খুলনা শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান শেখ সোহেল। তার চাকরি হয় বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দীনের সুপারিশে। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। সোহেলকে নামমাত্র পরীক্ষায় বসতে হয়েছে, তার চাকরি নিশ্চিতই ছিল। শুধু সোহেল নন, ওই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া ৪০ জনের মধ্যে ১৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী খুলনা বিভাগের বিভিন্ন আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, খুলনা সিটি মেয়র, কাউন্সিলর এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মীয়স্বজন।
নিয়োগের তালিকায় আছেন এমপির শ্যালিকার ছেলে ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়, ব্যক্তিগত সহকারীর স্ত্রী, সাবেক প্যানেল মেয়রের ভাগ্নে ও ভাতিজা। এর বাইরে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের নিয়োগ নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রধান যোগ্যতা ছিল তারা আওয়ামী পরিবারের সদস্য। আর এ নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমানের সহযোগিতায়।
বলা হয়ে থাকে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আওয়ামী লীগের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন। উপাচার্য মাহবুবুর রহমানের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুরে। তিনি খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা আলী আকবর টিপুর মামা। বাড়ি গোপালগঞ্জ, আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সখ্য এবং টিপুর মামা এ পরিচয়গুলো উপাচার্য হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি কাজে লাগান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে পছন্দের প্রার্থীদের মনোনীত করতে উপাচার্য নিজেই প্রশ্নপত্র তৈরি করতেন, প্রার্থীদের খাতার মূল্যায়ন করতেন। কোন পদে কাকে নেওয়া হবে তা তিনিই চূড়ান্ত করতেন। পছন্দের প্রার্থীদের আগে থেকে প্রশ্ন জানিয়ে দেওয়া ও লিখিত পরীক্ষার খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ও ছিল। ভাইভা বোর্ডে যারা থাকতেন তারাও উপাচার্যের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতেন না।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমানের আমলে যে নিয়োগ হয়েছে সেখানে পারিবারিক সিন্ডিকেট, স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়োগবাণিজ্য, দলীয়করণ সবই হয়েছে। ৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তনজনিত ঘোলাটে সময়েও নিয়োগপ্রক্রিয়ায় নীলনকশা কার্যকর করেছেন স্বয়ং উপাচার্য।
জানা গেছে, গত ২৭ আগস্ট হঠাৎ করে সিন্ডিকেট সভা ডাকেন উপাচার্য। সভায় তড়িঘড়ি করে ১৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন করিয়ে নেন তিনি। এ নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা গত ২৪ মে এবং ভাইভা ২৫ ও ২৬ জুন অনুষ্ঠিত হয়। সিন্ডিকেট সভা অনলাইনে হলেও অধিকাংশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ এ নিয়োগের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলেও উপাচার্য তা আমলে নেননি।
সিন্ডিকেট সভায় যাদের চাকরি চূড়ান্ত হয়েছে তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে কেএম রব্বানী ও উপপরিচালক (অর্থ ও হিসাব) পদে আসমা খাতুন রয়েছেন বলে একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। তাদের নিয়োগের পেছনে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতার তদবির ছিল। উপাচার্যের সঙ্গে নিয়োগের আগে থেকেই তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এ পরীক্ষায় পারসোনাল অফিসার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাজিদ মাহমুদ ও শেখ সুলতান শাহরিয়ার এবং অফিস সহায়ক হিসেবে শেখ মিরাজুল ইসলাম। তাদের নিয়োগের জন্যও তদবির ছিল খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাউদ্দীন জুয়েলের। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ওহিদুজ্জামানের জন্য সুপারিশ ছিল খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা আলী আকবর টিপুর। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার টাইপিস্ট টিপু মিত্রের জন্য সুপারিশ ছিল খুলনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্রের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মো. দীন-উল-ইসলাম বলেন, ‘সাবেক রেজিস্ট্রারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম স্বাভাবিক করার জন্য রেজিস্ট্রার নিয়োগের বিষয়ে উপাচার্য প্রস্তাব দিলে তা সিন্ডিকেট অনুমোদন করে। একইভাবে উপপরিচালক (অর্থ ও হিসাব) না থাকার কারণে বেতনবিষয়ক জটিলতা থাকায় এ পদের নিয়োগেও অনুমোদন করা হয়। এর বাইরে যেসব পদে পরীক্ষা হয়েছিল সেসব নিয়োগ পর্যায়ক্রমে দেওয়ার পরামর্শ দেয় সিন্ডিকেট।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত যাদের নিয়োগ হয়েছে তাদের বেশিরভাগই খুলনার বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারের সদস্য কিংবা তাদের সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্ত। এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. মো. দীন-উল-ইসলাম বলেন, ‘অনিয়মের মাধ্যমে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এরকম কোনো অভিযোগ আমার জানা নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি খুলনার বলে এ অঞ্চলের প্রার্থীরা বেশি হতে পারেন, কিন্তু তাদের নিয়োগে বিশেষ কারও তদবির থাকার কথা নয়।’
এর আগে ২০২২ সালের ৪ আগস্ট প্রথমবারের মতো ২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়। তখন যাদের চাকরি হয় তাদের মধ্যে ছিলেন সেকশন অফিসার শেখ আশিক আহম্মেদ কাইয়ুম; তিনি সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাউদ্দীন জুয়েলের বড় শ্যালিকার ছেলে। জুয়েলের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় অনিক ইসলামের চাকরিও তখন হয়েছিল। সহকারী প্রোগ্রামার মোস্তফা রাকিব রায়হান ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আলী আকবর টিপুর ভাগ্নে।
সহকারী পরিচালক রকিবুল ইসলাম খানের জন্য সুপারিশ করেন খুলনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার টাইপিস্ট তারিকুল ইসলাম তুফানের চাকরি হয় খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বাগেরহাট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেকের সুপারিশে। ডেসপ্যাচ রাইডার নাজমুল হাসান খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আলী আকবর টিপুর ভাতিজা। অফিস সহায়ক খাইরুল আলম খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বাগেরহাট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেকের সুপারিশকৃত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ২০২৩ সালের ১৬ মে। এ বিজ্ঞপ্তিতে তিন শিক্ষক ও তিন কর্মকর্তা নিয়োগের কথা থাকলেও যোগ্য প্রার্থী না থাকার অজুহাতে শুধু একজন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তিনি হলেন উপ-কলেজ পরিদর্শক রেশমা হোসেন; তিনি খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাউদ্দীন জুয়েলের ব্যক্তিগত সহকারী সাঈদুর রহমানের স্ত্রী।
এসব অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমানের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি তথ্য অধিকার আইনে লিখিত আবেদন করার পরামর্শ দিয়ে ফোন রেখে দেন।
খুলনা গেজেট/হিমালয়