খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ শ্রাবণ, ১৪৩১ | ২৭ জুলাই, ২০২৪

Breaking News

  সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহতদের দেখতে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী
  সিন নদীতে প্যারিস অলিম্পিকের জমকালো উদ্বোধন

যশোরেই প্রথম উড়েছিলো বিজয়ের পতাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা। যশোরেই প্রথম উড়েছিলো বিজয়ী বাংলাদেশের রক্ত সূর্য খচিত গাঢ় সবুজ পতাকা। এদিন বিকালে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-মুজিব বাহিনীর বৃহত্তর যশোর জেলার (যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল) উপ-অধিনায়ক রবিউল আলম জানান, ৭১ সালের ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ৬ ডিসেম্বর সকালে ও দুপুরে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের সঙ্গে ভারতীয় নবম পদাতিক ও চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রচণ্ড লড়াই হয়। বিকালেই পাক সেনা অফিসাররা বুঝে যায়, যশোর দুর্গ আর কোনোভাবেই রক্ষা করা সম্ভব নয়।

লে. কর্নেল শামস নিজের ব্রিগেড নিয়ে রাতের আঁধারে গোপনে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যান খুলনার দিকে। এভাবেই একাত্তরে প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা হওয়ার গৌরব অর্জন করে যশোর। ৭ ডিসেম্বর সকালে যুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে যশোর শহরে প্রবেশ করে যৌথবাহিনী। কিন্তু জনমানবশূন্য শহরে কোনো প্রতিরোধের মুখোমুখিই হতে হয়নি যৌথবাহিনীকে।

পরিত্যক্ত ক্যান্টনমেন্টে একজন পাকসেনাও ছিলো না। পাওয়া যায় তাদের ফেলে যাওয়া বিপুল অস্ত্র, গোলা, রসদ। মুক্তিযুদ্ধে যশোর ছিল ৮ নম্বর সেক্টরে। সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর। তার অধীনে ছিলেন- ক্যাপ্টেন আবু ওসমান চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা। এই ফ্রন্টেই ৫ সেপ্টেম্বর প্রাণ উৎসর্গ করেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ। জগন্নাথপুরের এই যুদ্ধটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ এই যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরই পাকিস্তানিদের মনোবল চুরমার হয়ে যায়।

যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতনের পর ৭ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ নিয়াজির অভিমত উদ্ধৃত করে ওই বার্তায় তিনি বলেছিলেন, যশোরের বিপর্যয়ের ফলে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের পতন প্রায় আসন্ন…। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া না গেলে জীবনরক্ষার জন্য বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয়।

দেশের প্রথম শত্রুসেনামুক্ত জেলা শহর যশোরের প্রাণকেন্দ্র টাউন হল মাঠে (মুন্সী মেহেরুল্লাহ ময়দান) বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ১১ ডিসেম্বর। কলকাতা থেকে পাকিস্তানী কূটনীতিকদের ব্যবহৃত ‘শেভারলেট’ গাড়িতে পেট্রাপোল-বেনাপোল হয়ে যশোর আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। হাজার হাজার মুক্তিপাগল মানুষের সামনে বক্তৃতা করেন তাজউদ্দিন আহমেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এই দুই নেতার সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন- জহির রায়হান, এমআর আকতার মুকুল, সংসদ সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার, অ্যাডভোকেট রওশন আলী, তবিবর রহমান, খান টিপু সুলতান প্রমুখ।

২০ নভেম্বর ১৯৭১ ইদের দিন সকালে যশোরের চৌগাছার জগন্নাথপুরের মানুষ তৈরি হচ্ছে তাদের বড় উৎসব ইদ উদযাপন করতে। এমনই এক সময়ে হানাদার পাকবাহিনীর ২০-২৫টি গাড়ি ঢোকে জগন্নাথপুর (বর্তমানে মুক্তিনগর) গ্রামে। নামাজ পড়বে, মিষ্টিমুখ করবে কি, বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাখির মতো লুটিয়ে পড়ছে মানুষ। বর্বর পাঞ্জাবি সেনারা দেখা মাত্রই গুলি চালাতে থাকে। একদিনেই তারা হত্যা করে ৩০ জনকে; যাদের সবাই নিরীহ, গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। সংসদ সদস্য মশিউর রহমানের ভাই আতিয়ার রহমানসহ আরও দু’জনকে ধরে এনে পুড়িয়ে মারে ওই দানবরা।

