খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

খুলনার নারিকেল সংস্কৃতি

ড. খ. ম. রেজাউল করিম

সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপাদান রয়েছে, যা গোটা সমাজ জীবনকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে থাকে। যেমন-পাবর্ত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত টিপরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে একটি যৌগিক সংস্কৃতি রয়েছে। তারা বাঁশের তৈরি উঁচু ঘরে বাস করে, ঘরে ওঠার জন্য বাঁশের সিঁড়ি ব্যবহার করে, বাঁশের তৈরি মাচায় ঘুমায়, বাঁশের তৈরি অস্ত্র দ্বারা তারা শিকার করে এবং খাবার হিসেবে কচি বাঁশ খায়। এক কথায় তাদের জীবনের প্রায় সকল কর্মকান্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে  জড়িয়ে আছে বাঁশ। তাদের সংস্কৃতিকে তাই বাঁশ সংস্কৃতি হিসেবে অভিহিত করা যায়।

তেমনি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তর জেলা খুলনার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে নারিকেল। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভাগীয় প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু খুলনা। ষাটের দশকের শুরুতে ক্রমবর্ধমান প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজের সুবিধার্থে বৃহত্তর খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোহর ও বরিশাল জেলা নিয়ে খুলনা বিভাগের যাত্রা শুরু হয়।

মূলত খুলনা শহরের পত্তন হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের ভৈরব ও রূপসা নদীর মিলনস্থলে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে। খুলনা শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে উঠার পিছনে ভৌগোলিক অবস্থান ও স্থানীয় সম্পদ তথা কাঁচামালের বিপুল সমারোহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নগরীর অনতিদূরে সুন্দরবনের অবস্থানের কারণে বনের সম্পদ (কাঠ, গোলপাতা, মাছ, মধু) আহরণ ও স্থানীয় পর্যায়ে লবণ, পাট, নারিকেল, সুপারি ইত্যাদি নির্ভর ব্যবসা ও শিল্পকে কেন্দ্র করেই শহরটির ক্রমবিকাশ ঘটে। এরমধ্যে নারিকেল শিল্পের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। নারিকেল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থকরী ফল হিসেবে বিবেচিত।

নারিকেল গাছই বোধ হয় একমাত্র গাছ যার সকল অংশ মূল্যবান এবং তা বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া নারিকেল বিভিন্ন গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। ফলে নারিকেলের প্রাচুর্য এই অঞ্চলের সংস্কৃতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। নারিকেল দিয়ে ঘর ছাউনি থেকে শুরু খুঁটি, বেড়া, সোফা, জাজিম, নানা তৈজসপত্র তৈরির কাজে ব্যবহার হয়। অর্থাৎ খুলনার সামাজিক ও সাস্কৃতিক জীবনের প্রায় সর্বত্রই নারিকেলের প্রভাব লক্ষ করা যায়। এছাড়া নারিকেলকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের মানুষের নানা উপকথার প্রচলন রয়েছে। এজন্য এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে নারিকেল সংস্কৃতি বললে অত্যুক্তি হবে না।

নারিকেল বিষয়ক তথ্য : বাংলাদেশের সর্বত্রই নারিকেল জন্মায়, তবে অধিক পরিমাণে জন্মায় সুন্দরবনের জলাভূমি অঞ্চলে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া নারিকেল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। দেশে যেসব নারিকেল চাষ করা হয় সেগুলো হলো টিপিকা সবুজ, টিপিকা বাদামী ও দুধে।

জাতভেদে প্রতি গাছে ২০০ বা ততোধিক নারিকেল পাওয়া যায়। দেশের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টয়া, নাটের মাগুরা শরিয়তপুর, মাদারিপুর, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, পিরোজপুর, ঝালকাটি, বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, চট্টগ্রাম, ফেনী, লক্ষীপুর এবং নোয়াখালীর উপকূল অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে নারিকেল জন্মে। তবে দেশে নারিকেল চাষের অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্বেও এর উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম।

