খুলনা, বাংলাদেশ | ১৫ কার্তিক, ১৪৩১ | ৩১ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১১৫৪
  দ্রুতই সিটি করপোরেশন, জেলা-উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভায় স্থায়ীভাবে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে : স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা

ঈদে বাড়ি ফেরার সংস্কৃতি

ড. খ. ম. রেজাউল করিম

আর কদিন পর বাঙালি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই উচ্ছ্বাস, ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর আসে খুশি আর আনন্দের বার্তা নিয়ে। ঈদকে কেন্দ্র করে সমাজের প্রায় সকল বয়স, শ্রেণি-পেশার মানুষের থাকে নানা আয়োজন। এর মধ্যে অন্যতম আয়োজন হলো ঈদে বাড়ি ফেরা। ঈদের আনন্দ বহুগুণে বেড়ে যায় যখন আমরা বাড়ি ফিরি। অধীর অপেক্ষায় থাকা প্রিয়জনের মুখগুলো দেখি। ঈদ উপলক্ষ্যে নাড়ির টানে পরিবারের সকলের সাথে সম্মিলনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ কর্মক্ষেত্র বা অস্থায়ী আবাস ছেড়ে পাড়ি জমায় তাদের জন্মভিটায়। কেউ বাসে, কেউ ট্রেনে কিংবা লঞ্চে, কেউ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। আর অল্প সংখ্যক মানুষ বাড়িতে যান আকাশপথে। যাত্রাপথের ভোগান্তির সঙ্গে যানবাহনের টিকিট পাওয়াও সহজ বিষয় নয়। ফলে যারা বাড়ি ফেরেন, তাঁদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়্। সঙ্গে সন্তান-সন্ততি থাকলে তো কথাই নেই। ফলে অনেকের কাছেই ঈদে বাড়ি ফেরার বিষয়টি রীতিমত আতঙ্কে পরিণত হয়। তা সত্ত্বেও মানুষের এই বাড়ি ফেরা থেমে থাকে না। গণমাধ্যমের ভাষায়, নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে মানুষ।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশে নগরায়ন তথা নগরের বিকাশ ঘটেছে দ্রুতগতিতে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১.৬৬ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করে। জনবিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশ নগরে বসবাস করবে। নগরগুলো আজ শিল্পায়নসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানাবিধ কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কর্মসংস্থানের আশায় মানুষ নগরে পাড়ি জমায়। সঙ্গত কারণে প্রতি বছর ঈদকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী দেশের প্রান্তিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে ফেরা এদেশের মানুষের কাছে অনেকটা নিয়ম বা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টাকে বাড়ি ফেরার সংস্কৃতি বলতে রাজী।

বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ২৩ ভাগ মুসলিম। আর বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ মুসলিম। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো ও ব্যাপক উৎসাহ ও ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে ঈদ-উল-ফিতর পালন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ ঐতিহ্য হলো ঈদে বাড়ি ফেরা। জানা যায় ইন্দোনেশিয়ার বেশির ভাগ মুসলিমই পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঈদ পালন করতে শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমায়। এক তথ্যমতে, এবারের ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে ইন্দোনেশিয়ার প্রায় ৯ কোটি মানুষ তাদের কর্মস্থল থেকে গ্রামের বাড়িতে যাবে। কর্মের সুযোগসহ অন্যান্য সুবিধাদির কারণে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৬.৮৮ শতাংশ ঢাকা বিভাগে বসবাস করে। ঈদে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ ঢাকা ছাড়েন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কমপক্ষে অর্ধেক নগরবাসী যে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যান সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এক হিসেবে ১ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার এই শহর থেকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ইদের আগে বাড়ি ফেরেন। সে হিসেবে ঈদ মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বাড়ি ফেরেন।

উল্লেখ্য, প্রতিদিন ঢাকা থেকে দেশের সকল জেলায় চলাচলকারী যানবাহনের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ২২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ বাস-মিনিবাসে, ১ লাখ ৫ হাজার মানুষ রেলগাড়িতে, ১ লাখ ২৫ হাজার লঞ্চে, ৩ লাখ মোটর বাইকে এবং ৩ লাখ ব্যক্তিগত গাড়িতে বাড়ি যান।

