বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দু’জন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হঠাৎ করে একই সাথে দাবি জানিয়েছেন যে মো. সাহাবুদ্দিন “চুপ্পুকে অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অপসারণ করতে হবে”।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনার দাবি সমন্বয়কদের নতুন না। দেখা গেছে, এর আগেও সমন্বয়করা দাবি তোলার পর বিভিন্ন পদে পরিবর্তন আসতে দেখা গেছে।
সরকার এবারও তাদের দাবি মেনে নিয়ে রাষ্ট্রপতি অপসারণের পথে হাঁটবে কি?
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলো বিবিসি বাংলা। তবে তিনি বলেছেন, তিনি “এখনই” এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না।
রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবি কেন?
মুলত, গতকাল তেসরা অক্টোবর দুপুরে সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল থেকে একটি পোস্টে সর্বপ্রথম এ দাবির কথা জানান। তার কয়েক ঘণ্টা পর সমন্বয় সারজিস আলমও তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল থেকে একই কথা লিখে পোস্ট করেন।
এরপর-ই এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
তাদের দু’জনের পোস্টেই মোট পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বাইরে বাকি চার দাবিগুলো হল– ‘আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিতকরণ, নতুন সংবিধান গঠন, আওয়ামী দুর্নীতিবাজ আমলাদের পরিবর্তন ও হাসিনার আমলে করা সব অবৈধ চুক্তি বাতিল।’
ঠিক কী কী কারণে তারা হঠাৎ করে এসব দাবি, বিশেষ করে রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবি তুলেছেন, এ বিষয়ে জানতে শুক্রবার দিনভর উভয়ের সাথেই একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কেউই কোনও সাড়া দেননি।
পরবর্তীতে এক পর্যায়ে কথা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদের সাথে। তিনি জানান, তারা সকলেই ওই দাবির সাথে একমত।
সেক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আসলে ঠিক কী কারণে রাষ্ট্রপতির অপসারণ চাচ্ছেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হইছে। তাই, ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্ধারিত রাষ্ট্রপতি থাকলে তা যে কোনও সময় রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে।”
“এই কারণে আমরা মনে করি, ওনাকে সহজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্ব-সম্মানে কিভাবে বিদায় দেওয়া যায়, সেদিকটা নিয়ে ভাবা উচিৎ। উনি ফ্যাসিজমের একটি সিম্বল। সেই সিম্বলটা থাকা উচিৎ না।”
বর্তমান রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে সবার কাছে “গ্রহণযোগ্য” ও “দেশপ্রেমিক” রাষ্ট্রপতি চান তারা।
হাসিনা সরকার পতনের প্রায় দুই মাস পর কেন এখন এই দাবি তুলছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর আগেও তারা বলেছিলেন। তবে এখন তারা জোরালোভাবে বলছেন।
কোন প্রক্রিয়ায় অপসারণ করা হবে?
এখন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দাবি মেনে সরকার যদি সত্যিই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে চায়, তবে তারা কোন পথ অবলম্বন করবে?
আইনজীবীরা বলছেন, এই মুহূর্তে সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়াবে। কারণ এই সরকারের আইনগত বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন আছে।
সংবিধান অনুযায়ী সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে হয়। বাংলায় যাকে বলে অভিশংসন।
একাধিক সিনিয়র আইনজীবী মন্তব্য করেছেন অভিশংসনের জন্য “সংসদ লাগবেই”।
তবে রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে তখন আর সংসদ লাগবে না, জানিয়েছেন তারা।
এখন, রাষ্ট্রপতি যদি পদত্যাগ করেন, তখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব কে পালন করবেন?
এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা মৃত্যুজনিত কারণে পদ শূন্য হয়, তখন স্পিকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্পিকার-সংসদ কোনোটাই নাই।
সেইসাথে, স্পিকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলে পরবর্তী ৯০ দিনের মাঝে “ওই সংসদ দ্বারাই নতুন রাষ্ট্রপতি” নির্বাচন করতে হবে। “অতএব, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের জন্য বৈধ কোনও পন্থা নাই।”
তাহলে বর্তমান সরকার রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারবে কিনা এবং পারলে তা কীভাবে, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “সংবিধান অনুযায়ী ওই সুযোগ নাই। রাষ্ট্রপতি এখন স্বেচ্ছায় বা কারও কথা চলে যেতে পারেন।”
“কারও কথায় যাওয়া অসম্ভব কিছু না। ক্ষমতায় যারা আছেন, তারা বললেই চলে যাবে। সেনাবাহিনী ও সরকার চাইলে এক সেকেন্ডের ব্যাপার,” বলছিলেন তিনি।
“আর এখানে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে চিন্তা করার দরকার নাই। কারণ ফর্মেশন অব গভর্নমেন্ট-ই তো লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মাঝে না। কাজেই, ওই সুযোগ নাই। এখানে যা হবে, এমনিতে হবে। তবে এগুলোকে পরবর্তীতে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মাঝে অনুমতি দিতে হবে।”
এ প্রসঙ্গে কথা হয় ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক ও সিনিয়র আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুমের সাথেও। তিনিও বলেন, “এখন অস্বাভাবিক সরকার কাজ করছে, তাই সংবিধানের মাঝ দিয়ে বৈধতা অবৈধতা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে খুঁজে পাওয়া কঠিন।”
“তবে সেটাও তারা কাভার করার জন্য আপিল বিভাগ থেকে একটি রেফারেন্স করে নিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত তারা সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে চলার চেষ্টা করছেন। যা সঙ্গতিপূর্ণ না, সেগুলো রেফারেন্সের মাধ্যমে। তাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পদ্ধতি কী হবে, সেটার জন্য তাদেরকে এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে রেফারেন্স নিতে হবে।”
“সেই রেফারেন্স অনুয়ায়ী তারা একজনকে বাদ বা নতুন একজনকে নিয়োগ দিতে পারেন। বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় এছাড়া আর কোনও ব্যবস্থা নাই,” তিনি যোগ করেন।
তবে আপিল বিভাগের এই রেফারেন্স বা সুপারিশ পদ্ধতি নিয়ে নাম প্রকাশ না করতে চেয়ে প্রশ্ন তোলেন একজন সিনিয়র আইনজীবী। তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙ্গে দিয়েছিলো, সেই ক্ষমতাই রাষ্ট্রপতির নাই। সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর লিখিত উপদেশক্রমে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙ্গে দিতে পারে। শেখ হাসিনা যাওয়ার আগে সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার কথা বলেছে বলে তো কেউ শুনিনি”।
“যে বিষয়ে সংবিধানে কোনও বিধান বলা নাই, সেখানে আপীল বিভাগের পরামর্শ নিতে পারে। যেখানে স্পষ্ট বলা আছে, সেখানে অভিমত নেওয়ার কোনও প্রশ্ন আসে না,” তিনি আরও বলেন।
আপিল বিভাগের এই রেফারেন্স প্রসঙ্গে বলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাও।
যেহেতু স্পিকার-সংসদ নেই, তাই তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো যে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব কে গ্রহণ করবে? তখন তিনি জানান, “স্পিকারও না থাকলে ইনচার্জ থাকেন প্রধান বিচারপতি।”
“প্রধান বিচারপতিকে অফার করতেই হবে। যদি না করে, সেটা হবে আরেকটা ইলিগ্যাল কাজ।”
যেসব দাবি আগেও মানা হয়েছে
চলতি বছরে জুন মাস থেকে মোটা দাগে মোটা দাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। তখন তারা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি উত্থাপন করেছিলো।
এরপর নানা চড়াই-উৎড়াইয়ের মাঝ দিয়ে সমন্বয়কদের নেতৃত্বে আন্দোলন ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় জাতীয় আন্দোলনে।
শেষদিকে তাদের মূল দাবি হয়– আওয়ামী লীগ সরকার পতন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যায়।
এরপর মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সমন্বয়কদের দাবি বা ইচ্ছা অনুযায়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সরকার গঠনের পর থেকে দেখা যাচ্ছে, সমন্বয়কদের দাবি অনুযায়ী প্রশাসনে অনেক রদবদল হচ্ছে।
এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হল বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগ। ইউনূস সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের দু’দিন পর গত ১০ই অগাস্ট আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ, এই দুই বিভাগের সকল বিচারপতির অংশগ্রহণে ‘ফুল কোর্ট সভা’ ডেকেছিলেন তিনি।
তবে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রবল প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে সেই সভা বাতিল করা হয়। তখন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে “ফ্যাসিবাদের দোসর” আখ্যায়িত করে পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম দেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, যিনি বর্তমানে সরকারের একজন উপদেষ্টাও।
পরবর্তী ওই দিনই সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের আরও পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন এবং সেদিন রাতেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
সরকার গঠনের পরপর এটিই ছিল প্রশাসনের সবচেয়ে বড় রদবদল। এরপর একে একে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদত্যাগ শুরু করেন।
এছাড়া, বর্তমান সরকারের যাত্রার শুরুতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হওয়ার পর গত ১২ই অগাস্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়া আওয়ামী লীগকে ‘গণ্ডগোল না পাকিয়ে নতুন মুখ নিয়ে দল গোছানোর’ ও দলের সভাপতি ‘শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরার’ পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ওই বক্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
সেসময় সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত একটি সমাবেশে বলেন, “খুনিদের পুনর্বাসনের বিষয়ে সতর্ক করে দিতে চাই, আমরা যেভাবে স্বৈরাচারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছি, ঠিক একইভাবে স্বৈরাচার পুনর্বাসনের চেষ্টাকারীদেরও নামাতে সময় লাগবে না।”
এর ঠিক চারদিনের মাথায় মি. হোসেনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নতুন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
এছাড়া প্রশাসনে বিভিন্ন রদবদলের বিষয়েও নানা সময় দাবি বা আপত্তি জানিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
খুলনা গেজেট/এনএম