দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আলোচিত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন চাকরিচ্যুত হওয়ার পর নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, ‘ওরা তো আমাকে মেরে ফেলবে।’ তবে তারা কারা, সে বিষয়টি খোলাসা করেননি শরীফ উদ্দিন।
এ কর্মকর্তা বলেন, ‘দুদকে আমি পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছি। আমি কোনো অন্যায় করিনি, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিইনি। অথচ আমি চাকরিচ্যুত হলাম।’কিছুদিন আগে একটি পক্ষ তাকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়েছিল বলেও জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার(১৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন শরীফ উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘গত ৩০ জানুয়ারি আমাকে ফোন করে বলা হয়, এক সপ্তাহের মধ্যেই আমার চাকরি খাওয়া হবে। সেই হুমকির দুই সপ্তাহ পর বুধবার আমাকে চাকরিচ্যুত করা হল।’
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা হয়েছে। অনেকগুলো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বলছে, আমি চাকরিবিধির বিরুদ্ধে গিয়ে এমন কিছু করেছি, যাতে দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। কিন্তু কীভাবে আমি তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করলাম, তা আমি জানি না। তারা বলছে, আমি নাকি ১০০ কোটি টাকার মালিক!’
শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ৩০টিরও বেশি জিডি দায়ের করা হয়েছে, যেগুলোর তদন্ত চলছে। শরীফ দাবি করেন, ‘এই জিডিগুলো ভুয়া।’
বুধবার দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতির খবর আসে।
আদেশে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮ এর বিধি ৫৪ (২) তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মো. শরীফ উদ্দীন, উপ-সহকারী পরিচালক, দুদক, সমন্বিত জেলা কার্যক্রম, পটুয়াখালীকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। তিনি বিধি মোতাবেক ৯০ দিনের বেতন এবং প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন।’ এই আদেশ ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর।
চট্টগ্রাম দুদক কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনের সময় শরীফ উদ্দিন ২০২১ সালের ১৬ জুন হালনাগাদ ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালকসহ ইসির চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন।
১০ জুন দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ প্রদান করায় সাবেক প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলামের (বিএসসি) বড় ছেলে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচনায় আসেন শরীফ উদ্দিন।
এছাড়াও ২০২১ সালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে সংলগ্ন কলাতলী বাইপাস রোড এলাকায় পিবিআই অফিস তৈরির জন্য এক একর জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসে শরীফ উদ্দিনের তদন্তে। এ ঘটনাসহ কক্সবাজারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জমি অধিগ্রহণের দুর্নীতিতে জড়িত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে চট্টগ্রামে নামে দুদক। পরে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার ও বেশ কয়েকটি মামলাও করেছিলেন শরীফ উদ্দিন।
গত বছরের ১৬ জুন দুদক পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে মো. শরীফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়। শরীফের রহস্যময় এমন বদলি জন্ম দেয় নানা প্রশ্নের। আলোচিত দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফের এ বদলিকে স্বাভাবিক চোখে দেখেননি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলকারী সংগঠকসহ বিশিষ্টজনরা। তার আকষ্মিক বদলি নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করার প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করেছেন তার সহকর্মীরা। তাকে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানান মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা। একইসঙ্গে প্রশাসনিক নানা হয়রানি বন্ধের দাবি জানানো হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার পর দুদকের সামনে এ মানববন্ধন হয়।
বক্তারা অভিযোগ করেন, স্বাধীন সংস্থা হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তারা নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যার বলি হয়েছেন উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দীন। তারা দাবি করেন, চট্টগ্রামে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ৫২টি মামলা করায় তাকে বদলি করা হয়েছিল পটুয়াখালীতে।
যদিও দুদক বলছে, কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে এবং অব্যাহতভাবে দুদক আইন ও বিধি পরিপন্থি কাজ করার অপরাধে শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণের কোনো বিকল্প ছিল না।
অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) মনে করছে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন দক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তার সুরক্ষা নিশ্চিতের পরিবর্তে কেন এভাবে অপসারণের পথ বেছে নিতে হলো, সেই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলে দুদকের বিশ্বাসযোগ্যতা গভীর সংকটের মুখে পড়বে।