১৯৫২ সালের বাগেরহাট। সুন্দরবনের পাদদেশের একটি মহাকুমা। প্রশাসনিক জেলা খুলনা। ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ছাত্র হত্যার খবর বিকালেই ছড়িয়ে পড়ে এ মহাকুমা শহরে। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখানকার সামসু কবির গান লেখেন। গানের ভাষা “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করলিরে বাঙ্গালী, ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি।”
৭১ বছর আগের কথা। এখানকার বড় প্রতিষ্ঠান বলতে পিসি কলেজ। গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা ও খুলনার শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা করতো। মহাকুমা শহরে তখনকার দিনে ছাত্র আন্দোলনের সুতিকাগার এ বিদ্যাপীঠ।
২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পিসি কলেজ, বাহিরদিয়ার রাংদিয়া স্কুল ও গোয়ালমাঠ স্কুলে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। মুসলিম হাইস্কুলে (আজকের বাগেরহাট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়) ধর্মঘট পালিত হয়নি। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতা ডা. মোজাম্মেল হোসেন এ প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ভাষা আন্দোলন ছিল পিসি কলেজ কেন্দ্রিক। কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে বাংলা বিভাগের কালিদাস মুখার্জি, ইতিহাস বিভাগের জিতেন্দ্র লাল বিষ্ণু, মীর মোশারফ আলী, নারায়ন চন্দ্র সমাদ্দার, মো নুরুল হক, আঃ রাজ্জাক, মো ইসমাইল হোসেন প্রমুখ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আন্দোলনকে সমর্থন জানান।
অধ্যক্ষ মনিকান্ত গাঙ্গুলি এ আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেন। এ সময় কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন চিতলমারীর অনন্ত কুমার বিশ্বাস ও জিএস এজেডএম দেলোয়ার হোসেন (পরবর্তীতে অধ্যক্ষ খুলনা সিটি ল কলেজ)। তারা এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। এছাড়া রাজনীতিকদের মধ্যে শেখ আমজাদ আলী গোরাই মিয়া, আব্দুল খালেক, সেখ আশরাফ হোসেন, মনসুর আহমেদ, আব্দুল গনি সরদার, ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে সৈয়দ রওনাক আলী হারু মিয়া, এস এম ইব্রাহিম হোসেন লাল, এস এম সোহরাব হোসেন, আব্দুল খালেক, সৈয়দ হারুন, শেখ আব্দুল আজিজ (পরবর্তীতে শেখ মুজিব সরকারের কৃষিমন্ত্রী), এ এস এম জহুরুল হক, নূর মোহাম্মদ, (পরবর্তীতে গোয়ালমাঠ স্কুলের প্রধান শিক্ষক), শেখ মারুফুল হক (পরবর্তীতে পুলিশ সুপার), এম মনসুর আলী (পরবর্তীতে জিয়া সরকারের বস্ত্রমন্ত্রী), শেখ নজিবুর রহমান, ইজাবুল হক, সামসুল হক, গাজী আব্দুল জলিল, সৈয়দ মোস্তাগাউসুল হক, (পরবর্তীতে মন্ত্রী), খান মোহাম্মদ সামসুদ্দীন, শেখ আতিয়ার রহমান, আশরাফ আলী, আব্দুল বারী ইজারাদার, মাহমুদ, শেখ আলী আহমেদ, কাজী মশিউর রহমান ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে নিজেদের নিয়োজিত করেন।
২০১২সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি রাতেই ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগের মহিমায় তুলে ধরে একটি গান রচনা হয়। এ গানের রচয়িতা সেখ সামসুদ্দিন । তিনি বাগেরহাটের সদর উপজেলার বেমত্যা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামের সন্তান। তিনি ১৯১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন, ১৯৭৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। এর আগে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় এসি লাহা টাউন ক্লাবে সর্বদলীয় গান গেয়ে শোনান । এর পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়। আশেক ইব্রাহীম রচিত রাষ্ট্রভাষা গান ও একজন পল্লীকবি সামসুদ্দিন নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা গান শিরোনামের এটি ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান বলে দাবি করেন। পাকিস্তান পল্লীগীতি নামে কবি সেখ সামছুদ্দিন রচিত বইয়ে ১৪টি গানের মধ্যে এটি অন্যতম। খুলনা শহরের দি ইস্টার্ন প্রেসে ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বইটি প্রকাশিত হয়।
বাগেরহাট শহরের খারদ্বার গ্রামের তোরফান সরদারের পুত্র আব্দুল গনি সরদার প্রতি বছর একুশের প্রথম প্রহরে রিক্সা যোগে মাইক্রোফোনে শহরে এই গানটি গাইতেন। তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের অনুসারী।
সামসুদ্দিন সেখ চারণ কবি ও লোক কবি হিসেবে বাগেরহাটে পরিচিতি পেয়েছেন। গান লিখে তিনি নিজেই সুর করতেন। তার মাথায় লম্বা চুল, উচ্চতা ৫ ফুট ৬ইঞ্চি। বিভিন্ন সমাবেশে পাজামা ও ফতুয়া পরে দোতারা বাজিয়ে গান গাইতেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জে. আইয়ুব খানের শাসনামলে তিনি সার্কেল অফিসারের দপ্তরে বয়াতী হিসেবে চাকরি করেন (১৯৫৮- ১৯৫৯)। মাসিক বেতন ২শ’ টাকা (বাগেরহাট ফিল্ম সোসাইটির প্রকাশনা ভাষা আন্দোলনের বাগেরহাট)।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, খুলনা গেজেট।
খুলনা গেজেট /এমএম