শুক্রবার পবিত্র ঈদুল ফিতর। একমাস সিয়াম সাধনার পর খুশির ঈদ আমাদের নিকট সমাগত। মুসলমানদের সর্ববৃহৎ উৎসবের দিন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। আমি যখন অনার্সের ছাত্র তখন থেকে খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করি। কিন্তু গত দু’বছর করোনার কারণে সে সুযোগ আর হয়ে উঠছে না। অপেক্ষায় আছি আবারও সার্কিট হাউস মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার।
আমি যখন স্কুলের ছাত্র, তখন প্রতি বছর ঈদ করতে কখনো দাদার সাথে আবার কখনো নানার সাথে গ্রামে যেতাম। আব্বার চাকরির সুবাদে আমরা খুলনার জংশনে অবস্থিত সিএসডি কোয়ার্টারে থাকতাম। তখন গ্রামের বাড়ি চাঁদখালী ও দরগাহপুর যাওয়ার একমাত্র বাহন ছিল লঞ্চ। লঞ্চের নাম ছিল সফিনা বাংলা, গুলিস্তান ও সাবিস্তান। দুপুর একটা এবং রাত দশটায় দুটি লঞ্চ ছাড়তো। ৪ নম্বর ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে নতুনবাজার ঘাট হয়ে যেতে হতো। দুপুর একটায় রওয়ানা হয়ে আমাদের গ্রামে পৌঁছাতে রাত আটটা বাজতো। কিন্তু আমার কাছে মনে হতো কখন পৌঁছাবো। এক এক মিনিটকে এক এক ঘন্টা মনে হতো। রাতে গ্রামে পৌঁছায়ে ঘাটের কাদা ভেংগে বাড়ি যেয়ে সেকি আনন্দ, যা আজ বিলীন। দাদিকে জড়িয়ে ধরা আপন মানুষের কাছে পাওয়া সে যে আনন্দ পথের ক্লান্তিকে মূহুর্তের মধ্যে দূর করে দিতো। এরপর ঈদের আগের দিন দাদা বা নানার সাথে বাজারে যাওয়া ঈদের রান্নার প্রয়োজনীয় কেনাকাটার তাদের সাথে থাকতাম। আব্বা খাদ্য বিভাগে চাকরি করতেন। কিন্তু সে সময় বোনাস দেওয়া হতো না। তাই অনেক সময় নতুন কাপড়ও পেতাম না।
তখন দরগাহপুর ও চাঁদখালী বাজারে দেখতাম ৫৭০ সাবান, ৫৫৫ সাবান, বল সাবান, লাইফবয় অর্ধেক করে কেটে কেটে বিক্রি হতো। দেখতাম দরজির দোকানে খুব ভিড়। লোকজন তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মালামাল কিনতো। ঈদের দিন সকালে উঠে পুকুরে গোসল করে নতুন অথবা পরিস্কার কাপড় পরিধান করে ঈদের জামাতে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম।
সকাল ১০ টার দিকে ঈদের জামাত হতো। চাঁদখালীতে কালাম বাগান ঈদগাহ মাঠে। আর দরগাহপুর কলেজিয়েট বিদ্যালয় মাঠে। ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি। আর আমরা ছোটরা সেলামি পেতাম। সেলামি হিসাবে কেউ দু’আনা, কেউ দশ পয়সা কেউ চারআনা, কেউ আটআনা দিতেন। এক টাকা পেলেতো খুশিতে ভরপুর!
ঈদের জামাতের চারপাশ দিয়ে কত রকম মিষ্টির দোকান তার ইয়ত্তা নেই। জিলাপি রসগোল্লা গজা রসমনিসহ সন্দেশ ছানার জিলাপি আরো কত কি? বাদাম ছোলাও থাকতো। কাঠি লজেন্সসহ নানারকম চকলেট পাওয়া যেত। এগুলো কেনা আর দিনভর ঘুরে বেড়ানো ছিল আমার কাজ। বাড়িতে এসে দেখতাম আমরা যাকে শহরের লোকেরা পায়েশ বলি অনুরূপ গুড় দিয়ে রান্না করা পায়েস। যা খীর নামে পরিচিত। রাখা হতো ঢামাতে। (ঢামা হলো ধান বা চাল রাখার বড় ঝুড়ি)।
মুরব্বিরা ছুটতেন গরু বা মহিষের মাংস কিনতে। কেজি বা সের হিসাবে মাংস বিক্রি হতো না। গরু বা মহিষ জবাই করে কয়েকজন মিলে তা ভাগ করে নিতেন। এইভাবে দিনটি আনন্দে কেটে যেত।
এদিকে গ্রামের সকল বয়সী মহিলারা বিশেষ করে কমবয়সীরা নানা রকমের চুড়ি ফিতা ও আলতা কিনে সাজতো। আলতা চুড়ি ও ফিতার অনেক কদর ছিল সে সময়।
ঈদের পর দিন দরগাহপুরে বিভিন্ন রকম খেলা হতো। ফুটবল ভলিবল দড়িটানা। বিবাহিত ও অবিবাহিত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে খেলা হতো। যেমন খুশি তেমন সাজার প্রতিযোগিতাও চলতো। রাতে বিদ্যালয়ের মিলনায়তনে নাটক হতো। দরগাহপুরের অনেকে নাটক লিখতেন ও নির্দেশনা দিতেন। এদিক দিয়ে মরহুম ছবির মামার নাম উল্লেখ করতেই হবে। ছবির মামা একজন ভালো রেফারী ও আমুদে মানুষ ছিলেন। দরগারপুরে আনন্দ অনুষ্ঠান ঈদের পরবর্তী তিনদিন ধরে চলতো।
এবার ফিরে আসার পালা। দুনিয়ার সকল কালোমেঘ তখন মনের উপর ভর করতো। নানার সাথে রাত চারটার লঞ্চে উঠে খুলনায় রওয়ানা দেওয়া। লবনচোরা আসলে মনে করতাম আর একঘন্টা পর খুলনা। এরপর নতুন বাজার এসে নামতাম। ফেলে আসতাম প্রিয় মুখ গুলোকে। এই প্রিয় মুখগুলো ফেলে আসার বেদনা কাটিয়ে উঠতে এক মাস লেগে যেত। কি সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো।
খুলনা গেজেট/এনএম