খুলনা, বাংলাদেশ | ২০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী : রায় কবে জানা যাবে আজ

আশা জাগানিয়া মন আমার

এ এম কামরুল ইসলাম

ধানমন্ডি Scholars School & College এর সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম দু’জন টীন এজের ছেলেমেয়ে ফুটপাতের উপর সুন্দর একটি ছোট টেবিল বিছিয়ে সাদা কাগজে মোড়ানো কী যেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কৌতুহলবশতঃ একটু থামতেই মেয়েটি বললো,

-এটা হোম মেইড শর্মা। একটু ট্রাই করে দেখবেন স্যার। মাত্র পঞ্চাশ টাকা।
মেয়েটির আবেদন ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ চোখে পড়ার মতো। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিও বেশ মিষ্টভাষী।

আমি বললাম-
তোমরা কি কর?
-আমরা দু’জনেই একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছি স্যার।

-এগুলো কোথা থেকে এনেছো?

-আমরা বাড়িতে তৈরি করেছি।

-তোমাদের বাবা কি করেন? অভিভাবকের আর্থিক সমস্যা আছে?

-না স্যার। আমরা দুই বন্ধু ঠিক করেছি আমাদের লেখাপড়া ও হাত খরচের টাকা আমরাই আয় করবো। এজন্য পার্টটাইম কাজ খুঁজে হয়রানির শিকার হয়েছি। তাই মা-বাবার সম্মতি নিয়ে দুইদিন হলো এই কাজ শুরু করেছি।

-যদি কিছু মনে না কর তাহলে জানতে পারি কি, কেমন লাভ থাকছে।

-জী স্যার। দুই দিনে ১৩০০/ টাকার মতো লাভ হয়েছে।

-আচ্ছা, তোমরা চালিয়ে যাও। কোন নিন্দুকের কথায় কান দিও না। আমি ফিরবার পথে কিনবো।

-এখন একটা খেলে আমরা খুশী হবো স্যার।

-সরি, আমি রোজা আছি। তাই ইফতারের জন্য বাসায় ফেরার পথে নিবো।

আমি আমার কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে ওদের জন্য দুটো রজনীগন্ধার গুচ্ছ নিয়ে সেই জায়গায় গিয়ে দেখলাম – ওরা দু’জন চলে গেছে। স্কুলের গেটম্যানের কাছে জানতে পারলাম- ওরা টেবিলটি ভিতরে তার জিম্মায় রেখে একটু আগে সব খাবার প্যাকেটে নিয়ে চলে গেছে। দুপুর দুটোয় স্কুল ছুটির সময় আবার আসবে।

আমি রজনীগন্ধার গুচ্ছ দুটো গেটম্যানের কাছে দিয়ে বললাম –
এই দুটো ওদের দিবেন। আমার নাম ও মোবাইল নম্বর তার কাছে লিখে দিলাম।

আমি বাসায় ফেরার ঘন্টা খানেক পর আমাকে ফোন করে তারা সরি বললো এবং আমার বাসায় এসে শর্মা পৌঁছে দিতে চাইলো। আমি তাদের কষ্ট দিবো না বলে নিজেই সেখানে যাবার প্রতিশ্রুতি দিলাম। একটু পরে তাদের কাছে গিয়ে দেখলাম, তাদের সব শর্মা বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু আমার জন্য গিফট হিসেবে দুটো তুলে রেখেছে। আমি তাদের দেওয়া ভালবাসার গিফট নিতে অস্বীকার করার সাহস পেলাম না। তবে ভিন্নভাবে দামটা পূরণ করলাম। ইফতারের সময় সেই শর্মা খেয়ে দেখলাম বাজারের শর্মার চেয়ে তাদের হাতে তৈরি শর্মা বেশ ভাল।

আমার বিশ্বাস, এদের মতো আরও ছেলেমেয়ে এদেশে আছে। তারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবেই ইনশাআল্লাহ এবং দেশ, জাতি ও নিজের কল্যাণে আসবে।আবার এমন ছেলেমেয়েও আছে যারা অন্যের সাহায্যের আশায় হাত পেতে থাকে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেয়ে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে বেশি পছন্দ করে। অনেকে অন্যের সাহায্য নিয়ে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ায়। আমার জীবনে দেখা এমন অনেক মানুষ আছে। তারা দেশ ও জাতির কোন কল্যাণে লাগে না। কারণ, তাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন হয় না। তারা সবসময় হীনমন্যতায় ভোগে। তারা নিজের বাইরে কিছু চিন্তা করতে পারে না। ছাত্রজীবনে পরনির্ভরশীল হলে ভবিষ্যতেও তারা পরমুখাপেক্ষী থাকে। অবশ্য সব ক্ষেত্রেই দু’চারটি সাধারণ ব্যতিক্রমও দেখা যায়। তাই আমি আশাবাদী যে, এই দুটো ছেলেমেয়ের মতো লাখ লাখ ছেলেমেয়ে ছাত্র জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পথ খুঁজে নেবে।

