খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  হাইব্রিড মডেলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, রাজি পাকিস্তান; ভারতের ম্যাচ দুবাইয়ে : বিসিবিআই সূত্র
  গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত, গুম কমিশনের সুপারিশে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে

খুলনার তরুণীটির সাথে আসলে কী হয়েছিল? কী হতে পারত, আর কী হলো?

হাসনাত কাদীর, সহসম্পাদক সমকাল

ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ আনা তরুণী কেন ভিন্ন সুরে কথা বললেন? খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছিল, ধর্ষণের অভিযোগে জবানবন্দিও দিয়েছিলেন। পরের দিন ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয় ১০-১২ জনের একটি দল। এরপর যখন তিনি জনসম্মুখে এলেন- বললেন, ধর্ষণের অভিযোগ সত্য নয়, এমনকি তাকে অপহরণও করা হয়নি। খুলনার তরুণীটির সাথে আসলে কী হয়েছিল? কী হতে পারত, আর কী হলো?

গত শনিবার থেকে কথা হচ্ছে খুলনার এই তরুণীকে নিয়ে। ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য গাজী এজাজ আহমেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগ ছিল তার। তরুণী বলেছিলেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে দীর্ঘদিন তার সঙ্গে বারবার মেলামেশা করেছেন এজাজ। বিয়ের জন্য চাপ দিলে গত শনিবার রাতে ফোন করে ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ডেকে আবারও ধর্ষণ করেন।

এজাজের ব্যক্তিগত কার্যালয়ের পরের দৃশ্যে তরুণীকে দেখা যায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি)। শনিবার রাত ১১টার দিকে তিনি ওসিসিতে ভর্তি হন। পরের দিন হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর তিনি ও তার মা অপহরণের শিকার হন।

সে সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার একটি প্রতিনিধিদল। সংস্থাটির খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মোমিনুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, ধর্ষণের খবর শুনে তরুণীকে সহায়তা করতে তারা হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তরুণীকে জোর করে গাড়িতে ওঠাতে দেখে ছবি তুলতে গেলে রুদাঘরা ইউপি চেয়ারম্যান তৌহিদুজ্জামান কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি ধর্ষণে অভিযুক্ত এজাজের চাচাতো ভাই। সে সময় মানবাধিকার সংস্থার সদস্যদেরও মারধর করা হয়েছে।

ঘটনাপ্রবাহে নাটকীয় বাঁকবদল দেখা যায় ধর্ষণের অভিযোগের ২৪ ঘণ্টার মাথায়। রোববার রাত পৌনে ১১টায় ওই তরুণীকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সোনাডাঙ্গা থানায় হাজির করা হয়। ধর্ষণের শিকার হননি দাবি করে সে সময় সাংবাদিকদের তিনি জানান, তাকে অপহরণও করা হয়নি। যশোরের কেশবপুরে আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন। এরপর পুলিশ খবর দিলে থানায় এসেছেন। এরপরই তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ। আমি কখন, কোথায়, কীভাবে গেলাম জানি না।’

তাকে কেন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল– সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে জানান, তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অতিরিক্ত প্রশ্ন করলে তিনি ‘পাগল’ হয়ে যাবেন।

