খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

গণতন্ত্রের প্রসারে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা

মজিবুর রহমান, মুর্শিদাবাদ

আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন একটি উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের সঙ্গে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সংবাদমাধ্যম বা মিডিয়া। কোনও রাষ্ট্রব্যবস্থা কতটুকু গণতান্ত্রিক তা নিরূপণের প্রধান মানদণ্ড হল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। মিডিয়াকে মুক্ত ও নিরাপদ পরিসর প্রদান করা না হলে গণতন্ত্রের যথার্থ অনুশীলন সম্ভব হয় না। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষিত হলেই মতের বহুত্ব ও পথের বিবিধতার মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হতে পারে। গণতন্ত্রের ভিতকে সুদৃঢ় করার জন্য সমালোচনা শোনার সংস্কৃতির প্রয়োজন হয়। শাসকের সহনশীলতার ঘাটতি ঘটলে গণতন্ত্র তার সৌন্দর্য হারায়। সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে এই সমালোচনার কাজটি করতে পারে। তাই সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের প্রহরী (ওয়াচ ডগ)। মিডিয়া আক্রান্ত হলে গণতন্ত্রের নিরাপত্তা বিপন্নতার সম্মুখীন হয়।

মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন, উভয় প্রকার সংবাদমাধ্যমের প্রধান কাজ সংবাদ পরিবেশন করা। তবে সেই সংবাদকে সত্য, রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ও সামাজিক দিক থেকে গঠনমূলক হতে হবে। মিথ্যা ও পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ জনমানসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এজন্য বলতে হয়, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা শুধু সংবাদ পরিবেশন ও বিশ্লেষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার প্রতিক্রিয়া যাতে নেতিবাচক না হয় সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। পত্রিকার কাটতি অথবা চ্যানেলের টি আর পি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চটকদার, চাঞ্চল্যকর, অর্ধসত্য সংবাদ পরিবেশন কখনও কাম্য হতে পারে না। হলুদ সাংবাদিকতা পাঠক-দর্শকের রুচি বিকৃত করে, যা গণতন্ত্রের পক্ষে অশুভ।

শুধু গণতন্ত্রের প্রসার নয়, স্বাধীনতার আন্দোলনেও সংবাদমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। ১৯২২-এর সূচনা কাল থেকেই আনন্দবাজার পত্রিকা বিদেশি বা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিখেছে। ভারতের স্বাধীনতার সমর্থনে জনমত গঠন করেছে। ১৯৪৭ সালে অধিকাংশ সংবাদপত্রের অবস্থান ছিল দেশভাগ তথা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। নবগঠিত পাকিস্তান যখন অগণতান্ত্রিকভাবে বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপতা প্রদর্শন করছিল তখনও কলকাতা-ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোতে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। ১৯৭১-এ পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশের) মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলার সংবাদমাধ্যমকে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। বহু সংবাদকর্মী মুক্তিকামী মানুষের সমর্থনে কলম ধরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। আসলে অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আন্দোলন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারই একটা উন্নত স্তর।

এই মুহূর্তে আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বৈরতন্ত্রের পদচারণা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মিডিয়ার মুখোমুখি হন না। তিনি কখনও সাংবাদিক বৈঠক করেন না। মিডিয়াকে তিনি তাঁর প্রচারক হিসেবে দেখতে চান, কিন্তু তাঁকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে চান না। এভাবেই বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের অমর্যাদা করে চলেছেন। শুধু তাই নয়, নির্ভীক ও আপোসহীন সাংবাদিক-সম্পাদক যাঁরা শাসকের শাসানিকে পরওয়া না করে তার প্রতিস্পর্ধী হতে চেষ্টা করেন তাঁদের মর্মান্তিক পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়। এজন্য গৌরী লঙ্কেশরা খুন হয়ে যান অথবা সিদ্দিক কাপ্পানরা বিনা বিচারে কারাবাস করেন। গত সাত বছরে শাসক তথা সরকারের বিরোধিতা করার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহিতায় অভিযুক্ত হয়ে ব্রিটিশ আমলের আইনে বিশিষ্ট নাগরিকদের জেলবন্দী হওয়ার ঘটনা বেড়েছে।

আদিবাসী আন্দোলনের নেতা ৮৪ বছর বয়সী গুরুতর অসুস্থ স্ট্যান স্বামীকে সরকারের অত্যন্ত অমানবিক আচরণের শিকার হয়ে জেলবন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। কিন্তু শাসক কর্তৃক সংবাদমাধ্যমকে উপেক্ষা কিংবা সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ সহ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে যে মাত্রা ও তীব্রতায় মিডিয়ার পক্ষ থেকে সম্মিলিত প্রতিবাদ সংঘটিত হওয়া উচিত তা হচ্ছে না। এমনকি সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপও অনেক সময় সংবাদমাধ্যমে সমর্থিত হচ্ছে। মিডিয়ার একাংশ শিরদাঁড়া সোজা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে বলেই এরূপ বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে। সরকারি বিজ্ঞাপনের অস্ত্র দিয়ে শাসকশ্রেণী সংবাদমাধ্যমের আনুগত্য ক্রয় করছে। আজ ভারতে মিডিয়া হয় আক্রান্ত, নয় বিক্রিত। এজন্য গণতন্ত্রের আন্তর্জাতিক সূচকে ভারতের অবনমন ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

