২৪ ঘণ্টার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে জোড়া খুন মামলার মূল রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ ব্যুরো ইনভেটিগেশন (পিবিআই)। পুলিশের এই তদন্ত সংস্থাটি বলছে, টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেওয়ার কারণেই কাকুলি ও তার ছেলে তালহাকে গলা কেটে হত্যা করেছেন প্রতিবেশী যুবক সাদিকুর ওরফে সাদি।
সোমবার দুপুরে পিবিআইয়ের সদরদপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মুজমদার।
সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার মুজমদার বলেন, সুপারি গাছে লেগে থাকা মাটি দেখে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ব্রাহ্মনদী ইউনিয়নের উজান গোবিন্দি এলাকার লোমহর্ষক রাজিয়া সুলতানা ওরফে কাকুলি এবং তাঁর শিশু ছেলে তালহা হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচন করেছে নারায়ণগঞ্জ পিবিআই।
পিবিআই জানায়, চলতি বছরের ৩ জুলাই ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে নিহত কাকুলির বাবাকে তার স্বামীর বাড়ি থেকে ফোন করে জানানো হয়, তার মেয়ে কাকুলি ও তার ছেলে সন্তানকে কে বা কারা হত্যা করেছে। এই খবর পেয়ে কাকুলির বাবা তাঁর মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন যে, ২ জুলাই রাত আটটার দিকে কাকুলি ও তাঁর ছেলে প্রতিদিনের মতো রাতের খাবার শেষ করে তাদের নিজেদের ঘরে শুয়ে পড়ে। পরদিন ভোর পৌনে চারটার দিকে পাশের ঘরে কাকুলির চাচাতো ভাইয়ের বউ জান্নাত ঘুম থেকে ওঠে ফজরের নামাজের অযু করার জন্য বাহির যায়। তখন কাকুলির বসত ঘরের কলাপসিবল গেইট খোলা দেখতে পায়। জান্নাত তখন ঘরের ভেতরে ঢুকে কাকুলি ও তার ছেলের গলাকাটা লাশ দেখতে পেয়ে চিৎকার করেন। তার চিৎকারে বাড়ির অন্যান্য লোকজন এসে দেখতে পায় রাজিয়া সুলতানা কাকুলির লাশ ঘরের দক্ষিণ পাশের রুমের মেঝেতে গলাকাটা অবস্থায় পড়েছিল। তার ছেলে তালহার লাশও ঘরের উত্তর পাশের কক্ষে খাটের ওপর গলাকাটা অবস্থায় পড়েছিল। হত্যায় ব্যবহৃত বটি ছেলের লাশের পাশেই বিছানার ওপর রক্তমাখা অবস্থায় পাওয়া যায়।
২ জুলাই রাত আটটা থেকে ৩ জুলাই পৌনে পাঁচটার মধ্যে যে কোনো সময় এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।
এ ঘটনায় নিহত কাকুলির বাবা বাদী হয়ে ৫ জুলাই আড়াইহাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। আড়াইহাজার থানার মামলা নম্বর-০৬। ধারা-৩০২/৩৪ পেনাল কোড ।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইপ্রধান বনজ কুমার বলেন, লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডে ঘটনাটি সারাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলে আড়াইহাজার থানা পুলিশ, সিআইডি, র্যাবের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের পিবিআইও ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে ছায়াতদন্ত শুরু করে। নারায়ণগঞ্জের পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলামের সার্বিক সহযোগিতায় মামলাটি গত ৯ জুলাই স্ব-উদ্যোগে গ্রহণ করে পিবিআই। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) শাকিল হোসেন এবং প্রত্যক্ষভাবে সহযোগী (এসআই) মো. মাজহারুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করেন।