যে তরুণীকে নিয়ে এত ঘটনা, তার বছর ২৪ বয়স। এই বয়সে বিশ্বাস ও ভালোবাসায় পৃথিবীকে জাদু করে তারুণ্য। অথচ এই তরুণীর পায়ের নিচে অবিশ্বাসের কী পিচ্ছিল দেয়াল গড়ে উঠল! প্রথমে তিনি বললেন, ভালোবেসেছিলেন- বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতকতা আর ধর্ষণ-অপহরণের মতো ক্লেদাক্ত বিষতীর পেলেন। তারপর যখন বললেন তিনি ধর্ষণ বা অপহরণের শিকার নন, তখন বিশ্বাস শব্দটিই কি প্রহসনের অট্ট হাসি হাসল না? হয়ত সমুখের জনতা বিরক্ত হলেন, কেউ কেউ ভাবলেন- ক্ষমতার খেলায় এ দেশে কতজনের কত সম্ভ্রম, কত প্রেম, কত সত্য চাপা পড়ে গুমরে কাঁদে! এ আর নতুন কী? কিন্তু ঘটনার ঘনঘটায় ভুলে বা অ-ভুলে কত কত মানুষের ভেতরের মানুষটি যে ধীরলয়ে ঝরে পড়ে এ দেশে, জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে হাহাকার আর আত্ম-প্রবঞ্চনায় বারবার মরে যাওয়ার তালিকায় যোগ দেয় কতজন, কেউ কি তা লক্ষ্য করে?

মানুষ টুপ করে ভেতরে ভেতরে মরে যায় তখন, যখন সে অন্যায়ে চুপ থাকে। মানুষ তখনই চুপ থাকে, যখন সে আত্ম-প্রবঞ্চনার পাপে হারায় সততা ও প্রতিবাদের সৎসাহস। আর এই পথে তখনই ধাবিত হওয়া সহজ, যখন আইনের শাসন শিথিল হয়।

মেয়েটির মাইক্রো বায়োলজিক্যাল রিপোর্ট পেতে এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ফলাফল পেতে এক মাস বা দুই মাস সময় লাগতে পারে। এদিকে ধর্ষণ বা অপহরণের অভিযোগে ওই তরুণী এখনো (মঙ্গলবার সকাল ১০টা) কোনো মামলা করেননি।

অনেকেই বলছেন, খুলনার এই তরুণী প্রভাবশালীদের চাপে পরাজিত। তাকে ভয়ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে ম্যানেজ করা হয়েছে। সে কারণে তিনি এখন মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। প্রশাসনের উচিত নিরপেক্ষ তদন্ত করে দেখা। মেয়েটিকে সেফ কাস্টডিতে রেখে কাউন্সেলিং করা। তাকে মানসিকভাবে স্থির হতে সাহায্য করে বক্তব্য নেওয়া।

এই যে ভয়ে চুপ করে যাওয়া কিংবা প্রলোভনে ম্যানেজ হওয়া- এটিও এ দেশে বিরল নয়। এমনটি যতই ঘটছে ততই ‘বারবার মরে যাওয়া’ মানুষের দলে ভিড় বাড়ছে। আত্মহত্যার হিসাব রাখছে দেশ। কিন্তু আত্ম-প্রবঞ্চনায়, ভয়ে ও সাহসহীনতায় যারা জীবন্মৃত, তাদের পরিসংখ্যান কেউ রাখে না। এইসব সিস্টেম্যাটিক ভাইরাস নিয়ে কথা কেউ বলে না।

তরুণী বলেছিলেন, মানসিকভাবে তিনি বিপর্যস্ত। তার মনের খোঁজও হয়ত কেউ নেয়নি। তবে যে জিজ্ঞাসা এখনো শিথিল হয়নি সেটি হচ্ছে, তরুণী আসলেই নির্যাতনের শিকার হননি তো? তার বিশ্বাস-ভালোবাসা ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো করেনি তো কেউ? বুকের ভেতর আগুন পুষে সব ঘৃণা গিলে ফেলতে তাকে আসলেই কেউ বাধ্য করেনি তো?

তবে এরচেয়ে অধিক জরুরি প্রশ্নটি হলো- যদি এমনটি হয়, তাহলে ‘বারবার মরে যাওয়া’ মানুষের দলে না ভিড়ে, যাবতীয় রক্তচক্ষু, পোশাকি লজ্জা ও সম্ভ্রমকে তুড়ি মেরে শিরদাঁড়া টান করে কীসে এ দেশের তরুণেরা মাথা উঁচু করে সত্যের গান গাইবে? যবে গাইবে, তবেই না ফুল হয়ে পৃথিবীকে সৌরভ বিলাবে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!