ঈদে নগরবাসীর গ্রামমুখী হওয়ার সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। জীবন-জীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বসবাসকারী মানুষবড় বড় শহরে আবাস গড়ে তোলেন। ফলে এসব নগরের অধিকাংশ মানুষের নিজস্ব আবাস থাকে না। তাদের বেশিরভাগ ভাড়া বাসায় থাকেন। তাই ঈদের তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ ছুটিতে তাদের অধিকাংশই চান পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। সবারই মনের গভীরে বাড়ি বলে যে চিত্রটি আকা থাকে তার অবস্থান কিন্তু মূলত গ্রামে। ঈদ উপলক্ষ্যে সেই বাড়ি বা গ্রামে কয়েক দিনের জন্য হলেও ফিরে যাওয়া, এ যেন নিজেকেই ফিরে পাওয়া। নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঈদ উৎসবে নগরবাসীর গ্রামমুখী হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। এখনো ঢাকার ৬০ ভাগ পরিবার প্রধানের জন্ম গ্রামে। সমাজ গবেষকরা বলেন, নতুন প্রজন্ম শহরকে নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে বেশির ভাগ মানুষের শিকড় গ্রামে।আবার যারা ঢাকায় মাইগ্র্যান্ট, তাদের অধিকাংশেরই শহরে নিজস্ব বাড়ি বা ফ্লাট নেই। তাদের পরিবারের একটি অংশ নিজ গ্রামে বা অন্য এলাকায় থাকেন। কেউ কেউ আছেন, যিনি শুধু নিজেই ঢাকায় থাকেন, পরিবারথাকে গ্রামে। এসব কারণে উৎসব আয়োজনে তাঁরা গ্রামে যান।

ঈদ-পার্বণে বাড়ি ছুটে যাওয়া, এটা বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ঈদ করার জন্য সবাই বাড়ি ফেরে। চোখে মুখে খেলা করে অন্যরকম দ্যুুতি! কী সেই অমোঘ টান যার জন্য মানুষ হাজারো কষ্ট স্বীকার করে বাড়ি ফেরে? যানবাহনে কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই, তবুও কারো মাঝে যেন এতটুকু বিরক্তি নেই। সবাই নিজে এবং চেনা-অচেনা মানুষদের সাথে ফেরে আপন নিবাসে।

ঈদ কেবল বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবই নয়, আনন্দ-বিনোদন এবং মিলনমেলাও। প্রিয়জনের সাথে ঈদ করা, কারও বাবা-মার প্রতি টান, কারও পূর্বপুরুষের ফেলে যাওয়া বসতভিটার প্রতি অনুরাগ, কেউ সন্তানকে তার শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দিতে চান। কেউ কেউ চান পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশি সবার সঙ্গে দেখা ও কুশল বিনিময় করতে। পারিবারিক বন্ধন বা সংহতি বজায় রাখার তাগিদও অনেকের মধ্যে লক্ষ করা যায়। এমন অসংখ্য কারণ নগরবাসীদেরকে তাদের নিজ গ্রামের বাড়িতে টেনে নিয়ে যায়। এই ফিরে যাওয়ায় অনেক সময় প্রেরণা হয়ে থাকে, গ্রামের দিগন্ত জোড়া সবুজ মাঠ, খেলার মাঠ, স্কুল বা কলেজ প্রাঙ্গন, পুকুরপাড়, বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের আড্ডা, সবাই মিলে খেলাধুলা, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটি। যে খালে নাইতো ছোট বেলায়, যে বটগাছটির কাছে গিয়ে আশ্রয় মিলত রোদে-বৃষ্টিতে, সবই মনের মধ্যে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে।

বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজও মানুষের ঈদে নগর ছাড়ার অন্যতম কারণ। এখনো দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিনির্ভর। ফলে দেশের নগরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগের শিকড় মূলত গ্রামে। এখনো কারও বাবা-মা, চাচা-চাচি, কারও দাদা-দাদি, নানা-নানি বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা রয়ে গেছে গ্রামে। এক বা দুই প্রজন্মের নগরবাসী হয়েও তারা সেই শিকড় ভুলতে পারেন না। সঙ্গত কারণেই তারা ঈদের আনন্দে ফিরে যেতে চায় সেই শিকড়ের কাছে। যদিও নাগরিক ব্যস্ততা ক্ষণিকের জন্য এসব আবেগ-অনুভূতিকে চাপা দিয়ে রাখে। তবে ছুটির দিনগুলোতে সেই পুরানো স্মৃতিগুলো কাতরাতে থাকে। ফলে অনেক দূরে অবস্থান করলেও, মন চলে যায় স্মৃতির আঙিনায়।