এক্ষেত্রে আমার নিজের তিনটি ছেলেমেয়ের কথা উল্লেখ না করে পারলাম না। তারা তিনজনই আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া করেছে। আমার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হতো না, যদি তারা সেখানে পড়াশোনা করাকালীন নিজেও কিছু উপার্জন না করতো।

আমার নিজের কথা সামান্য বলিঃ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধে আমার বাবা নিহত হওয়ার পর থেকে মায়ের দৃঢ় অবস্থানের ফলে আমাদের লেখাপড়া চলতে থাকে। আল্লাহর রহমতে আমরা তিন ভাই ও এক বোন লেখাপড়ার খরচের জন্য কারো মুখাপেক্ষী হইনি। বরং ১৯৭৪ সালে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আমার কাছে ৫০০/ টাকা ছিল। এই টাকার উৎস কিছুটা বৈধ এবং কিছুটা অবৈধ। আজ আমি অকাতরে আমার জমানো সেই ৫০০/ টাকার উৎস বলতে চাই।

আমি ক্লাস সিক্স থেকে বাড়ির বাজার করতাম। সেখান থেকে কিছু কিছু টাকা বাঁচিয়ে রাখতাম। আমাদের প্রচুর নারিকেল গাছ ছিল। সেই গাছের ডাব ও নারিকেল বিক্রির সময় মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু টাকা সরিয়ে রাখতাম। এসব ছিল আমার অবৈধ সঞ্চয়।

বৈধ সঞ্চয় ছিল কিছুটা অলৌকিক ও কিছু কিছু আমার কষ্টার্জিত। অলৌকিক আয়ের উৎস বললে অনেকে বিশ্বাস নাও করতে পারেন। আমার দাদার বিশাল দোতলা বাড়ি ছিল। ওই বাড়ির সিঁড়ি ও বারান্দায় মাঝে মাঝে রুপার টাকা পেতাম। সেই টাকা সাড়ে সাত টাকায় বিক্রি করতাম। টাকা পাওয়ার পর মতি সর্দার এসে বাজিয়ে দেখে আসল নকল যাচাই করে কিনে নিয়ে যেতেন। এখন বুঝি, এইসব রুপার টাকা আমার দাদীর গোপন টাকা। তাঁর অসতর্ক মূহুর্তে হয়তো কোনভাবে পড়ে যেতো।

আরও একটি অলৌকিক উৎস ছিল- হাঁসের ডিম। আমার দাদার চারটি পুকুর ছিল (যা এখনো আছে)। এই পুকুরে প্রচুর হাঁস থাকতো। ওইসব হাঁস পুকুরের পাড়ে ঝোপঝাড়ে ডিম পাড়তো। আমি ওইসব ঝোপের সবগুলো চিনতাম এবং প্রায় প্রতিদিন ডিম পেতাম। সেই ডিমও মতি সর্দার কিনতেন। এসব ছিল আমার অলৌকিক আয়ের উৎস।

কিছু ছিল আমার কষ্টার্জিত আয়। আমি ছিলাম গাছে চড়ায় ওস্তাদ। আমার দাদীর বিশাল সুপারি বাগানের প্রায় সব গাছের সুপারি আমি পাড়তাম। তাই দাদী আমাকে পাওনার চেয়ে বেশি সুপারি দিতেন। আবার সাতসকালে সুপারি বাগানে গিয়ে বাদুড়ে খাওয়া সুপারি কুড়িয়ে আনতাম। সেই সুপারি বাজারে বিক্রি করে বেশ আয় করতাম।

আমাদের আমলে আজকালের মতো এতো বেশি প্রাইভেট টিউশনি না থাকলেও, আমি ছাত্র হিসেবে মোটামুটি ভাল থাকায় আমার কাছে অনেক বাচ্চাদের অভিভাবক তাদের সন্তানের লেখাপড়ায় সাহায্য নিতেন। সেখান থেকেও কিছু আয় হতো।

