খুলনায় বাসের আগের ভাড়া কার্যকর করা হয়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের পূর্বের ভাড়া নেওয়ার কথা জানিয়েছে যাত্রী ও বাস চালকেরা। তবে ভাড়া কমেনি অটোরিকশা, সিএনজি ও মাহেন্দ্রার। নগরীতে চলাচল করা এসব যানবাহন মানছে না সরকারি নির্দেশনা। চালকেরা বলছেন, রাস্তায় যাত্রী না থাকায় গাড়ি চালাতে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। আর এতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। একদিকে যাত্রীদের ভাড়া বেশি আদায় করছে, অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছে। পরিবহণ শ্রমিক ও যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে রয়েছে অনীহা। বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) মহানগরী ঘুরে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে।
সোনাডাঙা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, সাধারণ সময়ের চেয়ে যাত্রীর চাপও অনেক কম ছিল। ফলে কিছু কিছু বাসে আসন খালিও দেখা গেছে। কিন্তু হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। যাত্রীদের কাছ থেকে আগের ভাড়াই নিতে দেখা গেছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগও ছিল।
এ প্রতিবেদকের কথা হয়, নগরীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবী সরোজিৎ বিশ্বাসের সাথে। তিনি সাতক্ষীরা থেকে গণপরিবহণ করে খুলনাতে আসেন। এরমধ্যে মঙ্গলবার (১ সেপ্টেম্বর) থেকে গণপরিবহণে আগের নির্ধারিত ভাড়া নেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। সে অনুযায়ী সাতক্ষীরা থেকে ৯০ টাকা ভাড়া দিয়ে খুলনায় আসেন সরোজিৎ। তিনি বললেন, এখন ভাড়া আগের জায়গায় গেলেও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই গণপরিবহনে। পরিবহণ শ্রমিকেরা বেশির ভাগ মাস্ক ব্যবহার করেনি। সচেতনতা ছিল না যাত্রীদের মধ্যেও। জীবাণুনাশকের ব্যবহারও দেখা যায়নি বললেই চলে।
নগরীর পিটিআই মোড়ে দেখা গেছে, অটোরিকশা, সিএনজি ও মাহেন্দ্রা গাড়িতে ৩ থেকে ৪ জন করে যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে। কোন কোন ইজিবাইকে ৫ জনও নেওয়া হচ্ছে। অনেকের মুখে নেই মাস্ক। আবার মুখে মাস্ক থাকলেও সেটি সঠিকভাবে ব্যবহার করছেন না এসব গাড়ির শ্রমিক ও যাত্রীরা।
নগরীর সাতরাস্তা মোড় থেকে তাপস মন্ডল নামের এক তরুণ ইজিবাইকে করে রূপসা ফেরিঘাট মোড়ে যান। তিনি জানান, করোনার আগে এই পথটুকুতে ইজিবাইকে ভাড়া ছিল ৫ টাকা। করোনার মধ্যে নিয়েছে ১০ টাকা। এখনো সেই ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। এখন সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে আগের ভাড়া নেওয়ার কথা বললেও চালকেরা তা মানছে না।
টুটপাড়া জোড়াকল বাজার এলাকার ইজিবাইক চালক মো. কামরুল ইসলাম বললেন, আগের সেই দিন আর নেই। এখন বাজারে যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে, তাতে পরিবার নিয়ে চলতে কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় যাত্রীও তেমন রাস্তায় নেই। ভাড়া কমবে কেমন করে, গেল চারমাস রোজগার না থাকায় গাড়ি কেনার কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। সবমিলে বড় অসুবিধার মধ্যে চলতে হচ্ছে।
খালিশপুর নতুন কলোনী এলাকার বাসিন্দা মশিউর রহমান জনি বলেন, বিআইডিসি সড়কের চিত্রালী বাজার থেকে দৌলতপুর বিএল কলেজ ও কাঁচা বাজারে যেতে ইজিবাইকে আগে ভাড়া নিতো ৫ টাকা। করোনার কারণে সেখানে বেড়ে হয় ১০ টাকা। যা গতকাল সোমবার পর্যন্ত নেওয়ার কথা। কিন্তু আজ বুধবারও এই পথে ভাড়া নিয়েছে ১০ টাকা। ভাড়াতো বেশি নিচ্ছেই, সেই সাথে অতিরিক্ত যাত্রীও তুলছে।
