খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

কম্বোডিয়া মিশনে প্রথম ধাক্কা

এ এম কামরুল ইসলাম

কম্বোডিয়া মিশনে পৌঁছে প্রথমেই একটা মহা ধাক্কায় পড়লাম। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পুলিশ সদস্যদের কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন শহরের বিভিন্ন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে জাতিসংঘ Movecon (Movement Control) বিভাগের লোকজন আমাদেরকে রিসিভ করে গাড়িযোগে হোটেলে নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত নমপেন শহরের তখনকার অবস্থা ছিল ভয়াবহ। সেখানে থাকা খাওয়ার মতো তেমন ভাল হোটেল খুব একটা ছিল না। আমাদের থাকার জায়গা হলো Thaisun নামক একটি হোটেলে। সেখানে প্রতি রুমে অতিরিক্ত বেড বসিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ থাকার ব্যবস্থা করলেও খাবার তেমন কোন সুব্যবস্থা ছিল না। তবে দু-এক দিনের মধ্যে আমাদের লোকজন খাবার হোটেল খুঁজে বের করেছিল। আমাদের থাকার হোটেলের অনতিদূরে হোটেল Malachi বলে একটি খাবার হোটেলে তিন বেলা খাবার ব্যবস্থা হয়ে গেল। জাতিসংঘের বিভিন্ন নিয়ম কানুন জানাতে ও আমাদের বিভিন্ন প্রদেশে পোস্টিং দিতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগলো। আমরা সবাই বাংলাদেশ থেকে কিছু কিছু ডলার নিয়ে গিয়েছিলাম। কেউ কেউ নমপেন এয়ারপোর্টে নেমে ডলার দিয়ে কম্বোডিয়ার রিয়েল কিনে নিয়েছিল। এয়ারপোর্টে নেমে এক ডলার দিয়ে ৮০০/৯০০ রিয়েল পেয়ে অনেকেই পকেটের সব ডলার ভাঙিয়ে রিয়েল কিনে নেয়। আমি মাত্র ১০০ ডলার ভাঙিয়ে রিয়েল কিনেছিলাম। পরবর্তীতে হোটেলে গিয়ে দেখলাম সেখানে ডলারের দাম আরো বেশি।

বেশ কয়েকদিন হোটেলে থেকে কম্বোডিয়ার খাবার খেতে খেতে দেশীয় খাবারের জন্য মনটা ছটফট করতে লাগলো। তাই একদিন আমার একই রুমে বসবাসরত বন্ধু আনোয়ারের পরামর্শে লাগেজ থেকে ডাল, মসলা ও প্রেসার কুকার বের করে হোটেলের রুমের ভিতরে রান্না শুরু করে দিলাম। বাংলাদেশের ডাল রান্নার ঘ্রাণ সারা হোটেলে ছড়িয়ে পড়লো। সাথে সাথে আমাদের রুমে ভীড় জমে গেল। আমাদের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ডিআইজি জনাব শাহুদুল হক সাহেবের রুম থেকেও একটা বাটি পাঠিয়ে ডালের চাহিদা এলো। সবার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের খাবার জন্য তেমন ডাল অবশিষ্ট রইলো না। অতএব রাতেরবেলা আবার ডাল রান্নার ধুম পড়ে গেল। অনেকের রুম থেকে ডালের ঘ্রাণ বের হতে শুরু করলো।

হোটেলে থাকাকালীন আমরা বাংলাদেশে ফোন করার চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু সেখানকার টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। তবুও অনেক চেষ্টা করে হোটেলের মালিকের টেলিফোন থেকে মাঝে মাঝে ফোন করতাম। প্রতি মিনিটে ৫ ডলারের বিনিময়ে কল করা সবার পক্ষে সম্ভব হতো না। কারণ তখনও আমাদের বেতন হাতে এসে পৌঁছেনি।