এক হিসেব অনুযায়ী দেশে প্রায় আনুমানিক ১৭ মিলিয়ন নারিকেল গাছ রয়েছে এবং প্রায় ৩৯০০০ হেক্টর জমিতে নারিকেল উৎপাদিত হয়। জানা যায়, দেশে ১৯৭২-৮২ অর্থবছরে ৬৭০৩৪ একর জমিতে ৬৫৬০৭ মে. টন এবং ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছরে ৭৯৯০০ একর জমিতে ৮৬০৬০ মে. টন নারিকেল উৎপাদিত হয়।

এদিকে ২০০৩ সালে দেশে প্রায় ৫১৯২ জমিতে নারিকলে উৎপাদনের পরিমাণ ২৭১১৩৫ মে. টন। আবার ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৫৮২২ একর জমিতে ৩৪০৫৬৭ মে. টন নারিকেল এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ৯১৫২ একর জমিতে ৩৮৩৮৩৩ মে. টন নারিকেল উৎপাদিত হয়। নারিকেল উৎপাদনের হার কম হওয়ার কারণ হতে পারে দক্ষিণ ভারতের মত দেশে নারিকেল তেল রান্নার কাজে ব্যবহার না হওয়া এবং রপ্তানি পণ্য হিসেবে এর চাহিদা গড়ে ওঠেনি।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ইতিহাস থেকে জানা যায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নারিকেল গাছের অস্তিত্ত্ব¡ অতীতেও ছিল। মূলত এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া নারিকেল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতকের শেষ অবধি লেখালেখি এবং রামচরিত ও অন্যান্য গ্রন্থ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধান এবং অন্যান্য শস্য ছাড়া প্রাচীন বাংলার প্রধান ভূমি ও কৃষিজাত দ্রব্য হলো আম, মহুয়া, কাঠাল, ইক্ষু, ডালিম, খেজুর, বীট, সুপারি, নারিকেল ও পান। এগুলোর মধ্যে বিশেষ করে সুপারি ও নারিকেল প্রচুর পরিমাণে জন্মায় বাংলার গঙ্গা-পদ্মা-ভাগীরথী-করোতোয়া ও বিশেষভাবে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে। আবার যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা সতীশচন্দ্র মিত্রের মতে, ফলের মধ্যে যশোর-খুলনার পূর্র্বভাগে সুপারি ও নারিকেল, মধ্যভাগে তাল ও খেজুর, উত্তরাংশে আম ও কাঁঠাল ভাল জন্মায়। তবে বর্তমানে এ অঞ্চলে নারিকেলের ব্যাপক চাষ চোখে পড়ে। ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকে দেশে নানা ধরনের প্রধান ও অপ্রধান ফলের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়। অধিকাংশ প্রধান ফলজ বৃক্ষ চিরসবুজ ধরনের যাদের মধ্যে আম, কাঠাল ও নারিকেল দেশে জন্মানো ফলজ বৃক্ষের ৯০ শতাংশ।

খুলনার মানুষের জীবনাচারে নারিকেল : ভাতে মাছে যেমন বাঙালি তেমনি বৃহত্তর খুলনার মানুষ আর নারিকেল যেন একই সূত্রে গাঁথা। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্বে নারিকেলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব চোখে পড়ে। খুলনা অঞ্চলের মানুষের ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানা, জীবনাচার, সামাজিকতা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, পেশার বৈচিত্র্য, ঘরবাড়ির ধরন ও আসবাবপত্র, শিক্ষা ও গবেষণা, পর্যটন শিল্প, চিকিৎসা, শিল্প-সাহিত্য, খেলাধুলা, বিনোদনমূলক কর্মকা- ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারিকেলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব চোখে পড়ে। জানা যায় দেশের সাতটি বিভাগের মধ্যে খুলনা বিভাগে নারিকেল উৎপাদনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

এক হিসেব অনুযায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে খুলনার ২৮৬২ একর জমিতে ৮৯০৪১ মে. টন নারিকেল উৎপাদিত হয়। আবার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬২৪০ একর জমিতে ৮৭৪৬১ মে. টন নারিকেল উৎপাদিত হয়। এখানকার মানুষ নারিকেল গাছ দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করে। এরা নারিকেল গাছ দিয়ে লাঠি, হুক্কা, চামচ, কলসির ঢাকনা, বোতাম, গহনা, শোপিস ইত্যাদি তৈরি করে।