রাজনৈতিক দলের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত সংবাদপত্র অথবা নিউজ চ্যানেল গণতন্ত্রের প্রসারে খুব একটা অবদান রাখতে পারে বলে মনে হয় না। কারণ সেখানে সংবাদ নির্বাচন, পরিবেশন ও বিশ্লেষণে নিরপেক্ষতার আদর্শ অনুসরণ করা হয় না। নিজের দলের সবকিছুই ভালো আর বিরোধী দলের কোনও কিছুই ভালো নয়, এই মানসিকতা বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের পরিপন্থী। এজন্য দলীয় মুখপত্রের খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাংবাদিক যদি দলদাসে পরিণত হন তবে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এখন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নিবিড় অনুশীলন চলছে, যার বাড়বাড়ন্ত রোধে সংবাদমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা একান্ত জরুরি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যত মজবুত হবে গণতন্ত্রও তত প্রসারিত হবে। অনেক সময় দেখা যায়, সংখালঘু সম্প্রদায়ের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তাদের ধর্মীয় পরিচয় জুড়ে দিয়ে মিডিয়ায় বিতর্ক সৃষ্টি করা হয় কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষদের অপকর্মের আলোচনায় কখনও ধর্ম-সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ ওঠে না। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দু’চারজন ব্যক্তির দুষ্কর্মের জন্য কোনও ধর্মমত অথবা সম্প্রদায়কে দায়ী করা যায় না। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎসব-অনুষ্ঠান-সাংস্কৃতিক চর্চার ইতিবাচক দিকগুলো মিডিয়ায় এলে পরস্পরকে জানার পরিসর বাড়ে। তবে এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, সংবাদমাধ্যম সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম উৎসব নিয়ে এক মাস ধরে মেতে থাকবে আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম উৎসবের আলোচনা একদিন অথবা এক ঘন্টায় শেষ হয়ে যাবে, এটা সঙ্গত নয়। সংখ্যালঘুর গুরুত্ব খাটো করে দেখার ফলে সে হীনমন্যতায় ভোগে যা সংখ্যাগুরুর সঙ্গে তার সম্মানজনক সহাবস্থানকে কঠিন করে তোলে। সবকিছুর মধ্যেই সংবাদমাধ্যমকে একটা ভারসাম্য রক্ষা করা দরকার।

সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি গণতন্ত্র প্রসারের পরিপন্থী। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব রয়েছে যেকোনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য তুলে ধরা। লকডাউনে যখন কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে দু’মুঠো অন্নের জন্য সরকারি-বেসরকারি সাহায্যের দিকে চেয়ে থাকে তখন কোন অর্থনীতির কারণে সর্ববৃহৎ শিল্পপতিদের সম্পদের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়, সেই আলোচনা সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে হওয়া উচিত। গণতন্ত্রের কার্যকারীতা বৃদ্ধির স্বার্থে বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার বিরুদ্ধে মুখ খোলা দরকার। একইভাবে প্রশাসনে লালফিতের ফাঁস কিংবা আর্থিক অসাধুতার প্রসঙ্গ নিয়মিত মিডিয়ায় আসা উচিত। আইন, বিচার ও প্রশাসন অর্থাৎ গণতন্ত্রের অন্য তিনটি স্তম্ভকে সঠিক পথনির্দেশ করার যে সুযোগ ও স্বাধীনতা রয়েছে সংবাদমাধ্যমকে তার সদ্বব্যবহার করতে হবে।

গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য সংবাদমাধ্যমের কাছে জনসাধারণের প্রত্যশাও অনেক। সরকার বা শাসকদলের গুণগান করা সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়। বরং ক্ষমতাসীনের দোষত্রুটি তুলে ধরে দেশ তথা দশের কল্যাণে তাকে পদক্ষেপ গ্ৰহণে বাধ্য করাই সংবাদমাধ্যেমের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সরকারের সাফল্যের কথা নিশ্চয়ই আসবে কিন্তু তার ব্যর্থতার ওপরেই আলো ফেলতে হবে বেশি। তবেই তার সংশোধন ঘটবে। রাজনীতিতে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন বৃদ্ধি পেলে তা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। কাজেই সংবাদমাধ্যমকে সবসময় দুর্নীতিগ্ৰস্ত ও বাহুবলি নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্ৰহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভোটে জিতলেই যা খুশি তাই করার ছাড়পত্র মেলে না। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার মতো রাজনীতির কারবারিদের দম্ভ আর ক্ষমতায় লাগাম পরানোর কাজটা মিডিয়ার।

আমাদের রাজ্য তথা রাষ্ট্রে সংবাদপত্র ও নিউজ চ্যানেলের সংখ্যা বাড়ছে। এটা মানুষের বাকস্বাধীনতার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের প্রবণতা বৃদ্ধির একটা সুস্থ লক্ষণ। রাষ্ট্র-ক্ষমতা অনেক সময় এটা পছন্দ করে না। কিন্তু শাসকের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও যখন সেটা ঘটে তখন তা বৃহত্তর সমাজের জন্য স্বস্তিদায়ক তো বটেই। সংবাদমাধ্যমের সত্যের সন্ধান যত সফল হবে গণতন্ত্র তত বিকশিত হবে। আজ আমাদের অঙ্গীকার করতে হবে যে, সংবাদমাধ্যম নামক চতুর্থ স্তম্ভকে শক্তিহীন করে আমরা ভারতীয় গণতন্ত্রকে খোঁড়া হতে দেব না।

 




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!