খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ পৌষ, ১৪৩১ | ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  চাঁদপুরে মালবাহী জাহাজ থেকে ৬ মরদেহ উদ্ধার ; মুমূর্ষু ২
  ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

করোনা : ক্রেতাশুণ্য শার্শা গরুর হাট

বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি

মহামারি করোনাভাইরাস এবার সর্বশান্ত করে দিয়েছে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া সাতমাইল পশু হাটের ইজারাদারসহ হাট সংশ্লিষ্ট কয়েকশ মানুষকে। করোনার আগে প্রতি হাটে ৫ হাজার পশু কেনাবেচা হলেও এখন তা ১০০ থেকে ১৫০ এ নেমে এসেছে। হাটে নেই ক্রেতা। চার কোটি ৯০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে হাট ইজারা নিয়ে এখন ভয়ানক আর্থিক ক্ষতির মুখে রয়েছেন ইজারাদার।

মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে তিন মাস বন্ধ থাকার পর সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে পশুর হাট খোলা রাখলেও ক্রেতা বিক্রেতার অভাবে এখন লগ্নির টাকা কীভাবে পাবেন-এই চিন্তায় দিশেহারা ইজারাদার। এই পরিস্থিতিতে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হাটের ইজারা মূল্য ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন ইজারাদার ও খামারিরা।

শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া পশু হাটের ইজারাদার নাজমুল হাসান বলেন, ‘করোনাভাইরাস আমাদেরকে সর্বশান্ত করে দিয়েছে। আগে প্রতি হাটে অন্তত ৫ হাজার পশু বেচাকেনা হলেও এখন তা দাঁড়িয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ এ। প্রতি হাটে খরচ ৫০ হাজার টাকা ধরে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায় হলে বছর শেষে হাট ডাকের (ইজারার) মূল টাকা তোলা সম্ভব। অথচ গত দুই সপ্তাহে চার হাটে উঠেছে যথাক্রমে ৩৮ হাজার, ৫৯ হাজার, এক লাখ ও এক লাখ ১৮ হাজার টাকা। মোট তিন লাখ ১৫ হাজার টাকা আদায় হয়েছে।’

তিনি আর ও বলেন, ‘১০ বছর ধরে গরু হাট চালাচ্ছি, এরকম অবস্থাতে কখনও পড়িনি। দুই ঈদের আগে একমাস ধরে হাটে সর্বোচ্চ বেচাকেনা হয়। একটা ঈদ গেল, করোনায় তখন হাট বন্ধ ছিল। আর এখন হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা নেই। এই অবস্থা চলতে থাকলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার কোনো গতি নেই।’

শনি ও মঙ্গলবার সপ্তাহে দু’দিন এই হাট বসে। যে হাটে জমজমাট পশু কেনাবেচা হতো করোনার থাবায় এখন এই হাটটি প্রায় পশুশূন্য। যশোর জেলা শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের পাশে বসে জেলার বৃহৎ বাগআঁচড়া সাতমাইলের এই হাট। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে এই হাটে থেকে গরু কিনে নিয়ে যান।

যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, ঝিনাইদাহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে বিক্রির জন্য পশু আনা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যাপারীরা এই হাট থেকে পশু কিনে নিয়ে যান।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘করোনায় হাট বন্ধ ছিল, তাই পশু হাটের সঙ্গে জীবিকা নির্ভরশীল কয়েক হাজার মানুষ পুরোপুরি কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ইদানীং হাট চালু করা হলেও ক্রেতা বিক্রেতার অভাবে হাট জমজমাট হচ্ছে না।’

পশুর হাটে কথা হয় সিলেটের ব্যাপারি আওয়াল ও ঢাকার আবু তাহেরের সঙ্গে। আওয়াল প্রতি হাটে অন্তত পাঁচ ট্রাক গরু কিনলেও গত মঙ্গলবার তিনি মাত্র এক ট্রাক গরু কিনেছেন বলে জানান। করোনার কারণে এবার বিভিন্ন এলাকায় পশুর চাহিদা কম। দামও তুলনামূলক অনেক কম। তবে পরিবহন খরচটা আগের চেয়ে বেশি।

অপর ব্যবসায়ী আবু তাহের বলেন, ‘ব্যবসায় এখন ভাটা চলছে। গরু কিনে হাটে নিয়ে বিক্রি করতে না পারলে পুঁজি হারাতে হবে, তাই সাহস করে গরু কিনতে পারছি না।’