পেশা নির্ধারণে : নারিকেলকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের অনেক মানুষ তাদের জীবন-জীবীকা নির্বাহ করে থাকে। অনেকেই নারিকেল সংশ্লিষ্ট ব্যবসার সাথে জড়িত। অনেকে গ্রামের হাট-বাজার থেকে নারিকেল ক্রয় করে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করে থাকে। এ সমস্ত নারিকেল পরিবহনের সাথে জড়িত রয়েছে অনেক মানুষ। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নারিকেল সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে জড়িত যেমন-নারিকেল তেল ও ছোলা মিল কর্মীদের অধিকাংশই নারী। এদের বেশির ভাগই বিবাহিত। নারী-পুরুষভেদে মজুরির বৈষম্য রয়েছে। কর্মরত পুরুষদের বেতন সাধারণত দৈনিক ১৫০-২৫০ টাকা। পক্ষান্তরে নারী কর্মচারীদের বেতন দৈনিক ১২০-১৭৫ টাকা মাত্র।

ঘরবাড়ি তৈরিতে : কোন অঞ্চলের ঘড়বাড়ির ধরন নির্ভর করে সে অঞ্চলের আবহাওয়া ও প্রাপ্ত কাঁচামালের সহজলভ্যতার উপর। খুলনা অঞ্চলে ঘরবাড়ি তৈরির উপাদান হিসেবে নারিকেল গাছের ব্যবহার চোঁখে পড়ে। যেমন-নারিকেল গাছের কা- দিয়ে ঘরের আড়া, খুঁটি তৈরি করা হয়। আবার নারিকেল গাছের তক্তা ঘরের বেড়া, চালের রুয়া, সিলিং বা পাটাতন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া নারিকেল পাতা দ্বারা ঘরের ছাউনি, বেড়া ও মাচা তৈরি করা হয়। আবার নারিকেল গাছের গুঁড়ি দিয়ে মাটির ঘরের সিঁড়ি তৈরি করা হয়। এছাড়া এ অঞ্চলে নারিকেল পাতার বেড়া / পর্দার ব্যবহার চোখে পড়ে। আবার নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে দড়ি, রশি ও কাছি তৈরি করা হয়, যা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়।

খাবার হিসেবে : দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার তাগিদে নারিকেল প্রচুর খাদ্য সম্ভারে সমৃদ্ধ। নারিকেল কাচা-পাকা দুই অবস্থায়ই খাওয়া যায়। এ অঞ্চলের মানুষ নারিকেল দিয়ে বিভিন্ন প্রকার সুস্বাদু খাবার তৈরি করে থাকে। যেমন- নারিকেলের নাড়ু, সন্দেশ, কুলি পিঠা, ভাপা পিঠা, তালের পিঠা, পোলাও, কোরমা, খিচুড়ি, সেমাই নারিকেল, নারিকেল-মুড়ি, নারিকেল-চিংড়ি, নারিকেল-পটল, নারিকেল-কচু, নারিকেল-মুরগী, নারিকেলের দুধ দিয়ে আমড়া, নারিকেলের মালাই, আইসক্রিম ইত্যাদি। কচি নারিকেলের সাদা অংশ (শাঁস) অত্যন্ত সুম্বাদু ও পুষ্টিকর। নারিকেলের শাঁস দিয়ে বিভিন্ন প্রকার পিঠা, মিষ্টি, বিস্কুট, চকলেট তৈরি ও বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার হয়। এছাড়া নারিকেলের রস দিয়ে গুড় ও তাড়ি (দেশি মদ) তৈরি হয়।