পিবিআই জানায়, হত্যাকাণ্ডে পর পিবিআই মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায়। পরিদর্শনের এক পর্যায়ে তদন্তকারী টিম নিহত কাকুলির বসতঘরের পেছনে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো সুপারি গাছের গোড়া থেকে আনুমানিক দুই ফিট ওপরে এক জায়গায় সদ্য মাটি লাগানো দেখতে পায়। তখন তদন্তকারী টিম সুপারি গাছের ওপরে দিকে তাকিয়ে দেখে গাছে কোনো সুপারি নেই। এই বিষয়টি তদন্তদলের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। পিবিআইয়ের চৌকস টিম সঙ্গে সঙ্গে লোকাল সোর্সের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারে ওই বাড়ির পেছনে ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগ থাকায় নিহত রাজিয়া সুলতান ওরফে কাকুলির ভাসুরের ছেলে অজিদ কাজীসহ আরও দুয়েকজন ছেলে ওই বাড়ির পেছনে বসে ফ্রি ওয়াইফাই দিয়ে মোবাইলে নেট ব্রাউজ করে থাকে।
এই তথ্য পেয়ে অজিদ কাজীসহ অন্যান্যদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে কাকুলির ভাসুরের ছেলে অজিদ কাজী জানায়, সে ২ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাকুলির বাড়ির পেছনে দেয়াল ঘেসে বসে ওয়াইফাই সংযোগের সাহায্যে মোবাইলে গেমস খেলার সময় হঠাৎ তালহার একটি চিৎকারের শব্দ শুনতে পায়। তারপর সে কাকুলির বাথরুমে কারো হাত ধোয়ার শব্দ শুনতে পায়। তখন সে সঙ্গে সঙ্গে কাকুলির বিল্ডিংয়ের পেছনে দেয়ালে লাগানো সুপারি গাছ বেয়ে বাথরুমের ভেনটিলেটর দিয়ে উকিঁ দিয়ে একই এলাকার পার্শ্বরবতী বাড়ির সাদিকুর ওরফে সাদিকে কাকুলির রুমের অ্যাটাস্ট বাথরুমের পানির কলে হাত ধুতে দেখে। তখন অজিদ সাদিকুরকে দ্রুত ওই ঘর থেকে বের হতে দেখে। সাদিকুর বের হয়ে যাওয়ার সময় ঘরের পেছনে অজিদ কাজীকে বসে থাকতে দেখে। অজিদ কাজী ভাবে তার কাকির সঙ্গে সাদিকুরের অবৈধ সম্পর্ক আছে। পরবর্তীতে সকাল বেলা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আসামি সাদিকুর সাক্ষী অজিদ কাজীর সঙ্গে দেখা করে বলে ‘আমার কথা কাউকে বললে তোরে জানে মেরে ফেলব।’ এই ভয়ে অজিদ কাজী ঘটনা চেপে যায়।
সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার মুজমদার বলেন, এই তথ্য পাওয়া পরেই পিবিআইয়ের তদন্তকারী টিম সন্দিগ্ধ সাদিকুর ওরফে সাদিকে তাঁর নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্যাপক এবং নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদে আসামি সাদিকুর ওরফে সাদি পিবিআই এর তদন্তকারী টিমের কাছে এই জোড়া খুন মামলায় নিজের সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে বিস্তারিত বর্ণনা দেন।
গ্রেপ্তারকৃত সাদিকুর ওরফে সাদির বরাত দিয়ে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মুজমদার বলেন, গ্রেপ্তার সাদি এলাকায় সাকিব নিটওয়্যারে ফিটার ম্যান পদে চাকরি করে। তিনি বেশ কিছু টাকা ধার করে আইপিএল ক্রিকেটে জুয়া খেলে নষ্ট করেন।
সাদি জানান, পাওনাদারদের চাপে তাঁর মাথা নষ্ট হয়ে যায়। তখন তিনি পাগলের মতো আরও টাকা খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি জানতে পারেন তাঁর পাশের বাড়ির কাকুলী ভাবির কাছে বেশ টাকা পয়সা আছে। এছাড়াও তাঁর ঘরে অনেক সোনাদানা আছে। তিনি জানতেন কাকুলি ভাবির একটা শিশু সন্তান ছাড়া ওই ঘরে আর কেউ থাকে না। কাকুলির স্বামী অনুমান দুই বছর আগেই মারা গেছেন। তখন সাদিকুর ওরফে সাদি মনে মনে কাকুলি ভাবির কাছ থেকে টাকা ধার করার চিন্তা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত আইজিপি বলেন, ঘটনার দিন ২ জুলাই শনিবার সন্ধ্যার সময় অফিস থেকে বাড়িতে আসে। তখন কাকুলি ভাবির বাড়ির আশপাশ দিয়া হাঁটাহাঁটি করতে থাকেন। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে যখন আশপাশের সবাই ঘুমিয়ে যায় তখন তিনি কাকুলি ভাবির বাড়ির গেইটে গিয়ে কাকুলি ভাবিকে তিন থেকে চারবার ভাবি ভাবি বলে ডেকে গেট খুলতে বলেন। কিছু সময় পর কাকুলি ভাবি দরজা খুলে কলাপসিবল কেচি গেট খুললে তিনি ভাবিকে জানান তাঁর মা তাঁকে কাকুলির ইলেকট্রিক ব্লেন্ডার ধার নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে। তখন সাদি কাকুলির ঘরের ভেতরে ঢোকেন। সাদি রুমে ঢুকে দেখেন তাঁর ছেলে তালহা ভাত খেয়ে ঘুমের ভাবে আছে। সাদি তখন কাকুলিকে পাশের রুমে আসার জন্য বলেন। কাকুলি পাশের রুমে আসার পর সাদি তখন কাকুলির হাতে পায় ধরে ১০ হাজার টাকা চান। কাকুলি বলে তাঁর কাছে কোনো টাকা নাই। সাদি তখন অনেক জোরাজুরি করার পর কাকুলি তাঁকে তাঁর আলমারি খুলে বলে “দেখ আলমারিতে শুধু ১০০ টাকা আছে। আর কোনো টাকা নেই।” আলমারিটা খুললে সাদি আলমারির ভেতরে একটি বাক্সে কিছু সোনার জিনিসপত্র দেখতে পান। তখন সোনা নেওয়ার জন্য তাঁর লোভ লেগে যায়। কাকুলি তখন আলমারির চাবিটা আলমারির ওপরে রাখলে সাদি দেখে ফেলেন। তখন সাদি কাকুলিকে চেয়ারে বসিয়ে বিছানার ওপর থেকে তাঁর ব্যবহৃত ওড়না দিয়া গলায় ফাসঁ দেয়। কাকুলি তখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেলে বিছানার পাশেই রাখা ইস্ত্রি দিয়ে কাকুলির মাথায় সজোরে আঘাত করলে তিনি পুরাপুরি অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন সাদিকুর দ্রুত কাকুলির রান্না ঘর থেকে সবজি কাটার বটি আনেন। পরে কাকুলির গলা কেটে ফেলেন। তারপর তিনি দ্রুত আলমারি খুলে দুইটি স্বর্ণের আংটি, দুইটি স্বর্ণের চেইন, এক জোড়া কানের দুল স্বর্ণালংকার নেয়। সাদি তখন ঘরের ওয়ারড্রবসহ সব জায়গায় খুজেঁ নেওয়ার মতো আর কিছু পায়নি। তারপর তিনি পাশের রুমের খাটের ওপর ঘুমন্ত তালহাকে ওই বটি দিয়ে গলায় কেটে মুত্যু নিশ্চিত করেন। তখন তালহা একটি চিৎকার দিয়েছিল। তারপর সাদিকুর খুব দ্রুত ভয়ে সোনা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এরপর কাকুলির ঘরের পেছনে সাক্ষী অজিদকে ফোন চাপতে দেখেন। সাদি তখন অজিদের সঙ্গে কোনো কথা না দ্রুত বাড়ি চলে যায়।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মুজমদার বলেন, গ্রেপ্তারকৃত সাদিকুর ওরফে সাদিকে পুলিশ হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর দেয়া তথ্যমতে নিহত কাকুলির বসতঘর থেকে খোয়া যাওয়া স্বর্ণালংকার উপস্থিত স্বাক্ষীদের সম্মুখে তাঁর শোবার ঘরের বিছানার তোশকের নিচ থেকে জব্দ করা হয়। পরবর্তীতে সাদির দেওয়া তথ্যমতে একটি স্বর্ণের আংটি এবং একটি স্বর্ণেও চেইন আড়াইহাজার থানার ডরগাওঁ এলাকার ক্ষুদ্র স্বর্ণের দোকানদার গোপালের কাছে থেকে জব্দ করা হয়। সাদিকুর এসব তাঁর মায়ের স্বর্ণ উল্লেখ করে বিপদে পড়ার কথা বলে ১৭ হাজার টাকায় বন্ধক রাখেন। ওই স্বর্ণালঙ্কার জব্দ তালিকামূলে জব্দ করা হয়। এছাড়াও আলামত হিসেবে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি লোহার হাতলযুক্ত বটি, একটি ইলেকট্রিক কাপর ইস্ত্রি মেশিন, একটি রক্তমাখা ওড়না জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার সাদিকুর ওরফে সাদি গত ১০ জুলাই সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যজিস্ট্রেট কাওসার আলমের আমলি আদালতের এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
গ্রেপ্তারকৃত সাদিকুর সাদি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার উজান গোবিন্দি গ্রামের মো. মোবারক হোসেনের ছেলে।
খুলনা গেজেট/ এস আই