রহমত, ক্ষমা আর মুক্তির বার্তা নিয়ে মাহে রমজান আগতপ্রায়। যার মহত্ব ও মর্যাদা সীমাহীন। পরকালীন পুজি সঞ্চয় করার জন্য নেকী উপার্জনের মৌসুম হিসেবে মানব জীবনে রমজানের গুরুত্ব অতুলনীয়। কুরআন ও কুরআন নাযিলের মাস রমযানুল মুবারক উম্মতে মুহাম্মাাদীর জন্য আল্লাহ তা’আলা এক বিশেষ অনুগ্রহ। তাই মাহে রমজানকে স্বাগত জানাতে ও তার পূর্ণ ফজিলত হাসিল করতে আমরা কিছু প্রস্তুতি নিতে পারি। কেননা পূর্বপ্রস্তুতি ও পরিকল্পনা করে কাজ করলে সহজ, সুন্দর ও সুচারুরূপে কাজ সম্পাদন করা যায় এবং সর্বোচ্চ ফায়েদা অর্জন করা যায়-
১. মানসিক প্রস্ততি
রমজানে সর্বোচ্চ সওয়াব হাসিলের জন্য মনকে পরিপূর্ণরুপে প্রস্তুত করা। নিজের উপর চাপ মনে না করে আনন্দের সাথে রোজা রাখার আগ্রহ তৈরি করা। আমার রোজা আমার কল্যাণের জন্য, এতে আমার লাভ এমন মানসিকতা পোষণ করা। সাথে সাথে রমজানের গুরুত্ব, ফজিলত, মর্যাদার কথা পরষ্পর আলোচনা করা। এতে মনে আগ্রহ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।
২. বেশি বেশি ইস্তেগফার করা
কেউ যদি আগে থেকেই অপরাধী হয়ে থাকে, আল্লাহর নাফারমানিতে লিপ্ত থাকে, নতুন করে আমলের তাওফিক পাওয়া তার জন্য কঠিন। এছাড়াও وَاللَّهُ يُرِيدُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْكُمْ আল্লাহ তা’আলা চান তোমরা তার কাছে তওবা কর-সুরা নিসা ২৭। তাই প্রত্যেকের জন্য উচিত, তওবা-ইস্তেগফার করে গুনাহ থেকে ফিরে আসা এবং নিজেকে ইবাদতের তাওফিক পাওয়ার উপযুক্ত করে তোলা।
৩. শারীরিক প্রস্তুতি
প্রত্যেক ইবাদত আদায়ের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকে। যেমন হজ্জ, যাকাত আদায়ের জন্য অর্থের প্রয়োজন। তেমনি রোজা এমন একটি ইবাদত যা আদায়ের মৌলিক পুঁজি হল সুস্থতা। রোজা রাখতে সারাদিন পানাহার ছাড়া থাকা নিঃসন্দেহে কষ্টের কাজ। তাই রমজানের আগে স্বাস্থ্যের সুষ্ঠু পরিচর্যার বিকল্প নেই। রোজার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করার ইঙ্গিত আমরা হাদীস থেকে পায় إِذَا بَقِيَ نِصْفٌ مِنْ شَعْبَانَ فَلَا تَصُومُوا অর্থ শাবানের পর আর রোজা রেখ না। তিরমিযী -৭৩৮। সুস্থতার সাথে সুন্দরভাবে রোজাগুলো রাখতে প্রয়োজনে আগে থেকই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।
৪. অর্থনৈতিক প্রস্তুতি
সিয়াম পালনকালে যেন আমার অর্থনৈতিক পেরেশানীতে পড়তে না হয় সে জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা। দরকার তো ছিলো সারা বছর অল্প অল্প করে হলেও রমজানের জন্য সঞ্চয় করা। যদি সেটা না করা হয়, তবে কমপক্ষে একমাসের খরচের জন্য একটা ছোট্ট বাজেট প্রণয়ন করতে পারি। নিজের কাছে প্রযোজনীয় অর্থ না থাকলে ঋণ নেয়া যেতে পারে। আল্লাহ তা’আলা ঋণ পরিশোধ সহজ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ।
৫. কাজা রোজা আদায় করা
বিগত রমজানের কোন রোজা কাজা থাকলে এই রমযানের আগেই তা আদায় করা। বিভিন্ন সমস্যা, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে বা মহিলাদের প্রাকৃতিক কারণে রোজা কাজা হয়ে যায়। আজ না কাল রাখবো, গরমকালে না শীতকালে রাখবো, এ জাতীয় অলসতা করে সেগুলো সাধারণত আদায় করা হয়ে ওঠে না। তাই রমজানের আগেই বিগত কাজা রোজাগুলো আদায় করে জিম্মা মুক্ত হয়ে আগত রমজানের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত। হযরত আয়েশা রা. বলেন। ্রكَانَ يَكُونُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ، فَمَا أَسْتَطِيعُ أَنْ أَقْضِيَ إِلَّا فِي شَعْبَان ‘রমজানের যে রোজা আমার কাজা হয়ে যেত তা (রসুল স. এর সাথে ব্যস্ততার কারণে) পরবর্তী শাবান মাস ব্যতিত আদয় করতে পারতাম না’। বুখারী ১৯৫০।
৬. ইবাদতের জন্য ঝামেলা মুক্ত হওয়া