এছাড়া ডাবের পানি ও নারিকেলের ফোপড়া ইত্যাদি সুস্বাদু খাবার হিসেবে স্বীকৃত। এ অঞ্চলে রমজান মাসে ইফতারিতে নারিকেল-চিড়া-গুড় বহুল প্রচলিত খাবার। আবার নারিকেল গাছের কচি আগা (মাথি) খাওয়ার প্রচলন আছে। এ অঞ্চলে পান্তাভাতের সাথে গুড় ও নারিকেল পরিবেশন করা হয়। আবার নবান্ন বা হালখাতার পায়েস তৈরিতে নারিকেল ব্যবহার করা হয়। জানা যায়, কয়েক দশক আগে এ অঞ্চলের অনেক বাড়িতে নারিকেল তেল দিয়ে রান্না করা হত। বর্তমানে সয়াবিন তেলের সহজ প্রাপ্যতার ফলে খাবারে নারিকেল তেলের ব্যবহার তেমন আর দেখা যায় না। এছাড়া নারিকেল গাছের কচি শিকড় পানের সাথে সুপারির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সামাজিকতায় : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-সামাজিকতা হলো লোকালয়ের প্রাণ। সামাজিকতায় খুলনা অঞ্চলের মানুষের রয়েছে অনেক খ্যাতি। এ অঞ্চলের মানুষ সাধারণত কোন অসুস্থ রোগী দেখতে গেলে সাথে ডাব নিয়ে যায়। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে বিবাহিত মহিলারা বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি ফেরার সময় নারিকেল/ ডাব সঙ্গে নেয়। এমনকি এখানে গাছ থেকে নারিকেল নামানোর সময় কেউ পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে ২/১ টি নারিকেল ফ্রি দেয়া হয়। এ অঞ্চলের রীতি অনুযায়ী হিন্দু বিয়ের সময় বরপক্ষ মেয়ে পক্ষকে বিশেষ করে মেয়ের মাকে ৪টি ডাব উপঢৌকন হিসেবে দিয়ে থাকে। এছাড়া ঈদের আগের দিন শহরের ধনী শ্রেণিরা গ্রামীণ গরীবদের মধ্যে চাউল, চিনি, গুড় ও নারিকেল বিতরণ করে থাকে।

আতিথেয়তায় : কোন অঞ্চলের মানুষের আতিথেয়তা ঐ অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য দ্বারা অনেকখানি প্রভাবিত। খুলনা অঞ্চলের মানুষের আতিথেয়তার অন্যতম উপাদান নারিকেল। এক সময়ে এ অঞ্চলে গুরুদক্ষিণা হিসেবে নারিকেল প্রদানের প্রচলন ছিল। কারো বাড়িতে ভিন্ন অব্জল থেকে কেউ বেড়াতে এলে তাদেরকে নারিকেলের তৈরি বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়। আরেকটি বিষয় হলো, এ অঞ্চলের মানুষ চায়ের বিকল্প হিসেবে অনেকে অতিথিদের ডাবের পানি সরবরাহ করে থাকে।

শিল্পের কাঁচামাল : কোন অঞ্চলে কোন ধরনের শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে তা নির্ভর করে ঐ অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও কাঁচামালের উপর। সঙ্গত কারণেই নারিকেলকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এ সমস্ত মিল কারখানায় তেল, কাতা, দড়ি, ঝাড়–, চামচ, মশার কয়েল, ব্রাশ, বোতাম, কলমদানী ও বিভিন্ন ধরনের শোপিস তৈরি হয়। নারিকেল কারখানায় উপজাত খৈল গরু ও মাছের খাবার ও জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার শুকনো নারিকেলের শাঁস থেকে উদ্ভিজ তৈল মাথায় ব্যবহার ছাড়াও সাবান, শ্যাম্পু এবং অন্যান্য প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গ্রামের অনেকে চুল পরিস্কার করার জন্য নারিকেলের খৈল ব্যবহার করে থাকে। নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে এক প্রকার শক্ত দড়ি তৈরি করা হয়, যা পানিতে ভিজে সহজে নষ্ট হয় না। এ দড়ি জাহাজ ও নৌকায় ব্যবহার করা হয়। এছাড়া নারিকেলের খোল দিয়ে হুঁকা তৈরি করা হয়।

চিকিৎসায় : নারিকেলের রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। যেমন কচি ডাবের পানি খুবই পুষ্টিকর, সুপেয় ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। এতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে। যে কোন ধরনের রোগীর খাবার হিসেবে ডাবের ব্যবহার চোখে পড়ে। ডায়রিয়া রোগের প্রধান খাদ্য হিসেবে ডাবের ব্যবহার দেখা যায়। নারিকেলের পানি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। তাই অনেক রূপসচেতন সৌখিন নারীরা ডাবের পানি তাদের রুপচর্চার কাজে ব্যবহার করে থাকে। নারিকেল তেল চুল পড়া রোধ করে। নারিকেল গাছের শিকড়ের রস কৃমিনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার অনেক নারিকেল গাছের মূল নেশার জন্য চিবিয়ে থাকে। এ অঞ্চলের মানুষ মুমুুর্ষু রোগীকে দেখতে যাবার সময় হরলিক্স, গ্লুকোজ ও ডাব সঙ্গে নিয়ে থাকে। এছাড়া এ অঞ্চলে পচা নারিকেল তৈল কাটা, পোড়ার প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