বাড়ির পর বাড়ি আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করে দিল। অসহায় মানুষ তাদের প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিক পারল, পালাল। এরপরও কিছু মানুষ বাপ-দাদার ভিটে আঁকড়ে পড়েছিল। সন্ধ্যায় ছদ্মবেশধারী চার মুক্তিযোদ্ধা এসে তাদেরও অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।

বললেন, রাতে বড় ধরনের যুদ্ধ হবে। জনমানবশূন্য নীরব নিস্তব্ধ জগন্নাথপুর গ্রাম সহসাই প্রকম্পিত হয়ে উঠে গোলাগুলির শব্দে। শুরু হয় ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। মেশিনগান, কামান, ট্যাংক, মর্টার, বিমানথ শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিও। মুক্তি আর মিত্রবাহিনী অবস্থান নেয় জগন্নাথপুর গ্রামের চাড়ালের বাগানে। ট্যাংক বহর নিয়ে পাকবাহিনী গ্রামে ঢোকামাত্রই তাদের সাতটি ট্যাংক ধ্বংস করে দেয় মিত্রবাহিনী।

প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দের সঙ্গে হাজারো সৈন্যের গগনবিদারী চিৎকার, আর চেঁচামেচি। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলায় গুলি তখন শেষের দিকে। দু’পক্ষই চলে আসে কাছাকাছি, একশ’ গজের মধ্যে। জগন্নাথপুর স্কুল মাঠে শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে এই তাণ্ডব।

এ সময় পাকবাহিনীর দুটি বিমান তাদের সৈন্যদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। একটি বিমান গুলি করে ভূপাতিত করে মিত্রবাহিনী। অপরটি যশোর ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যায়। ২২ নভেম্বর আবারও বিমান হামলা চালায় পাকবাহিনী। মিত্রবাহিনীও পাল্টা বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানের তিনটি স্যাবর জেট জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করে। ধ্বংস করে আরও সাতটি ট্যাংক ও বহু সাঁজোয়া গাড়ি। পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকবাহিনী। মিত্রবাহিনী শক্ত ঘাঁটি গাড়ে জগন্নাথপুরে।

এই যুদ্ধে দুই পক্ষের সহস্রাধিক সৈন্যও মারা যায়। জগন্নাথপুরের এই যুদ্ধটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ এই যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরই পাকিস্তানিদের মনোবল চুরমার হয়ে যায়।

যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতনের পর ৭ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ নিয়াজির অভিমত উদ্ধৃত করে ওই বার্তায় তিনি বলেছিলেন, ‘যশোরের বিপর্যয়ের ফলে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের পতন প্রায় আসন্ন…। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া না গেলে জীবনরক্ষার জন্য বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয়।

৩১ মার্চ নড়াইল থেকে হাজার হাজার লোকের এক বিশাল মিছিল শহরে আসে। শহরবাসীর সাহায্যে সশস্ত্র মিছিলটি হামলা চালায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। মুক্তি পায় সব রাজবন্দী। এর আগে ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে।
পাকবাহিনীর সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ অনেকেই এখানে শহীদ হন। জুলাই মাস থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহর ও অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাতে থাকে। যশোর মুক্তিযুদ্ধের ৮নং রণাঙ্গন। কমান্ডার ছিলেন তদানীন্তন মেজর মঞ্জুর।

অন্যদিকে পাকবাহিনীর মোতায়েন ছিলো ১০৭নং ব্রিগেড। এর কমান্ডার ছিলেন বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান। যশোর সেনানিবাস থেকে শত্রুবাহিনী ৬টি জেলা নিয়ন্ত্রণ করতো। ২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলে অভিযান শুরু করে। পাকবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের শক্তিশালী ঘাঁটি চৌগাছা ঘিরে ফেলে সম্মিলিত বাহিনী।

মিত্রবাহিনীর গোলার আওতায় আসে যশোর সেনানিবাস। এভাবেই ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলার মাটিতে প্রথম স্বাধীন জেলা হিসাবে গৌরক ও কৃতিত্বর সাথে দাড়িয়ে আছে ব্রিটিশ আমলের ঐতিহ্যের যশোর।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!