খুলনার স্কুলগুলোতে নামে মাত্র অনলাইন ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। কিছু কিছু স্কুলে নাম সর্বস্ব ক্লাস নেয়া হলেও সংখ্যায় তা খুবই অপ্রতুল। বহুমুখী ক্লাস ব্যবস্থার পরিবর্তে স্কুলের শিক্ষার্থীদের চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বক্তৃতা নির্ভর একমুখী ক্লাস। ফলে দিনের পর দিন প্রকৃত শিক্ষাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা এখন ঝুঁকছে কোচিং ও প্রাইভেটের দিকে। ফলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বিবেচনায় ঘরে থাকার জন্য সরকারিভাবে নির্দেশনা দেওয়া হলেও সেটি বাস্তবে ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। সকাল-বিকাল অনেক শিক্ষার্থীকে ব্যাগ কাঁধে বাহিরে ঘোরা-ফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
খোজ নিয়ে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতির কারণে সারা দেশের মত ১৫ মার্চ খুলনার স্কুলগুলোতেও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর তিনমাস সব ধরণের লেখাপড়া ও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরে ১২ মে বিভাগীয় কমিশনার ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার খুলনায় অনলাইন ক্লাস কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে খুলনায় সরকারি বেসরকারি সব ধরণের স্কুলে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম চালু থাকলেও শিক্ষকদের অনাগ্রহ ও অনভিজ্ঞতা আর অনলাইন সুবিধা না থাকায় এই ক্লাস তেমন কোন কাজে আসছে না শিক্ষার্থীদের। আর বছরের শুরুতে যে সিলেবাস দেয়া হয়েছিল, সেই সিলেবাস শেষ হওয়া তো দুরের কথা সরকারি নির্দেশনা মেনে দায়সারা ক্লাস নিতেই ব্যস্ত স্কুলের শিক্ষকরা।
খুলনা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপকের সন্তান লেখাপড়া করে নগরীর একটি নামকরা বেসরকারি স্কুলে। গত ৮ মাসে সন্তানের অনলাইন ক্লাস মূল্যায়ন করতে যেয়ে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। তার মতে, চারটি কারণে খুলনায় কোন অনলাইন ক্লাসই কাজে আসছে না। অনেক ক্ষেত্রে তা শিক্ষার্থীদের ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
প্রায় একই ধরণের অভিযোগ করেন সোনাডাঙ্গা এলাকার ব্যবসায়ী কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, অনলাইনে ক্লাস হওয়ায় ছেলের সাথে তিনিও মাঝে মাঝে দেখেন। হতাশা ব্যক্ত করে তিনি স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে গৃহ শিক্ষকের দারস্ত হয়েছেন। নৌবাহিনী স্কুল এন্ড কলেজ, খুলনা জিলা স্কুল, পি ডব্লিউডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খুলনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, খুলনা কলেজিয়েট স্কুলের আরও অন্তত ৫ জন অভিভাকের সাথে আলাপ করে মূলত চারটি কমন সমস্যা সামনে আসে যা সমাধান করা একান্ত জরুরী বলে মনে করেন তিনি।
ক্লাসের স্বল্পতা : অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, দিনে তাদের একটি অনলাইন ক্লাস হয় কোন না কোন বিষয়ের উপর। কোনদিন হয়তো কাক তালীয়ভাবে দুটিও হয়। সপ্তাহে যেখানে স্কুলের রুটিনে ৪০টির উপরে ক্লাস ছিল, সেখানে অনলাইনে মাত্র ৫ থেকে ৬টি ক্লাস হচ্ছে। যা সিলেবাস কমপ্লিট তো দুরের কথা সন্তানের লেখাপড়া নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছে তাদের পিতা-মাতা।
একমুখী ক্লাস : অভিভাবকরা বলছেন, ক্লাস সাধারণ বহুমুখী হতে হয়। সে হিসাবে জুম সফটওয়্যার ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও খুলনার স্কুলগুলোতে জুম সফটওয়্যারের পরিবর্তে লেকচার নির্ভর ভিডিও আপলোড করা হয়। যেখানে শিক্ষার্থীরা কোন প্রশ্ন করতে না পারায় শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
কনটেন্ট না থাকা : খুলনার স্কুলগুলোতে লেকচার নির্ভর ক্লাসে কোন ভিডিও কনটেন্ট থাকে না। এছাড়া অশুদ্ধ উচ্চারণে অগভীর ও নিরস আলোচনার ফলে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দিনদিন কমছে।
ফেসবুক নির্ভরতা : বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা নিজেরা ক্লাস ভিডিও করে প্রতিষ্ঠানের অথবা নিজেদের ফেসবুক পেইজে ভিডিও আপলোড দেয়। ফলে না চাইলেও সন্তানরা ফেসবুক নির্ভর হয়ে পরছে। সন্তানরা ক্লাসের জন্য ফেসবুকে ঢুকে মানহীন ক্লাস দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফেসবুকের অন্য কনটেন্টে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির খুলনা মহানগরীর সভাপতি ও পিডব্লিউডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ লিয়াকত হোসেন বলেন, খুলনার বাস্তবতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রমে কিছু সমস্যা আছে। তারপরও শিক্ষকরা চেষ্টা করে যাচ্ছে। জুম সফটওয়্যার ব্যবহারে শিক্ষকদের থেকে শিক্ষার্থীদের সমস্যা বেশি। অনেক শিক্ষার্থী অনলাইনের আওতায় নেই। তাদের কথা মাথায় রেখে ক্লাসের ভিডিও তৈরী করে দেয়া হয়।
খুলনা জেলা শিক্ষা অফিসার খোন্দকার রুহুল আমিন বলেন, সরকারি নির্দেশনা মেনে স্কুলগুলো ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিছু বাস্তবতা আছে। শিক্ষার্থী অভিভাবকরাও সবাই অনলাইনে অভিজ্ঞ না । আসলে করোনা পরিস্থিতি তো কারও হাতে না। স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী যেতে পারছে না, যা আমাদের ভালো লাগছে না। অনলাইন ক্লাস হচ্ছে একটি জরুরী ব্যবস্থা। তবে অবহেলার কোন অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খুলনা গেজেট/ এমএম