আসবাবপত্র তৈরিতে : আধুনিক জীবনের অনেক সৌখিন উপাদানই নারিকেল দ্বারা তৈরি হয়ে থাকে। যেমন-সোফা, জাজিম, তোষক, ব্রাশ, ব্যাগ, টুপি, স্যান্ডেল, পাপোষ, কুরুশ, জাজিম, সোফা, গাড়ির সিট, গদি ইত্যাদি তৈরিতে নারিকেলের ছোবড়ার ব্যবহারের তুলনা নেই। দেশের সোয়ান, আখতার, পারটেক্স ও টাইগারসহ কয়েকটি প্রতিষ্টানের ম্যাট্রেজ উৎপাদনে ছোবড়া ব্যবহার করা হচ্ছে।

এছাড়া নারিকেলের মালা (খোলস) দিয়ে বিভিন্ন রকমের প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা হয়। যেমন বাটি, হাতা, বোল, কলমদানি, মোমদানি, লবণদানি, হলুদদানি, চামচ, আসবাবপত্রের ঢাকনা, সৌখিন বোতাম, চাবির রিং, টেবিল ল্যাম্পের স্ট্যান্ড, পাখি, ফুল, হাতিসহ নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন শোপিস। এছাড়া নারিকেলের ছোবড়া ও শুকনো পাতা দিয়ে মাদুর, কাতা, ঝুড়ি এবং নারিকেল শলাকা দিয়ে ঝাড়– তৈরি হয়ে থাকে। আবার নারিকেলের ছোবড়া হাড়ি-পাতিল-থালা বাসনের মাজনি হিসেবে ব্যবহ্রত হয়।

ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে : খুলনা অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাামাজিক উৎসবে নারিকেলের ব্যবহার চোখে পড়ে। যেমন- ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব যেমন-ঈদ, শবেবরাত, রোজার সময় নারিকেল দ্বারা বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনার অন্যতম উপাদান হলো ডাব ও নারিকেল। তারা কচি ডাবে চিত্রাংকন করে পুরাহিতদের প্রদান করে থাকে। বিভিন্ন পূজা ও সামাজিক উৎসবে তারা নারিকেলের নাড়– ও সন্দেশ তৈরি করে থাকে।

গ্রামাঞ্চলে গাছের প্রথম নারিকেল হলে তা মসজিদে দান করা হয়। এছাড়া হিন্দুরা কোন শুভ কাজ শুরু করার পূর্বে নারিকেল ভেঙ্গে থাকে। যেমন- নতুন ঘর তৈরির সময় নারিকেল ভাঙ্গা হয়। এ অঞ্চলে একটি সংস্কার প্রচলিত আছে তা হলো নারিকেল গাছ লাগালে পুত্রসন্তান মারা যায়।

যোগাযোগ ব্যবস্থায় : যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও নারিকেল গাছের প্রভাব চোখে পড়ে। নারিকেল গাছ খুলনা অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করেছে। এ অঞ্চলে ছোট ছোট অসংখ্য নদী ও খাল রয়ে গেছে। এ সমস্ত সরু নদী ও খাল পারাপারের জন্য সেতু হিসেবে নারিকেল গাছের ব্যবহার দেখা যায়। আবার সাঁকো বা পুলের খুঁটি হিসেবে নারিকেল কাঠের ব্যবহার চোখে পড়ে। এছাড়া নারিকেল গাছ দিয়ে ডিঙ্গি নৌকা তৈরি করা হয় যা ছোট খাল ও চিংড়ি ঘেরে যাতাযাতের কাজে ব্যবহৃত হয়।