একদিন ইন্সপেক্টর হালিম সাহেব বললেন, তার ভাইয়ের অফিসে ফ্যাক্স আছে। তিনি ও আমি খুলনার মানুষ হওয়ায় আমাদের দুই জনের সম্পর্ক অনেক ভাল ছিল। তাই ঠিক করলাম তার ভাইকে ফ্যাক্স করে আমাদের কুশল জানাই। কিন্তু তখন ফ্যাক্স কিভাবে করতে হয় তা আমাদের কারো জানা ছিল না। এমনকি বাংলায় লিখলে ফ্যাক্স হবে কিনা তাও জানা ছিল না। তাই একটা সাদা কাগজে ইংরেজিতে আমাদের কুশল জানিয়ে হালিম সাহেবের ভাইয়ের নম্বরটা হোটেলের ম্যানেজারকে দিলাম। তিনি ১০ ডলারের বিনিময়ে ফ্যাক্স পাঠাতে সম্মত হলেন। ঐ ফ্যাক্সের এক কোনায় লিখে দিলাম, Kamrul is fine. Let it inform to his brother Harun. কিন্তু আমাদের ১০ ডলার খরচ হলেও ঐ ফ্যাক্সের কোন উত্তর এলো না।

নমপেনে কয়েকদিন প্রশিক্ষণ ও অফিসিয়াল কাজ শেষে আমাদের বিভিন্ন প্রদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। প্রত্যেক প্রদেশের জন্য একজনকে টীম লিডার নিযুক্ত করা হলো। আমাদের ১২ জনের পোস্টিং হলো সিয়ামরিয়েপ প্রদেশে। টীম লিডার হলেন এডিশনাল এসপি জনাব নাজমুল হক সাহেব।

এর আগে বাংলাদেশ থেকে আমাদের সাথে আগত ৭৫ জনের মধ্যে প্রায় সকলেই কম্বোডিয়ার জাতিসংঘের নিযুক্ত (এমটিও) মোটর ট্রান্সপোর্ট অফিসারের কাছে ড্রাইভিং টেষ্ট দিয়ে ফেল করেছিল। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল নতুন। আমি নিজেও আমার ড্রাইভিং নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম। তাই আমি পরীক্ষায় হাজির হইনি। এদিকে আমরা যে ১২ জন সিয়ামরিয়েপ প্রদেশে পোস্টিং হয়েছিলাম তাদের কেউ ড্রাইভিং পরীক্ষায় পাশ না করায় সকলেই ভীষণ চিন্তিত ছিলাম। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল, অথচ ড্রাইভিং না জানা বাংলাদেশ পুলিশের জন্য জাতিসংঘ মিশনে প্রথম বড় ধাক্কা এবং লজ্জাজনক ছিল। পরবর্তী মিশনে এসব সমস্যা আর তেমন দেখা যায়নি।

সিয়ামরিয়েপ প্রদেশে পোস্টিং হওয়ায় আমাদের মধ্যে অনেকে ভীষণ ভেঙে পড়লো। এমনকি কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলো। কারণ ইতিমধ্যে কম্বোডিয়ার বিভিন্ন এলাকা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার ফলে দেশটির কোথায় কেমন অবস্থা তা প্রায় সকলের জানা হয়ে গিয়েছিল। সিয়ামরিয়েপ প্রদেশটি কম্বোডিয়ার ঐতিহ্যবাহী এলাকা হওয়ায় সেখানকার দখল নিয়ে খেমারুজ বাহিনী ও অন্যান্যদের সাথে গেরিলা যুদ্ধ তখনও চলছিল। সবকিছু জানার পর সেখানে পোস্টিং হবার পর একটু মন খারাপ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

যাহোক, সবাই পোস্টিং পেয়ে যে যার নির্ধারিত প্রদেশে রওনা হলো। আমাদের পোস্টিং সিয়ামরিয়েপ প্রদেশ নমপেন থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় আমাদের জন্য বিমানযোগে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। যাবার আগে জাতিসংঘের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কয়েক বস্তা ঔষধ আমাদের ১২ জনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হলো। তার মধ্যে অধিকাংশ ছিল ম্যালেরিয়া জ্বরের ঔষধ।