সামটা গ্রামের মাছুম বিল্লাহ গরুর খামার করে এখন বেকায়দায় পড়েছেন। ঈদুল ফিতরের সময় তার ১২টা গরুর মধ্যে অন্তত ১০টা বিক্রির আশা ছিল। করোনায় হাট বন্ধ ছিল, তাই একটিও বিক্রি করতে পারেননি। মাছুম আর ও বলেন, ‘গরু নিয়ে পড়েছি মহা বিপদে। এখন হাটে নিয়ে এসেছি। ব্যাপারী আসছে না, তাই গরুও বিক্রি করতে পারছিনা। ব্যবসার সব টাকা গরুর খাদ্যের জোগান দিতে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন পশুখাদ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছি।’

হাট কমিটির সদস্য আবু তালেব বলেন, ‘হাটে গরু বেচাবিক্রি নেই। বাইরের পার্টি না আসলে গরু কিনবে কে ? ব্যাপারী না আসায় অনেক খেতোয়াল (খামারি) খরচ খরচা করে গরু হাটে আনছে না। দায় ঠেকে কিছু খেতোয়াল হাটে গরু তুলেছে, কিন্তু দাম পাচ্ছে না বলে ছাড়ছে না।’ তবে ঈদ আসার আগে কিছু গরু হাটে উঠবে বলে জানান অনেকে।

হাটে হাটে পশু বেচাকেনায় সম্পৃক্ত পশু ব্যবসায়ী সাতমাইলের মন্টু মিয়া, আনসার আলী ও সোহরাব হোসেন জানান, তারা এক হাট থেকে পশু কিনে অন্য অন্য হাটে বিক্রি করেন। হঠাৎ করেই হাট বন্ধের পর আগেই কেনা পশু নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন তারা। এগুলো বিক্রি করতে পারছেন না।
সোহরাব হোসেন বলেন, ‘করোনায় নিজের সংসারের খাদ্যের জোগান দিতে গিয়ে যেখানে হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে পশুখাদ্য কিনব কীভাবে? ওদের খাদ্য দিতে না পারলে আবার দামও পাওয়া যাবে না। পড়েছি উভয় সংকটে। করোনার ভয়ে হাটে ব্যাপারী আসছে না। তাই বেচাবিক্রি ও নেই।’

হাট কমিটির সহ-সভাপতি ইয়াকুব হোসেন বিশ্বাস বলেন, ‘কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ অন্তত ২০টি জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যাপারীরা আসেন এ হাটে। করোনায় তিন মাস ধরে হাট বন্ধ, এখন খোলা থাকলেও হাটে নামমাত্র পশু উঠছে, বেচাকেনা নেই, পুঁজিও হারিয়ে যাচ্ছে। হাটের খরচের টাকা দিয়ে যা পাচ্ছি তাতে কয়েক বছরেও লগ্নি করা টাকা তোলা সম্ভব নয়।’

হাট কমিটির সভাপতি বাগআঁচড়া ইউপি চেয়ারম্যান ইলিয়াছ কবির বকুল বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সব ধরনের নিরাপত্তা পায় বলেই হাটটি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এলাকার তিন হাজার উপকারভোগী হাটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ব্যবসায়ীদের থাকা খাওয়াসহ নিরাপত্তা, পশুখাদ্য সরবরাহ, ট্রাক বন্দোবস্ত ও হাটের শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে জড়িয়ে থাকার মাধ্যমে এদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়। কিন্তু তিন মাস তারা কর্মহীন। মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।’

হাটের শুরু হয় বৈশাখ মাসে আর শেষ হয় চৈত্র মাসে। প্রতি বছর ১০০টি হাট পাওয়া যায়। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় তিনটি মাস শেষ হচ্ছে। আয় হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। সপ্তাহে ১০ লাখ টাকা আয় হলে তবে আসল টাকা তোলা সম্ভব। করোনার কারণে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে এখন সবাই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। সরকারি সহযোগিতা না পেলে হাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পথে বসতে হবে। বিষয়টি বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কুমার মন্ডল বলেন, ‘পশুহাট সংশ্লিষ্টদের আবেদন পেয়েছি, কিন্তু আমাদের তো বিবেচনার সুযোগ নেই। এটা হাট ইজারা কমিটির বিষয়। আবেদনটা সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে, সরকার বিবেচনা করলে আমরা সেটার বাস্তবায়ন করব। ওনাদের ক্ষতি হচ্ছে সেটা তো আমরা বুঝছি। তবে দেশ করোনা বিপদমুক্ত হলে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত সব সেক্টরের পাশে দাঁড়াবে সরকার।”সীমান্তের অবৈধপথে এবার ভারতীয় গরু না আসায় বাজারে দেশীয় গরু দেখা যাচ্ছে। তবে করনোর কারনে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় অনেকে কুরবানী দিতে পারবে না। সেই হিসাবে বাজারে ক্রেতা কম এবং গরুর দাম ও তুলনামূলক অনেক কম।ঈদের সামনে আর ও কিছু দিন বাকি আছে। কিছু কেনা বেচা হয়তো বাড়বে।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!