খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  অ্যান্টিগা টেস্ট: প্রথম দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলল ২৫০, বাংলাদেশ পেল ৫ উইকেট

ইসলামী ব্যাংক থেকে একাই ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে ‘এস আলম’!

গে‌জেট ডেস্ক

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছ থেকে চট্টগ্রাম ভিত্তিক এস আলম গ্রুপ একাই ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রুপটির এভাবে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে গ্রুপটির ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নিয়ম অনুযায়ী গ্রুপটি ইসলামী ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নিতে পারে। এজন্য ব্যাংকের বোর্ড এবং ব্যবস্থাপনায় তার প্রভাব ব্যবহার করে বিশাল অঙ্কের এই ঋণ পেয়েছে। যার বেশিরভাগই ভুয়া ও নাম সর্বস্ব কোম্পানি নামে ঋণ নেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এস আলম গ্রুপ ও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে গ্রুপটি প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। যার করেছে বেশির ভাগই ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে নেওয়া।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাপক অনিয়ম জড়িত থাকার পর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং বেআইনি ঋণ প্রদানে গ্রুপটিকে সুবিধা দিয়েই গেছে। ঋণ বিতরণের সীমা অতিক্রম করলেও তাদের কোনো নথি তলব করা হয়নি। এর ফলে বিনা কাগজ পত্রে ঋণ নেয়া তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যার ফলে ২০১৭ সালের পর থেকেই ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি লক্ষ্য করা গেছে। দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকটি থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে থাকেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন বলে গ্রুপটির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অডিট রিপোর্ট সূত্রে জানা গেছে, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে এস আলম গ্রুপের নেওয়া ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ ক্ল্যাসিফাইড( শ্রেণিবদ্ধ ঋণ)হিসাবে দেখানোর পরামর্শ দিয়েছে। তবে, ব্যাংকের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ঋণটি নন ক্ল্যাসিফাইড বা অ-শ্রেণীবদ্ধ হিসাবে দেখানো হয়েছে। এবিষয়ে এস আলম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত কুমার ভৌমিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কোম্পানি ব্যাংকিং আইন মেনেই ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। ঋণের জামানত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণের আকার অনুযায়ী এবং প্রয়োজন অনুযায়ী জামানত রাখে আমরাও তাই করেছি।

২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। এরপর জামায়াত সংশ্লিষ্টদের ব্যাংকটি বিভিন্ন পদ থেকে বের করে দেওয়া হয়। এছাড়াও গ্রুপটি সোশাল ইসলামী ব্যাংক ও ফাস্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে নেয়। বর্তমানে এস আলম গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এবং আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অজানা কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিমকে এই ব্যাংকগুলোতে অবাধ পরিদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এছাড়াও বার্ষিক অডিট রিপোর্টও প্রতিবেদন অনুমোদন করেনি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, এস আলম গ্রুপ আইবিবিএলের খাতুনগঞ্জ শাখা, চট্টগ্রাম থেকে তাদের ছয়টি কোম্পানির নামে ১২ হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, এস আলম রিফাইন্ড সুগার নিয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল ২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, সোনালী ট্রেডিং লিমিটেড ও এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড ২ হাজার ৭৮০ কোটি, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা এবং সেঞ্চুরি মিল ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।সূত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট। এছাড়াও, গ্রুপটিকে তার অন্যান্য সাতটি সহযোগী কোম্পানিকে কোনো প্রকার জামানত ছাড়াই ২৮৯০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে আরামিত লিমিটেড, ইউনিটেক্স কম্পোজিট স্পিনিং, ইউনিটেক্স এলপিজি, এইচআইপি, সানমুন এন্টারপ্রাইজ এবং আদিল এন্টারপ্রাইজ। এছাড়া, ইসি/বোর্ডের কোনো আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়াই তাড়াহুড়ো করে উপরোক্ত সাতটি কোম্পানির নামে অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এতে তারা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উইং (ICTW) এর সহায়তায় সংশ্লিষ্ট খাতুনগঞ্জ শাখার প্রধানের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংগঠিত দলের মাধ্যমে উল্লিখিত সুবিধাটি নিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, কোনো ভাবেই গ্রুপটি বিপুল অঙ্কের এই টাকা এতো ছোট ছোট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেনি। অস্বাভাবিক এই ঋণ বিতরণের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক পুরো ব্যাংকিং খাতকে বিপদে ফেলেছে, বিশেষজ্ঞরা আরও পর্যবেক্ষণ করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ব্যাংকিং অনিয়ম তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বিভাগ রয়েছে। তিনি বলেন, যদি এটা হয়ে থাকে তবে, এটি অনিয়ম, পরীক্ষা করে এবং সেই অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসাইন বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক-এর মতো ঋণ অনিয়ম আরও হলে তা পুরো ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি বিপর্যয়কর সংকেত। তিনি বলেন, সরকার ও ব্যাংকিং খাতের অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংককে অবিলম্বে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে এবং এ খাতের ক্ষতের গভীরতা খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে দেখতে হবে যে ব্যাংকগুলি প্রয়োজনীয় জামানত নিশ্চিত করা সহ ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন মেনে চলে কি না। এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, কেন একটি ব্যাংক ঋণ দেয়, কারা ঋণ পায় এবং ঋণগ্রহীতারা কী উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়। ন্যায়সঙ্গত হওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আরও সতর্ক হতে হবে এবং ব্যাংকগুলোর ওপর নজরদারি জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, ‘ঋণ মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকেও যথাযথ মনোযোগী হওয়া উচিত।

২৭ নভেম্বর, ২০১৭-এ তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন যে, সরকার সারা দেশে এস আলম গ্রুপের অর্থের উৎস খতিয়ে দেখছে। ঋণের অনিয়মের বিষয়ে ইসলামী ব্যাংককে মন্তব্য জানতে চাইলে ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান নজরুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে তার আরও সময় প্রয়োজন।

খাতুনগঞ্জ কর্পোরেট শাখার সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও হেড মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে বলেন, এস আলম স্টিল অ্যান্ড রিফাইন্ড সুগার, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল, সোনালী ট্রেডিং, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস, সেঞ্চুরি ফ্লাওয়ারের ঋণ নেওয়া হয়েছে। মিল, সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ ও আদিল এন্টারপ্রাইজ নিয়মিত ছিল। তিনি বলেন, ‘কোম্পানিগুলো নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে। তবে শাখা ব্যবস্থাপক এখন পর্যন্ত কোম্পানিগুলো থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের পরিসংখ্যান দেননি।

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!