের মানুষের প্রত্যাশা এখন নতুন উচ্চতায়। সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের উপর ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে শেষ স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে স্বপ্ন স্পর্শ করল বাংলাদেশ। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তকে এক সুতোয় গেঁথে দৃষ্টি সীমায় ভেসে উঠল ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো। চ্যালেঞ্জ জয়ের অদম্য স্পৃহাই হাতের মুঠোয় এনে দিল সাফল্য, লেখা হল নতুন ইতিহাস।

তবে এজন্য বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। বিশ্ব দেখছে নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম বাংলাদেশ। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্তের ফসল এ সেতু। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ফলে দেশীয় অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি আমাদের সক্ষমতার প্রতীক।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান স্থাপন করা হয়। এরপর তিন বছরে বসেছে আরও ৪০টি স্প্যান। তবে স্প্যান বসলেই যে সেতুর সব কাজ শেষ- তা নয়। এরপরও অনেক কাজ থাকবে। দুই হাজার ৯৫৯টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসাতে হবে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বসেছে এক হাজার ২৩৯টি। দুই হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসবে সেতুতে। বসানো হয়েছে ১ হাজার ৮৬০টি। এরপর ওপর তলায় সড়কের কাজ করতে হবে। বিদ্যুৎ ও বিভিন্ন পরিষেবার লাইন বসবে।

জানা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনার মধ্যেও ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর বাস্তব কাজ শেষ হয়েছে ৯১ শতাংশ। সার্বিকভাবে প্রকল্পের অগ্রগতি ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাকি অংশ নির্মাণ কাজ ২০২১ সালের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা রয়েছে। সরকারের লক্ষ্য স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অর্থাৎ আগামী বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সেতু চালু করা। তবে মূল সেতুর ঠিকাদার চায়না মেজর ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ২০২২ সালের এপ্রিল পযন্ত সময় চেয়েছে। প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, তারা ঠিকাদারের প্রস্তাব পেয়েছেন। এখনও তা গ্রহণ বা বর্জন করা হয়নি। সেতু কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখবে কেন বাড়তি সময় দরকার। ঠিকাদারের প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যৌক্তিক হলে সেটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। সরকারের অনুমতি পেলে সময় বাড়ানো হবে।

ভিডিও দেখুন :

কবে নাগাদ সেতু চালু হবে সে বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, তারা আশা করছেন বছরখানেকের মধ্যে কাজ শেষ হবে। তবে অনেক কিছুই নির্ভর করছে পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর। নির্মাণ শেষে পদ্মা সেতু জিডিপিতে ১ দশমিক ২৬ শতাংশ অবদান রাখবে বলে আশা করছেন সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। তিনি বলেন, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের সক্ষমতাও প্রমাণ হবে।

পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, সেতুর বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পিলার ও স্প্যান বসানোর কাজ। এ দুটি কাজের সিংহভাগই নদীর ভেতরে করতে হয়। স্রোত, কুয়াশা, বন্যা এ কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে আসছে। শেষ স্প্যানটি বসানোর পর বাকি কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে যেসব স্প্যান বসেছে সেগুলোর উপরের কাঠামো বসানোর কাজ চলছে। দোতলা আকৃতির পদ্মা সেতুতে একই সঙ্গে ট্রেন ও গাড়ি চলাচলের লক্ষ্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে। সেতুর নিচের অংশে রেলওয়ে স্ল্যাব ও উপরের অংশে রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ জোরগতিতে এগিয়ে চলছে।

তবে পদ্মা সেতুর তুলনায় নদীশাসনের কাজ কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। সাম্প্রতিক নদী ভাঙনে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবুও ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত নদীশাসনের কাজ এগিয়েছে ৭৫ দশমিক ৫০ শতাশ। মাওয়া ও জাজিরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ আগেই শেষ হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূল পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এটি নির্মাণ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। নভেম্বর পযন্ত সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৭২৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি ৮৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। যদিও সেতু নির্মাণে বাস্তব অগ্রগতি ৯১ শতাংশ। অপরদিকে নদীশাসনের কাজ করছে চীনের সাইনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড। নদীশাসন কাজে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকার মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৫ হাজার ৬৭৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। মূল সেতু, নদীশাসন, সড়ক নির্মাণসহ সব মিলিয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ব্যয় ধরা আছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ১১৫ কোটি ২ লাখ টাকা।

আসলে পদ্মা সেতু এক স্বপ্নের নাম। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম এই সেতু নির্মাণের উদ্যোগকে বাস্তবের পথে নিয়ে যান। ওই বছরের ৪ জুলাই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কিন্তু সেতুর স্থান নির্ধারণে জোট সরকারের সময় ও পরে কেটে যায় সাত সাতটি বছর। এরপর ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাওয়া-জাজিরায় সেতুর নির্মাণস্থান চূড়ান্ত করে।

২০০৯ সালে আবার শুরু হয় পদ্মা সেতু প্রকল্প। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৯ হাজার কোটি টাকায় ২০১২ সালের মধ্যে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যায়। এরপর ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়ে সেতু নির্মাণ। সময় গড়ানোর সঙ্গে বাড়তে থাকে ব্যয়ও। সব অনিশ্চয়তা কাটে ২০১৩ সালে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন।

(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

শুরুতে ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন হলেও পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। ২০১১ সালে প্রথম প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এরপর আবারও বাড়িয়ে প্রকল্পের বর্তমান ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

অপরদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার সময়ও বারবার পিছিয়েছে। নকশা প্রণয়নের পর ২০১৩ সালে সেতু চালুর কথা ছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের জটিলতায় ওই সময়ে কাজই শুরু করা যায়নি। ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে চায়না রেলওয়ে ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। ৪৮ মাসে এ সেতু নির্মাণে চুক্তি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিন দফায় ৩১ মাস পিছিয়ে ২০২১ সালের ৩০ জুন নির্ধারিত রয়েছে।

এদিকে সেতু নির্মাণ শুরুর পর থেকেই বদলে যেতে শুরু করে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান, শ্রীনগর, লৌহজং, মাদারীপুরের শিবচর থেকে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত এলাকা। রাজধানীর যাত্রবাড়ী থেকে পোস্তাগোলা সেতু হয়ে ভাঙা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। পোস্তগোলা থেকে পদ্মা সেতুর দূরত্ব এখন মাত্র আধাঘণ্টা। এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে নতুন নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে শিল্পকারখানাও। এক্সপ্রেসওয়ের সমান্তরালে চলছে পদ্মা রেল সংযোগের কাজ। গোটা এলাকাই বদলে দিয়েছে পদ্মা সেতু। জমির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। এখন মাওয়া থেকে লোকজন ঢাকায় রোজ চাকরিতে যায়।

অন্যদিকে সেতুর কাজ শেষের পথে থাকলেও ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ৪০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেল সংযোগ প্রকল্প এখনও পিছিয়ে। সেতু উদ্বোধনের দিনেই ট্রেন চলবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৩১ শতাংশ। তবে রেলমন্ত্রী বলেছেন, সেতু উদ্বোধনের সময় অন্তত মাওয়া থেকে ভাঙা পর্যন্ত ট্রেন চলবে। বাকি কাজ পরে শেষ হবে।

খুলনা গেজেট /এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!