শেয়ারবাজার মানেই যেন দর পতন, বিনিয়োগকারীদের হাহাকার। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ধস নামার পর দর পতনের দুষ্টচক্রে আটকে আছে এ বাজার। মাঝেমধ্যে কিছু শেয়ারের দর সাময়িকভাবে বাড়লেও তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারসাজির চক্র লাভবান হয়, পুঁজি হারান সাধারণ বিনিয়োগকারী। দর পতন শুরু হলে কৃত্রিম ব্যবস্থা দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। সর্বশেষ হস্তক্ষেপেও কাজ হয়নি; বরং দর পতন আরও বেড়েছে।
টানা আড়াই মাসের দর পতনের পর কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে আরও পতন ঠেকাতে গত বুধবার বাজারে হস্তক্ষেপ করে বিএসইসি। নির্দিষ্ট দিনে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির শেয়ারের দর ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না– এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার আরও বড় দর পতন হয়েছে। এমনকি ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বা প্রায় ২০০ কোম্পানির শেয়ার। গতকাল তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন, অর্থাৎ সব শেয়ারের বাজারদর ৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা কমেছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৬৮০ কোটি টাকারও বেশি।
এবারের দর পতনের শুরু হয় সব শেয়ারের দর বেঁধে দেওয়া ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দরসীমা প্রত্যাহারের পর। গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর আড়াই মাস ধরে ক্রমাগত দর হারাচ্ছে বেশির ভাগ শেয়ার। এতে তালিকাভুক্ত শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের বাজার মূলধন কমেছে ৭৮ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারমূল্য কমেছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এমন ক্ষতি মানতে না পেরে এরই মধ্যে অনেক বিনিয়োগকারী লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে পুরোপুরি বাজার ছেড়েছেন। ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায় শেয়ারের তথ্য সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে গত বুধবার পর্যন্ত মোট ৪৩ হাজার ২৫টি বিও অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি শেয়ারশূন্য হয়েছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি শেয়ারশূন্য বিও অ্যাকাউন্ট ছিল ৩ লাখ ২২ হাজার ৭৪৭টি, গত বুধবার শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৭২টিতে।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ জানান, এমন সিদ্ধান্তে যে অনেক শেয়ার ক্রেতাশূন্য হবে, এটা জানাই ছিল। বিএসইসির যেসব কর্মকর্তা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারাও তা জানতেন। কারণ, গত তিন বছরে কয়েকবার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উল্টো ফল হয়েছে। তার পরও কেন তারা এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, তা রহস্যজনক।
গতকাল পরিস্থিতি সামাল দিতে লেনদেনের শুরুতে ব্যাপক চেষ্টা ছিল বিএসইসির। সংস্থাটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে ফোন করে বিক্রির চাপ কমাতে বলেন। পাশাপাশি শেয়ার বিক্রি না করে উল্টো কিনতে অনুরোধ জানান। এ পর্যায়ে সূচকে প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কয়েকটি শেয়ারের দর বৃদ্ধি পাওয়ায় লেনদেন শুরুর কয়েক মিনিটে সূচককে ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা যায়। সকাল ১০টায় দিনের লেনদেন শুরুর সাত মিনিটে ডিএসইএক্স সূচক বুধবারের তুলনায় ১২ পয়েন্ট বেড়ে ৫৫৫১ পয়েন্ট ছুঁইছুঁই অবস্থানে ওঠে। তবে এর পরই শেয়ার বিক্রির চাপে ক্রমাগত দর হারাতে থাকে সিংহভাগ শেয়ার।
এমন দর পতনের শেষে বিকেলে গুজব রটে, আগামী সপ্তাহের শুরুতেই সার্কিট ব্রেকার-সংক্রান্ত নতুন সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করে নেবে বিএসইসি। জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত খুদেবার্তায় জানান, এ তথ্য ঠিক নয়। তবে শেয়ারবাজারের সার্বিক স্বার্থে সাময়িক সময়ের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নতুন সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গতকাল দিনের লেনদেনের প্রথম ঘণ্টায় প্রায় পৌনে ২০০ কোম্পানির শেয়ার বিএসইসির বেঁধে দেওয়া নতুন নিয়মে যতটা কমে কেনাবেচা হওয়ার সুযোগ ছিল, ওই দরে নেমে যায়। প্রায় ২০০ কোম্পানির শেয়ার ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। এতে ডিএসইএক্স সূচকটি বুধবারের তুলনায় ৯৯ পয়েন্ট বা দিনের সর্বোচ্চ অবস্থানের তুলনায় ১১১ পয়েন্ট হারিয়ে ৫৪৭৯ পয়েন্টে নামে।
শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, লেনদেনের দ্বিতীয় ঘণ্টায় একটি শীর্ষ ব্যবসায়িক গ্রুপের পক্ষ থেকে নামে-বেনামে আগ্রাসীভাবে শেয়ার কিনে কিছু কোম্পানির শেয়ারদর বাড়াতে দেখা গেছে। এই ব্যবসায়ী গ্রুপ সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ার কেনাবেচায় বেশ সক্রিয়। শেয়ারবাজারের কয়েকটি জুয়াড়ি চক্রও গতকাল শেয়ার কেনায় সক্রিয় হয়। লেনদেনের এক পর্যায়ে দেখা যায়, কোহিনূর কেমিক্যাল ও সোনালী আঁশ কোম্পানির শেয়ার দিনের সার্কিট ব্রেকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ দরে কেনাবেচা হয়। অর্থাৎ সার্কিট ব্রেকারের নিয়মে গতকাল এ দুই শেয়ার সর্বোচ্চ যে দরে কেনাবেচার সুযোগ ছিল, সে দরে কেনাবেচা হতে থাকে।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, বছরের পর বছর শেয়ারবাজারে ব্যবসা না থাকায় ব্রোকারেজ হাউসগুলোর কাছে বিনিয়োগ করার মতো টাকা নেই। এখন বিনিয়োগকারীরা ‘লোক-ভোলানো’ এসব মিটিংয়ে আস্থা রাখেন না। বিএসইসির উচিত, এ মুহূর্তে যেসব প্রতিষ্ঠান প্রকৃতই বিনিয়োগ করতে পারে, তাদের সঙ্গে বৈঠক করা। আইসিবির সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। প্রয়োজনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করতে পারে। এমনকি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে বাস্তবভিত্তিক প্রণোদনা ও তারল্য বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে।
খুলনা গেজেট/এইচ