জে. মো. আইয়ুব খান তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তিনি লৌহ মানব হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচিত। তার জামানায় ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘দেশের ডাক’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র লুৎফর রহমান জাহানগীর এই সাপ্তাহিকের সম্পাদক ও প্রকাশক।
প্রথম দিকে খুলনার আইডিয়াল প্রেসে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। তারপর ডাকবাংলা ভবনের বিপরীতে নটরাজ প্রেস থেকে ছাপা হয়। আট পৃষ্ঠার এই কাগজটির মূল্য ছিল ১৫ পয়সা। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করলে দেশের ডাক তার প্রতি সমর্থন জানায়। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে দেশের ডাকের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ৬৮-৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলায় প্রহসনের বিচারের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে ‘দেশের ডাক‘ উৎসাহিত করে। নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় লিখে পত্রিকাটি ছয় দফাকে মানুষের কাছে প্রিয় করে তোলে।
পাকিস্তানের শেষ দিকে ‘দেশের ডাক‘ জনপ্রিয় পত্রিকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৬৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি হাজী মহসিন রোড ও সার্কিট হাউজের সামনে খান এ সবুরের বাসভবনের সামনে পুলিশ ও ইপিআর-এর গুলিতে লন্ড্রী শ্রমিক হাদিস, স্কুল ছাত্র প্রদীপ ও টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক আলতাফ শহিদ হলে দেশের ডাক স্বোচ্চার ভূমিকা পালন করে। জিন্নাহ পার্কের পরিবর্তে হাদিস পার্ক নামকরণে সাপ্তাহিকটির ভূমিকা ছিল ইতিবাচক।
১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করলে সেনাবাহিনী প্রধান জে. ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক শাসন ও নানাবিধি আরোপ করেন। সংবাদপত্রের জন্য ৬, ১৭ ও ১৯ ধারা জারী করে স্বাধীন মতামতকে কেড়ে নেওয়া হয়। এই ধারায় বলা হয়, পত্র-পত্রিকা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি, ৬ দফা, আগরতলা মামলা ইত্যাদি নিয়ে উস্কানিমূলক প্রতিবেদন ছাপলে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনা হবে। দুর্বার গণআন্দোলনের মধ্যদিয়ে ভেসে যায় ইয়াহিয়া খানের সামরিক বিধি। এ ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক দেশের ডাক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সাপ্তাহিক দেশের ডাক আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেয়। ৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব সাফল্য ছিল। মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী খান এ সবুরকে ব্যঙ্গ করে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। খান এ সবুর পাইকগাছা নিয়ে গঠিত খুলনা-৪ সংসদীয় এলাকা থেকে পরাজিত হন।
১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সাপ্তাহিক দেশের ডাকের অবস্থান ছিল ইতিবাচক। খুলনায় ৩ মার্চের গুলিবর্ষণের ঘটনাকে ফলাও করে প্রচার করা হয়। সম্পাদক তার জীবনীতে উল্লে¬খ করেন ২০ মার্চ তারিখে ‘দেশের ডাক‘ এর পূর্ণ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের পতাকার রঙিন ছবি ছাপা হয়। এটাই দেশের ডাকের শেষ সংখ্যা।
সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যড. স ম বাবর আলী তার স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান নামক বইয়ে উল্লে¬খ করেন, দেশের ডাকের ওই সংখ্যা দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে থাকে। সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাক বাহিনীর কাছে এ খবর পৌঁছে যায়। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী দেশের ডাকের নটরাজ প্রেসে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর দেশের ডাক আর প্রকাশিত হয়নি।