জ্বালানী হিসেবে : নারিকেলের মালা, ছোবড়া, শুকনা পাতা, বাকল এ অঞ্চলের মানুষের জ্বালানীর অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নারিকেলের মালা তুষ কাঠের মত ভালো জ্বালানি তৈরিতে সহায়তা করে। আবার এ অঞ্চলে গোবরলাঠি তৈরিতে পাটকাঠির পরিবর্তে নারিকেলের লাঠি ব্যবহার দেখা যায়। গোয়াল ঘরে মশা তাড়ানোর জন্য নারিকেলের ছোবড়ার আগুন খুবই কার্যকরী। হুক্কার আগুনেও নারিকেল ছোবড়ার ব্যবহার লক্ষনীয়। দোকানে বা গৃহে সন্ধ্যাবেলায় ধূপ সহকারে নারিকেল ছোবড়ার আগুনের ধোয়া দেয়ার দৃশ্য অহরহ চোখে পড়ে।

বিনোদনমুলক কর্মকান্ডে: নারিকেলকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে নানা প্রকার সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক কর্মকা- পরিচালিত হয়ে থাকে। যেমন- নারিকেল খাওয়া প্রতিযোগিতা, গাছে উঠে মুখ দিয়ে নারিকেল ছুলে ফেলা ও খাওয়া প্রতিযোগিতা, ছোট অপুষ্ট নারিকেলকে গুটি হিসেবে বানিয়ে বিভিন্ন্ ধরনের খেলা, যেমন- বাঘ-ছাগল খেলা। এছাড়া নারিকেলের শলাকা ঘুড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয় এবং নারিকেলের ডেগো দিয়ে বাচ্চারা ক্রিকেট ব্যাট ও স্ট্যাম্প বানিয়ে থাকে। নারিকেলের পাতা দিয়ে শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলনা যেমন- পাখা, টিয়া পাখি, ফুল, ঘড়ি, চশমা, বল, নৌকা ইত্যাদি তৈরি করা হয়। আবার শিশুদের সাঁতার শিখতে ঝুনা নারিকেল ব্যবহার করা হয়।

খুলনা অঞ্চলের পুকুরের পাড়ে নারিকেল গাছের সারি চোখে পড়ে, যা মাটির ক্ষয়রোধের পাশাপাশি সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে। এছাড়া জমি বা বাড়ির সীমানা নির্ধারণে নারিকেল গাছের ব্যবহার দেখা যায়। ঢেকি স্থাপনেও নারিকেল গাছের ব্যবহার দেখা যায়। নারিকেল গাছ পানির নল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তর জেলা খুলনার অর্থনীতি তথা জাতীয় অর্থনীতিতে নারিকেলের ব্যবহার ও অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারিকেল এ অঞ্চলের সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। নারিকেলের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ। এ অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচারের সাথে নারিকেল ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ধনী-গরীব নির্বিশেষে এই অঞ্চলে নারিকেল ব্যবহার করে থাকে। এক কথায়, এ অঞ্চলের মানুষের আত্মার সাথে স্থাপিত হয়েছে নারিকেলের এক নিবিড় বন্ধন।

সহায়ক তথ্যপঞ্জি :
নিহার রঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস : আদিপর্ব, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ১৪০৪
নাজমুল করিম, সমাজ সমীক্ষণ, ঢাকা: নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৮৯
আবদুল বাকী ও জামাল খান, ভূবনকোষ (ভৌগোলিক শব্দ সংকলন), ঢাকা: বঙ্গ প্রকাশনী, জুন ১৯৯৭
খান বাহাদুর আব্দুল হাকিম (সম্পাদিত), বাংলা বিশ্বকোষ, ৩য় খ-, ঢাকা: নওরোজ কিতাবিস্তান, জুলাই ১৯৭৩
সিরাজুল ইসলাম (সম্পাদিত), বাংলা পিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ, খ- ৫, মার্চ ২০০৩
সতীশচন্দ্র মিত্র, যশোহর-খুলনার ইতিহাস, খুলনা: রূপান্তর, ফেব্রুয়ারি ২০০১
সাহানুর রহমান, নারিকেলের মালাও ফেলনা নয়, দৈনিক কালেরকণ্ঠ (ঢাকা), ২৫ আগস্ট ২০১৪
মাসুদ রুমী, নারিকেলের ছোবড়া থেকে ম্যাট্রেস, দৈনিক কালেকন্ঠ (ঢাকা), ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০
‘সুস্থতার জন্য নারিকেল’ দৈনিক প্রথমআলো (ঢাকা), ২৯ আগস্ট ২০১৪

(লেখক : ড. খ. ম. রেজাউল করিম, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর-৭৪০০)

খুলনা গেজেট/ এস আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!