খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

কে এম আজিজুল হক : আমাদের বংশের বাতিঘর

ড. খ ম রেজাউল করিম

না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমাদের বংশের বাতিঘর, আমার কাকা কে এম আজিজুল হক। গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে তিনি তার রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের রুপাখাড়ায় নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। গত তিন বছর যাবত তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে ভূগছিলেন।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। কেমো ও রেডিও থেরাপি দেয়ার পর তিনি অনেকটাই আরোগ্যের পথে ছিলেন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে হঠাৎ ষ্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে বগুড়াস্থ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার তাকে ক্লিনিক্যাল ডেথ ঘোষণা করলে বাড়িতে ফেরত আনা হয়। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক পূত্র ও এককন্যাসহ বহু আত্মীয়- স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে যান। তার মৃত্যু সংবাদ স্যোসাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হবার পর রাতেই ছুটে অসেন জাতীয় সাংসদ ডা. এম এ আজিজ। ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় রুপাখাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

জানাজায় রায়গঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সেক্রেটারি শরীফ খন্দকার, সলংগা থানা আওয়ামী লীগ নেতা আসলাম খন্দকার, ধুবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি, মরহুমের সহপাঠিসহ সিরাজগঞ্জের শিক্ষক নেতৃবর্গ উপস্থিত ছিলেন। জানাজার পরে তাকে গ্রামের সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ গ্রামের সামাজিক কবরস্থানের প্রতিষ্ঠাতা আমার দাদা আলহাজ মফিস উদ্দিন খোন্দকার। মুলত তার প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এবং তার দেয়া জমিতে প্রথম এ গ্রামে করবস্থানটি চালু হয়।

কে. এম. আজিজুল হক নিজ এলাকা ও এলাকার বাইরে হক সাহেব নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ২৫ জুলাই সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের রুপাখাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা- মৃত নজাব আলী খোন্দকার, মাতা আবজান নেছা। তিনি ছিলেন বাবা-মার পঞ্চম সন্তান আর ভাইদের মধ্যে তৃতীয়। তিনি ছিলেন আমাদের পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী ও কম কথা বলা মানুষ। কিন্তু পারিবারিক অভাব অনাটন ও তার নানামুখী কর্মকান্ডের কারণে পড়াশুনায় খুব বেশি মনোযোগী হতে পারেননি। তিনি ১৯৬৮ সালে নিমগাছি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২য় বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। তিনি ছিলেন ওই বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। উল্লেখ্য ওই বিদ্যালয়ের অন্যতম উদ্যোক্তা ও শিক্ষক ছিলেন আমার বাবা। এরপর ১৯৭০ সালে বগুড়ার শেরপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। একই বছর তিনি রুপাখাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৫ সালে বগুড়া নৈশ কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। এরপর তিনি ১৯৮০ সালের শুরুতে বগুড়ার সোনাতলা পিটিআই থেকে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে তিনি সহকারী শিক্ষা অফিসার হিসেবে পাবনা জেলার চাটমোহর থানায় যোগদান করেন। পাশাপাশি তিনি আমার বাবার অনুপ্রেরণায় ১৯৯০ সালে রাজশাহী শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন।

উল্লেখ্য এর কয়েক বছর আগে আমার বাবা একই মহাবিদ্যালয় থেকে বিএড করেন। পরবর্তী কালে তিনি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পান। শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও উল্লাপাড়া উপজেলায় বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেন। অত্যন্ত মেধাবী, দক্ষ, দায়িত্বশীল ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবে এলাকায় তার ব্যাপক সুনাম ছিল। কর্মের স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি ১৯৯৭ সালে তৎকালীণ সরকার কর্তৃক শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে পদক লাভ করেন। সে সময়ে তিনি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। তিনি ২০০৯ সালের ২৪ মে চাকরি থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি তিন বছরের জন্য রিসোর্স পারসন হিসেবে গাইবান্ধা পিটিআই-এ নিয়োগ পান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রায়গঞ্জ উপজেলা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী সমিতি ও সিরাজগঞ্জ জেলা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী সমিতির সভাপতিসহ নানা সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি একধারে ফুটবল, ভলিবল খেলোয়ার, নাট্যাভিনেতা, বংশিবাদক, লেখক ও নাট্যজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আশির দশকে তার সম্পাদনায় রায়গঞ্জ থেকে অন্বেষা নামে একটি লিটিল ম্যাগাজিন বের হতো। তিনি প্রগতিশীল ও মননশীল চিন্তা চেতনার অধিকারী ছিলেন।

তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পারিবারিক অনিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিতে পারেননি। কিন্তু গোপনে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য গ্রামের যুব শ্রেণিতে উদ্বুদ্ধ করা এবং তাদেরকে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিতেন। এরকম একটি কাজে তিনি এক গভীর রাতে গ্রামের পশ্চিমপাড়ার শাহজাহান সরকারকে সাথে নিয়ে হারণি খালে নৌকায় আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করতে যান। খবরটি গ্রামের রাজাকারদের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী আকড়া গ্রামের মাওলানা মফিস-এর কানে পৌঁছায়। পরদিন ফজরের নামাজের পর ৭-৮ জন অস্ত্রধারী রাজাকার তাকে বাড়ি থেকে চোখ ও হাত বেঁধে মাওলানার আস্তাতায় নিয়ে যায়। সেখানে মাওলানা মফিস-নির্মিত অস্থায়ী কারাগারে সারাদিন আটকে রেখে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। খররটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে আমার বাবাসহ গ্রামের ১৫-২০ জন মানুষ মাওলানা মফিজের কাছে গিয়ে তার প্রাণভিক্ষা দাবি করেন। পরে মুসলেকা দিয়ে তাকে ফেরত আনা হয়। এ বিষয়ে সহায়তা করেন আমরা বড় চাচার শ্বশুর আকড়া গ্রামের হাজি বনদ আলী। তাকে ছেড়ে দেয়ার সময় শর্ত দেয়া হয়, যদি সে আবারও এ ধরনের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হয় তবে তাকে হত্যাসহ পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হবে। এরপর থেকে গ্রামের কয়েকজন রাজাকার রাতের বেলা তাকে নিয়মিত পাহাড়া দিত। তিনি শেষ বয়স পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করে গেছেন।

তিনি আমিসহ আমাদের পরিবারের অনেকেরই শিক্ষাগুরু। আমার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি তার হাতে। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন আবার শাসনও করতেন। মনে পড়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সার্কুলারটিও তিনি আমাকে সরবরাহ করেছেন।

লেখক : সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধুসুদন কলেজ, যশোর।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!