খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  অ্যান্টিগা টেস্ট: তৃতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ ২৬৯/৯, পিছিয়ে ১৮১ রানে

চুয়াডাঙ্গায় শিলাবৃষ্টিতে ফসল ক্ষয়ক্ষতি ১০০ কোটি উপরে

গেজেট ডেস্ক

চুয়াডাঙ্গায় স্মরণকালের ভয়াবহ শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ বসতবাড়ি ও দোকানের টিনের চাল ফুটো হতে দেখা গেছে। উঠতি ফসলের এমন ক্ষয়-ক্ষতিতে দিশেহারা কৃষক। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ফসলের সঙ্গে আবহাওয়ার এমন বৈরী আচরণে লোকসানের মুখে জেলার চাষিরা।

একদিকে লোকসান, অন্যদিকে ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা— সব মিলিয়ে ফাল্গুনের এ সময়টা মোটেও ভালো কাটছে না কৃষকদের। এ ক্ষতি কীভাবে পোষাবেন, সেই চিন্তায় ঘুম নেই তাদের।

 

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, ঋণ নিয়ে বিঘার পর বিঘা জমিতে তারা ভুট্টা, গম, তামাক, মসুর, কুল, তরমুজ, পানসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদ করেছিলেন। কিন্তু শিলাবৃষ্টি আর ঝড়ে খেতের সব ভুট্টাগাছ ভেঙে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জমিতে নতুন করে ভুট্টা চাষের কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া আমের মুকুলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

অন্যদিকে জমি চাষ, ফসল কাটা, পরিবহন, মাড়াই, ঝাড়াই ও সেচের জন্য ডিজেলচালিত কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে খরচ বাড়ার ফলে ফসল উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এনজিওর ঋণ এবং লোকজনের ধার পরিশোধ করাই এখন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ তাদের ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

চুয়াডাঙ্গায় আবহাওয়া ও কৃষি অধিদপ্তর বলছে, চুয়াডাঙ্গাবাসী এর আগে এমন শিলাবৃষ্টি দেখেনি। কৃষকদের ফসলের এমন ক্ষয়ক্ষতি আগে কখনো হয়নি।

চুয়াডাঙ্গায় কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ছয় ইউনিয়ন, দামুড়হুদা উপজেলার আংশিক দুটি ইউনিয়ন এবং আলমডাঙ্গা উপজেলায় হাজার হাজার কৃষকের প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার ৪৯৩ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ১০৮ কোটি টাকার বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইউনিয়নগুলো হলো সদর উপজেলার আলুকদিয়া, মোমিনপুর, শংকরচন্দ্র, কুতুবপুর, গড়াইটুপি ও পদ্মবিলা। দামুড়হুদা উপজেলার নতিপোতা ও জুড়ানপুর ইউনিয়নের আংশিক ও আলমডাঙ্গা উপজেলার কিছু স্থান।

জেলায় ভুট্টার আবাদ হয়েছে ৪৪ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে। আর শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ১৩ হাজার ২৫৩ হেক্টর জমির ফসল। গম ৯৯৫ হেক্টরের মধ্যে ক্ষতি হয়েছে ৫৫ হেক্টর, বোরো ধান ৩৬ হাজার ৮৭৯ হেক্টরের মধ্যে ১ হাজার ৪৭০, কলা ১ হাজার ৫২৬ হেক্টরের মধ্যে ১৫৩, পেঁপে ৫২০ হেক্টরের মধ্যে ৯৫, পেঁয়াজ ১ হাজার ৬১৫ হেক্টরের মধ্যে ৩৫, মসুর ৯১৭ হেক্টরের মধ্যে ২৩৪ ও রসুন ২৬৬ হেক্টরের মধ্যে ২০ হেক্টর জমির ফসলে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়।

তা ছাড়া পানবরজ ১ হাজার ৬২২ হেক্টরের মধ্যে ২৭৫ হেক্টর, তরমুজ ১১০ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৫, আম ২ হাজার ৪২৯ হেক্টর জমির মধ্যে ৪৩০, পেয়ারা ১ হাজার ৭৪১ হেক্টর জমির মধ্যে ১৮৫, লিচু ২৫৫ হেক্টর জমির মধ্যে ২০, তামাক ৩২৭ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৩, ধনেপাতা ১৯০ হেক্টর জমির মধ্যে ৪০ ও শাকসবজি ৮ হাজার ৩৪২ হেক্টর জমির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮০ হেক্টর জমি। এ ছাড়া কুল বা বরই, টমেটোসহ সব ধরনের সবজির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। সব থেকে ধান ক্ষতিগ্রস্ত কম হয়েছে।