নয়াবাটি এলাকার এক গৃহিনী রাহেলা বেগম বলেন, নয়াবাটি থেকে মাহেন্দ্রায় আগে যেতে ১৫ টাকা নিতো। করোনার সময়ে ২০ টাকা করা হয়। শুনেছি সরকার ভাড়া আগের মতোই নিতে বলেছে, কই ভাড়াতো কমেনি। আজ সকালে নিউ মার্কেটে গেলাম সেই ২০ টাকা নিয়েছে। আর পেছনে যাত্রী ৩ জন এবং সামনে দু’জন নিয়েছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) কানাইলাল সরকার খুলনা গেজেটকে বলেন, নগরীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা থ্রি-হুইলার গাড়িতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর সাঁচিবুনিয়া মোড় এলাকায় গিয়ে মোংলা ও চালনার দু-একটি বাসে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেখা গেছে। এর একটি মোংলা থেকে যাত্রী নিয়ে খুলনাতে এসেছে। ওই বাসের নূর ইসলাম নামের একজন যাত্রী বলেন, বাসে পূর্বের ভাড়া নিয়েছে। কিন্তু আসনের অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে বাসটি খুলনায় আসে। প্রায় চারজন যাত্রী আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বাসে জীবাণুণাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকার কথা থাকলেও বাসে এ ধরণের কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। ওই বাসচালকের সহকারি মো. সেলিম বলেন, যাত্রীদের না উঠালে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ওপরে চড়াও হয়ে গালি-গালাজ করতে থাকে। তিনি দাবি করেন সম্মানের ভয়ে অনেক সময় অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া হয়।
খুলনা-কুয়াকাটা রুটের সেভেন স্টার নামক বাস টিকিট কাউন্টারের একজন মো. মিজানুর রহমান জানান, বাজারে জীবাণুনাশকের দাম অনেক বেশি থাকায় ব্যবহার কম হচ্ছে গাড়িতে। তবে যাত্রা শুরু ও শেষে জীবাণুনাশক দিয়ে ধোয়া হয়। এখন যাত্রীর সংখ্যা কিছুটা কম থাকায় পরিবহনের সংখ্যাও আগের তুলনায় কমে গেছে। তবে যানবাহন ও যাত্রী ধীরে ধীরে বাড়বে বলে পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা জানিয়েছেন। সপ্তাহখানেক পর অবস্থা জানা যাবে বলে তাঁরা মনে করেন।
খুলনা মোটর বাসমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন বিপ্লব খুলনা গেজেটকে বলেন, পরিবহণ শ্রমিকদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গতকাল শ্রমিকদের মাঝে মাস্ক ও জীবাণুনাশক বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বাসে যাত্রীদের জন্যেও মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহার না থাকলেও যাত্রীদের মাস্ক পরে গাড়িতে উঠার জন্য বলা হয়েছে। তবে গ্রামের কিছু যাত্রী স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন না থাকায় মাস্ক ব্যবহার করছে না।
দেশে করোনাভাইরাসের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহনে চলাচল বন্ধ করা হয়। এরপর ১ জুন থেকে অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার শর্তে বাস চলাচলের সুযোগ করে দেয় সরকার। বাসমালিকদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভাড়া বাড়ানো হয় ৬০ শতাংশ। মঙ্গলবার থেকে ‘যত আসন, তত যাত্রী’ নিয়মে বাস চলাচলের নির্দেশনা দেয় সরকার। এ ক্ষেত্রে খুলনার সঙ্গে দূরপাল্লার বাস-মিনিবাসে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী না তোলা, যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকদের মাস্ক ব্যবহার এবং তাঁদের হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত সাবান-পানি ও জীবাণুনাশকের ব্যবস্থা রাখার শর্ত দেওয়া হয়। যাত্রা শুরু ও শেষে যানবাহন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ও জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা এবং যাত্রীদের হাত ব্যাগ ও মালপত্র জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখার কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু গণপরিবহণে যাত্রী ও শ্রমিকদের মাঝে স্বাস্থ্যবিধির মানতে অনীহা থাকায় করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
খুলনা গেজেট / এআর / এমএম