খুলনা সিটি করপোরেশনে (কেসিসি) সার্ভেয়ার হিসেবে পূর্ত বিভাগে চাকরিজীবন শুরু করেন মিজানুর রহমান। পদটি তৃতীয় শ্রেণির। পদ শূন্য থাকায় তাঁকে উপসহকারী প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অবর্তমানে মিজানুরকে এবার নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডে নাগরিক সেবা কার্যক্রম চলমান রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি কাউন্সিলরের মতোই নাগরিকত্ব, উত্তরাধিকার, চারিত্রিক, অবিবাহিত, জন্ম ও মৃত্যু সনদসহ প্রয়োজনীয় প্রত্যয়নপত্র দিতে পারবেন।
একই দায়িত্ব পেয়েছেন আরেক উপসহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম। তৃতীয় শ্রেণির সার্ভেয়ার তাঁর মূল পদ। নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের সেবা দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।
শুধু নজরুল ইসলাম বা মিজানুর রহমানই নন; কেসিসির দ্বিতীয় শ্রেণির ১০ জন এবং তৃতীয় শ্রেণির ৯ জন কর্মচারীকে ১৯টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের সেবা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্য ১২টি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পেয়েছেন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা। কেসিসির কাউন্সিলর পদটি সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ। তাদের নিচে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, উপ-সচিব মর্যাদার সচিবসহ প্রশাসন ক্যাডারের অন্যান্য কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বাদ দিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের দায়িত্ব দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কাউন্সিলর ও নাগরিক নেতারা। কেসিসির অন্য কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর কেসিসিসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর অপসারণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কাউন্সিলরদের অবর্তমানে সেবা কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। এনিয়ে গত ১ অক্টোবর দৈনিক পূর্বাঞ্চলে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ হয়।
পরদিন গত ২ অক্টোবর কেসিসির ৩১ জন কর্মকর্তাকে ৩১টি ওয়ার্ডে সেবা কার্যক্রম চলমান রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩, ৪, ৫, ৭, ৮, ১১, ১৬, ১৭, ১৮, ২৩ ও ২৪ নং ওয়ার্ডে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা দায়িত্ব পেয়েছেন। ১৯নং ওয়ার্ডে দায়িত্ব পেয়েছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া আই টি ম্যানেজার শেখহাসান হাসিবুল হক। এই পদটিও প্রথম শ্রেণির ধরা হয়।
অন্য ওয়ার্ডগুলোর দায়িত্বে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা। এদিকে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের স্বাক্ষর করা সনদ চাকরি বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা যাবে কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সাধারণত সনদের সত্যতা নিশ্চিত করতে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্বাক্ষর করা প্রত্যয়নপত্র ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া কর বিভাগ ও পূর্ত বিভাগের কয়েকজন উপ-সহকারী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কাজে অনিয়ম, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। লাভজনক এসব পদে অনিয়মের সুযোগ আরও বেশি। তাদের এসব সনদ প্রদানের দায়িত্ব দেওয়ায় নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। রয়েছে অনিয়মের আশংকাও।
বিষয়টি জানতে পেরে গত বৃহস্পতিবার নগর ভবনে যান বেশ কয়েকজন অপসারিত কাউন্সিলর। তাদের মধ্যে রাজুল হাসান রাজু, গোলাম মাওলা শানু ও আরিফ হোসেন মিঠু বলেন, জনপ্রতিনিধিদের হেয় করতে এটা করা হয়েছে।
৬নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শামসুদ্দিন আহম্মেদ প্রিন্স বলেন, ওয়ার্ডের উন্নয়ন কাজে ফাঁকি ও অনিয়ম করায় মিজানুরকে ওয়ার্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। শুক্রবার দুপুরে তার প্রথম স্ত্রীকে বাড়িতে পাঠিয়ে বলেছেন, ‘ওরে বাদ দিয়ে এখন আমি কাউন্সিলর, দেখ কেমন লাগে ?’
এ ব্যাপারে খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, এটি খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হলো। প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের একাধিক ওয়ার্ডে দায়িত্ব দিলে ভালো হতো।
কেসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কর তাজুল ইসলাম বলেন, এখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণি বলে কোনো পদ নেই। বর্তমানে গ্রেড অনুযায়ী স্তর ধরা হয়। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে-তারা অনেক সিনিয়র স্টাফ। অনেকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি বেতন পান। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে দেওয়ার মতো লোক ছিল না। সেবা সহজ করতেই প্রতিটি ওয়ার্ডে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তবে প্রশাসন ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত নবম গ্রেড থেকে প্রথম শ্রেণি ধরা হয়। এখন কেউ যদি ১৫ গ্রেডে চাকরি পান। দীর্ঘদিন চাকরিরত থাকায় বাড়তে বাড়তে তার বেতন এক সময় অষ্টম বা নবম গ্রেডে আসবে। তাই বলে তিনি নবম গ্রেড বা প্রথম শ্রেণির মর্যাদাবান হবেন না। তিনি ১৫ গ্রেডের কর্মচারী হিসেবেই বিবেচিত হবেন।
এদিকে দায়িত্ব পেলেও কাজ করা নিয়ে আতংকে রয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের ৩ জন বলেন, সারাদিন দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। এর মাঝে ওয়ার্ডে গিয়ে এসব দায়িত্ব পালন করা কতোটুকু সম্ভব হবে বুঝতে পারছি না। এছাড়া উত্তরাধিকার, চারিত্রিক, ভূমিহীন ও অবিবাহিত সনদ নিয়ে প্রায়ই আইনী জটিলতা তৈরি হয়। এখন সনদ দিতে গিয়ে মামলার আসামি হবো কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি।
খুলনা গেজেট/হিমালয়