 

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সাতগাড়ি গ্রামের নতুন উদ্যোক্তা শিমুল হাসান পলক বলেন, চাকরি ছেড়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ১০ বিঘা জমিতে কুল, মাল্টা, ড্রাগন ও পেয়ারা চাষ করেছিলাম। এই ঝড়- শিলা বৃষ্টিতে ১০০ মনের বেশি কুল পড়ে গেছে। গাছে যে কুলগুলো আছে, সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ২০০ মণ পেয়ারা শিল পড়ে নষ্ট হয়েছে।

পাশাপাশি ড্রাগন ও মাল্টা গাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতিগ্রস্ত কখনো পুষবে না। নষ্ট হওয়া ফসল কেউ নিতেও চাচ্ছে না। এখন কোথায় থেকে এই ঋণের টাকা শোধ করব? সরকারের অনুদান পেলে হইতো আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

কুলচারা গ্রামের কৃষক হুমায়ুন কবির বলেন, ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে আমার পাঁচ বিঘা জমির ভুট্টা সব শেষ হয়ে গেছে। একটি গাছ ও ভালো নেই। সেগুলো রান্নার কাজে ব্যবহৃত ছাড়া কোনো উপাই নেই। এ ছাড়া বরজের পানও সব নষ্ট হয়ে গেছে। ধারকর্জ করে ফসল ফলিয়েছিলাম। এখন পথে বসা ছাড়া উপায় দেখছি না।

পৌর এলাকার তালতলা ও হাজরাহাটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এই গ্রামে বেশিরভাগ পান চাষি। এই দুটি গ্রামে ৬০০ থেকে ৭০০ পান বরজই আছে। ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে সব পান বরজ নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় কৃষকরা হতাশায় পড়ে গেছেন। কারোর বাড়ির টিন ছিদ্র হয়েছে। কোনো রকম পলিথিন দিয়ে রেখেছেন তারা। একদিকে ফসলের ক্ষতি, অন্যদিকে বাড়ির টিন ফুটো।

তালতলা গ্রামের জামাল হোসেন বলেন, আমি খুবই দরিদ্র। আমার কোনো ছেলে নেই। দুটি মেয়ে আছে৷ লোকের কাছে ধারদেনা করে পান বরজটা দাঁড় করেছিলাম। ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে সব শেষ হয়ে গেছে৷ আবার ঘরের টিন অনেকস্থানে ফুটো হয়ে গেছে৷ এখন কিভাবে ধারদিনে শোধ করবো? সরকারের অনুদান পেলে আমরা চলতে পারব। এ ছাড়া এখন চলার কোনো উপায় নেই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসার তালহা জুবায়ের মাসরুর বলেন, ‘শিলাবৃষ্টির পর আমি ফসলের মাঠ পরিদর্শন করছি। সদর উপজেলায় ছয় ইউনিয়নের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সব থেকে ভুট্টা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া তরমুজ, কুল, আমের মুকুলে ক্ষতি হয়েছে। তবে ধানের ক্ষতি তুলনামূলক কম। এমন ক্ষয়ক্ষতি আগে কখনো দেখেনি আমরা। আমরা অনুমান করছি সদরের ছয় ইউনিয়নে ১০০ কোটি টাকার বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, এই উপজেলায় জুড়ানপুর ও নতিপোতা ইউনিয়নের আংশিক কিছু ফসলের ক্ষতি হয়েছে। যা ৮ কোটি ২০ লাখ ২৭ হাজার ৫০ টাকার। সব থেকে ভুট্টা ও তামাক নষ্ট হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. আব্দুল মাজেদ বলেন, মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে ফসলের এমন ক্ষতি আগে কখনো দেখেনি চুয়াডাঙ্গাবাসী। দেশের মধ্যে ভুট্টা চাষের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে চুয়াডাঙ্গায়। তাই এখানে যে পরিমাণ ভুট্টার ক্ষতি হয়েছে, তা কখনো পোষাবার নয়। এ ছাড়া অনেক স্থানে বসতবাড়ির টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে।

 

খুলনা গেজেট/এএ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!