প্রতিটি মানুষের কিছু না কিছু ঝামেলা/পেরেশানী থাকে। বাড়িঘর, জমাজমি, প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরণের ঝামেলা বা ব্যস্ততা থাকতে পারে। রমজান আসার আগেই ঝামেলা মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা এবং ইবাদতের জন্য যথাসম্ভব ফারেগ হয়ে যাওয়া। হাদীস শরীফে আছে, আল্লাহ তা’আলা বলেন يَا ابْنَ آدَمَ تفَرَّغْ لِعِبَادَتِي أَمْلَأْ صَدْرَكَ غِنًى وَأَسُدَّ فَقْرَكَ হে বনি আদম তুমি আমার ইবাদতের জন্য ঝামেলা মুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে সচ্ছলতা দিয়ে ভরে দিবো। তোমার অভাব দূর করে দিবো….।- তিরমিযী-২৪৬৬, ইবনে মাজাহ-৪১০৭।
৭. বিগত রমজানে আমলের ঘাটতির কারণ চিহ্নিত করা
বিগত রমজানে কোন ইবাদতে কি ঘাটতি ছিল তা খুঁজে বের করা। বিগত রমজানে কুরআন তেলাওয়াত, নফল নামায, জিকির বেশি বেশি কেন করতে পারিনি ? কেন মানুষকে ইফতারি করানোসহ দান-সদকাহ বেশি বেশি করা হয়নি ? কেন আমার ইতেকাফ করার সৌভাগ্য হয়নি ? এগুলোর কারণ খুঁজে বের করা এবং এই রমজানে পূর্ব থেকেই তার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া। সাথে সাথে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা-এই রমজানে আমি ওমুক আমল করবোই। এত খতম কুরআন তেলাওয়াত, এই পরিমাণ দান-সদকা, এই পরিমাণ নফল নামায তথা এই পরিমাণ নেকি অবশ্যই আমি অর্জন করবোই।
৮. রোজার মাসআলাগুলো আগে থেকে জেনে নেয়া
জানা না থাকলে কোন কাজই সঠিক ও সুন্দর ভাবে সম্পাদন করা যায় না। মাহে রমজান আসে প্রায় ১বছর ঘুরে, তাই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে রমযানের অনেক কিছুই আমরা ভুলে যাই। সুতরাং রোজার বিধি-নিষেধ, করণীয়-বর্জনীয়, তাৎপর্য-আদব ও প্রয়োজনীয় সব বিষয় গ্রহণযোগ্য কিতাবাদি বা নির্ভরযোগ্য কোন বিজ্ঞ আলেম থেকে জেনে নেয়া উচিত। কিসে রোজা নষ্ট হয়, কিসে রোজার সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়, কিসে মাকরুহ হয়, মহিমান্বিত রমজানের সিয়াম সাধনার পূর্ণতার জন্য এসব বিষয় অবগত থাকা অত্যন্ত জরুরি।
৯. মাহে রমজানের চাঁদ দেখা
মানুষ তার অপেক্ষায় থাকে, যার প্রতি তার মনের টান আর আগ্রহ থাকে। রমজানের তালাশে থাকা রমজানের প্রতি আগ্রহের প্রমাণ বহন করে। রমজানের চাঁদ দেখা একটি সুন্নাত আমল। আজ এই সুন্নাত আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছে। মাহে রমজানকে বরণ করে নিতে চাঁদ দেখার জন্য পশ্চিম আকাশে একটু অনুসন্ধান চালানো উচিত। নতুন চাঁদ দেখে রসুল স. এই দুআ পড়তেন- اللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ وَالْإِيمَانِ، وَالسَّلَامَةِ وَالْإِسْلَامِ، رَبِّي وَرَبُّكَ اللَّهُ -সুনানে দারেমী ১৭৩০।
১০. আল্লাহ কাছে বেশি বেশি দু’আ করা
আমলের তাওফিক পাওয়ার জন্য বেশি বেশি দু’আ করা উচিত। বান্দা যতই চেষ্টা করুক না কেন তাঁর তাওফিক না হলে কোন ইবাদত করা সম্ভব হবে না । আবার তিনি ঘোষণা দিয়েছেন- وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ তোমাদের রব বলেন আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। সুরা আল-মু’মিন-৬০।
মিনতি করে রবকে বলা – আল্লাহ! তোমার রহমত ও ক্ষমার মাসে কত মানুষ সৌভাগ্যশীলদের কাতারে নাম লেখাবে। কত মানুষ ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। কত মানুষ জান্নাতি হয়ে যাবে। আল্লাহ, আমিও যেন সেই সব সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি! তুমি আমাকে তাওফিক দাও। আমাকে সহজ করে দাও।
ভক্তি আর আগ্রহের সাথে পরিকল্পনা ও পূর্ব থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রমজানকে বরণ করলে পূর্ণাঙ্গ বরকত ও পরিপূর্ণ ফজিলত হাসিল করা আমাদের জন্য সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। তাঁর কাছে আমরা সাহায্য চাই। وَاللهُ الْمُوَفِّقُ তিনিই তাওফিক দাতা।
(লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, ইমদাদুল উলূম রশিদিয়া মাদরাসা, ফুলবাড়িগেট, খুলনা)
খুলনা গেজেট/এমএম