দুরুদুরু বুকে কেউ কেউ চোখ মুছতে মুছতে এয়ারপোর্টে হাজির হলাম। কিন্তু এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখলাম সেই ঔষধের বস্তা আনা হয়নি। সবাই বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। এক পর্যায়ে এয়ারপোর্টে সবাইকে রেখে আমাকেই হোটেলে গিয়ে ঔষধের বস্তা আনার দায়িত্ব নিতে হলো। অন্য কেউ ঝুঁকি নিতে রাজি হলো না।

এয়ারপোর্টে থাকা জাতিসংঘের একজন ড্রাইভারকে কোনমতে রাজি করিয়ে হোটেলের দিকে রওয়ানা হলাম। কিন্তু ড্রাইভার জানালেন সকাল ন’টায় একজনকে অফিসে নামিয়ে দেওয়া তার ডিউটি। সেটা আগে করতে হবে। আমাদের প্লেনের টাইমের কথা চিন্তা না করে, আল্লাহর উপর ভরসা করে আমি তাতেই রাজি হলাম।

কম্বোডিয়ান ড্রাইভার আমাকে নিয়ে তার ডিউটি পালন করতে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগে সংশ্লিষ্ট অফিসারের বাসার সামনে হাজির হলেন। তাঁকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে তারপর হোটেল থেকে ঔষধের বস্তা নিয়ে আমাকে এয়ারপোর্টে নামাতে হবে। আমার পৌঁছাতে দেরি হলে আমাকে রেখে প্লেন ছেড়ে দেবে। নতুন পরিবেশে নিজেকে বেশ অসহায় মনে হচ্ছিল। তাই ড্রাইভারকে বললাম, আপনি হর্ণ বাজালে হয়তো আপনার অফিসার একটু তাড়াতাড়ি বের হবেন। নইলে আমার প্লেন ছেড়ে চলে গেলে আমি বিপদে পড়বো।

ড্রাইভার সাহেব হর্ণ বাজাতে রাজি ছিলেন না, তবুও আমার অনুরোধে সামান্য হর্ণ বাজালেন। মূহুর্তের মধ্যে অগ্নিশর্মা হয়ে একজন কুচকুচে কালো আমেরিকান মহিলা ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে ড্রাইভার সাহেবকে ধমক দিতে শুরু করলেন। কারণ হর্ণ বাজানোর ফলে তিনি অপমান বোধ করেছিলেন। তিনি ড্রাইভারকে বললেন, আমার বের হবার এখনও পাঁচ মিনিট বাকী আছে। তুমি হর্ণ বাজিয়ে প্রমাণ করেছো, আমার সময় জ্ঞান নেই। আমি তোমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিবো।

ড্রাইভার সাহেব বার বার ‘সরি’ বললেও মহিলা খুব বেশি অপমান বোধ করছিলেন। আমি আমার কাঁধে সকল দোষ নিয়ে তাঁকে বার বার বুঝাতে চাইলাম – আমার এয়ারপোর্টে যাবার কথা। কিন্তু কোনভাবে তাঁর রাগ কমে না। কারণ, তিনি মনে করেছিলেন ড্রাইভার তাঁকে সময়জ্ঞানহীন মনে করেছে। কেন পাঁচ মিনিট আগে তাঁকে ঘর থেকে বের হতে বাধ্য করা হলো।

অবশেষে সেই পাঁচ মিনিট পার করেই তিনি গাড়িতে উঠলেন। তাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে হোটেল থেকে ঔষধের বস্তা নিয়ে আমি এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখি, প্লেন টেকঅফের অপেক্ষায় আমাকে খোঁজাখুজি করছে। শেষ মূহুর্তে আমি দৌঁড়ে গিয়ে প্লেনে উঠলাম।

আনন্দ

জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বহুজাতিক পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার সাথে পরিচিত হতে শুরু করলাম।

সময় সম্বন্ধে সেই আমেরিকান কালো মহিলার কাছ থেকে শিক্ষা নিলাম।

বেদনা

হোটেলে ঔষধ ফেলে গিয়ে তা এয়ারপোর্টে আনার জন্য আমাকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। অজানা অচেনা জায়গায় সেটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু সেজন্য আমাদের টীমের কেউ আমাকে সামান্য ধন্যবাদও দেয়নি। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!