আমার ছোট চাচা ও চাচাতো ভাই হাটে গেলে আমাকে মাঝে মাঝে পয়সা দিতেন। আবার স্কুল থেকে কিছু বৃত্তি পেতাম। এইসব বৈধ ও অবৈধ পন্থায় তিল তিল করে ৫০০/ টাকা জমিয়েছিলাম।

আমার একটি বদভ্যাস ছিল। সন্ধ্যার সাথে সাথে মায়ের ভয়ে পড়তে বসা লাগতো। কিন্তু সুযোগ পেলেই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক চক্কর পাড়ায় ঘুরে আসতাম।

এমনি ঘুরতে গিয়ে একদিন আমার এক অতি দরিদ্র নিকট প্রতিবেশীর বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া শুনে থমকে দাঁড়ালাম। (তাদের নাম পরিচয় এখানে বলতে চাই না)। সেদিন তাদের ঘরে কোন খাবার ছিল না। দুপুরে না খেয়ে ছিল। রাতের খাবারের কোন সংস্থান করতে পারেনি। ওদিকে তাদের পৈত্রিক এক বিঘা জমি বন্ধক রাখা ছিল ৫০০/ টাকায়। ওই জমি বন্ধক রাখার সময় শর্ত ছিল, এক বছরের মধ্যে টাকা ফেরত না দিলে আরও ৫০০/ টাকা নিয়ে জমি দলিল করে দিতে হবে। তখনকার দিনে আমাদের এলাকায় এক বিঘা জমির দাম ছিল এক থেকে দেড় হাজার টাকা। তাদের বন্ধক রাখা জমি দলিল করার মেয়াদ ছিল পরের দিন। তাই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া। এদিকে ঘরে খাবার নেই।

ঝগড়ার এক পর্যায়ে তারা চলে গেল সেই জমি বন্ধক রাখা লোকের বাড়ির দিকে। তখন তাদের বাড়ি শুণ্য হয়ে পড়লো।

আমি দ্রুত বাড়ি ফিরে আমার মায়ের চালের ড্রাম থেকে কিছু চাউল, কয়েকটা ডিম, কয়েকটা আলু, কিছু পেঁয়াজ মরিচ চুরি করে সেই বাড়িতে গিয়ে দেখি তারা তখনো ফেরেনি। তাই আমার চুরি করা জিনিসগুলো তাদের দরজার পাশে রেখে দিলাম। একটু পর তাদের ফিরে আসার আওয়াজ পেয়ে আমি ঘরের পিছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকলাম। তারা ঘরের দরজায় আমার রেখে আসা ওইসব জিনিস দেখে মনে মনে খুশি হয়ে বলাবলি করতে লাগলো –

এসব নিশ্চয়ই কামরুলের কাজ। আজ রাতে না হয় এসব খাবো। কিন্তু আগামীকাল ৫০০/ টাকা না হলে জমি দলিল করে দেওয়া লাগবে। আমাদের শেষ সম্বল এই এক বিঘা জমি হারালে ভবিষ্যতে খাবো কী।

আমি বাড়িতে ফিরে রাতে ভীষণ চিন্তায় পড়লাম। আমার জমানো ৫০০/ টাকা বার বার গুণে দেখলাম। তারপর ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওই ৫০০/ টাকা নিয়ে সেই বাড়িতে গিয়ে তাদের হাতে দিয়ে বললাম- এই টাকা দিয়ে তোমাদের বন্ধকী জমি ছাড়িয়ে নাও। আমার টাকা আস্তে আস্তে শোধ করে দিও।

কিন্তু ১৯৭৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সেই টাকা ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য তাদের হয়নি। আমিও কখনো ফেরত পাওয়ার আশা করিনি। তাদের একমাত্র সন্তান লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে চাকরি করে শহরে বাড়ি করেছে। কিন্তু এই কথা সে জানে না। ওই বাড়ির কর্তা অনেক আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আমিও তার মৃত্যুর আগেই দাবি ছেড়ে দিয়েছিলাম।

আমার এতো কথা বলার উদ্দেশ্যঃ
#শর্মা বিক্রি করা ওই দুটো ছেলেমেয়ের মতো সকল ছাত্র ছাত্রীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
#অন্যের কাছে হাত পাতার আগে নিজের হাত দুটি কাজে লাগাতে হবে।
#আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলে এবং চেষ্টা করলে সেই হাত কখনো বিফল হয় না।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!