ঈদ পর্বের সঙ্গে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কিছু বিষয় জড়িত থাকে। যেমন- অনেকেই ঈদের দিন সকালে ইদগাহ মাঠে নামাজ আদায়ের পরপরই চলে যান মৃত মা-বাবা বা দাদাদাদি, নানানানির কবর জিয়ারত করতে। জানা যায় প্রাচীনকালে যাযাবর মানুষের স্থায়ী আবাস গঠনে সহায়তা করেছে এই কবর। তাই নগরে অনেকের স্থায়ী আবাস হলেও, অন্তত বাবা-মাসহ অন্যান্য নিকট আত্মীয় স্বজনদের কবরের টানেও তাকে ফিরে যেতে হয়। সারা বছর না গেলেও অন্তত ইদের ছুটিতে যাওয়ার সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। ঈদে বাড়ি ফেরার এটিও একটি কারণ।

গ্রামে ফেরার অন্যতম সুফল হচ্ছে গ্রাম-নগরের মেলবন্ধন। স্বল্প সময়ের মেলামেশায় যেটুকু ভাবের আদান-প্রদান ঘটে তা আত্মিক উন্নয়নে সুদূর প্রসারী প্রভাব রাখে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশ এমনিতেই নগর ও গ্রামের মধ্যকার দূরত্ব অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে। ঈদ উপলক্ষ্যে বাড়ি ফেরা এ ধারাকে আরো এগিয়ে নিতে পারে। যান্ত্রিকতার এই যুগে ভাইবোনের সন্তান-সন্ততিরা অনেকেই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে না। ফলে ঈদের সময় বাড়িতে গিয়ে এরা সবাই মিলিত হয়। একে অন্যের সঙ্গে কুশল, মুঠোফোনের নম্বর বিনিময় করে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ওয়াটসআপ, টুইটারে একে অন্যের বন্ধু হয়। এভাবে পরবর্তী প্রজন্মের উভয়ের মধ্যে মেলবন্ধন স্থাপিত হয়। এমন ঘটনা এখন সব পরিবারেই দেখা যায়। সেই দিক বিবেচনায় ইদ সবার কাছে একটা সম্মিলনের উৎসব। এছাড়া ঈদ উৎসবের মধ্যে নানা পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকান্ডও সম্পন্ন হয়। যেমন- অনেক সময় আত্মীয়স্বজনের মধ্যে নানা বিষয়ে ভুল-বোঝাবুঝি বা মনোমালিন্য হতে পারে। ঈদ এসব পারিবারিক বিবাদ বা ঝামেলা নিরসনের একটা সুযোগ করে দেয়। আবার জমিজমা সংক্রান্ত নানান জটিলতা বা পারিবারিক অন্যান্য সমস্যার বিষয়ে এ সময় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইদানিং বিবাহ, খৎনা, আকিকা, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলো ঈদের মৌসুমে গ্রামের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। কারণ বছরের এই সময়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সকল সদস্য বাড়িতে ফিরে আসে। ফলে এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরি হয়। ঈদ উৎসব যেন সব উৎসবকে ছাপিয়ে যায়। মিলনমেলায় রূপান্তরিত এ উৎসবে দৃঢ় হয় পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন।

ইদানিং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরকে ঈদের সময় বাড়িতে এসে পুনর্মিলনীর আয়োজন করতে দেখা যায়। অনেক সময় একই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাচভিত্তিক পুনর্মিলনী চোখে পড়ে। সাধারণত ঈদের পরের দিন এ রকম আয়োজন অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এছাড়া ঈদুল ফিতরের আগে রোজার মধ্যে প্রিয় স্কুল বা কলেজ মাঠে এসব ব্যাচের ইফতার পার্টির আয়োজন চোখে পড়ে। এ ধরনের পুনর্মিলনী ঈদের আনন্দের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ফলে নতুন প্রজন্মের সদস্যরা গ্রামের বাড়িতে আসার এক ধরনের তাগিদ অনুভব করে।

এবারের ঈদ আনন্দের হোক, সুখের হোক। এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সমাজের সকল বয়স, পেশা-শ্রেণির মানুষের মধ্যে। সবাইকে ইদেও শুভেচ্ছা। ইদ মোবারক।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!