আজ ৭ ডিসেম্বর, সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিন শত্রুমুক্ত হয় সাতক্ষীরা। গৌরবগাথা এই দিনটির কথা মুক্তিকামী সাতক্ষীরাবাসীর স্মৃতিতে আজও অম্লান। দিনটি ঘিরে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সাতক্ষীরা জেলা ইউনিট র্যালি, শহীদ আব্দুর রাজ্জাকের কবর জিয়ারত, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সাতক্ষীরা জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার মোশারফ হোসেন মশু জানান, দীর্ঘ ৯ মাস পর ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর রাতেই পালাতে শুরু করে পাকবাহিনী। পরদিন প্রত্যুষে রাজাকার আলবদর বাহিনী তাদের অস্ত্র ও মালামাল ফেলে প্রাণ বাচাতে স্ব স্ব ক্যাম্প থেকে পালাতে থাকে। ৭ ডিসেম্বর ভোর হতেই মুক্ত হওয়ার সুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। এর আগে ১৯ ও ২০ নভেম্বর মুক্ত হয় শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ। ৬ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় কলারোয়া ও দেবহাটা এলাকা। সেখান থেকে পিছু হটে পাক বাহিনী পারুলিয়া ব্রিজের কাছে প্রতিরোধ করেও ব্যর্থ হয়ে পিছু হটে।
তিনি বলেন, ১৬টি মুখোমুখি ও খন্ড যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় সাতক্ষীরা। লে. বেগ, ক্যাপ্টেন হুদা, লে. আরেফিন, মেজর জলিলের বাহিনী সম্মুখ সমরে ঝাপিয়ে পড়ে। ৭ ডিসেম্বর ভোর বেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদ বাহক সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুরের ছাকুর কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে মাটিয়াডাঙ্গা ক্যাম্প থেকে ১৭ জনের গ্রুপ পুরাতন সাতক্ষীরা হয়ে সাতক্ষীরা কোর্ট চত্বরে পৌঁছায়। এ গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল মহিত খান চৌধুরি দুলু। সেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন আবু নাছিম ময়না। এ গ্রুপে ছিলেন বদরুল, জাহিদ, সাদেক, আবু নাছিম ময়না, আব্দুর রশিদ, আজি, মাহবুব, গফুরসহ অনেকে। মাটিয়াডাঙ্গা ক্যাম্পের মোস্তাফিজ, জজ, মঈদ খানসহ মুজিব বাহিনীর এ দলটি পরে চলে যান খুলনার কপিলমুনি যুদ্ধে। শহরের পশ্চিম দিক থেকে ৮নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ ও ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে সোনা, আব্দুল্লাহ, রফিক, মান্নান শহরে প্রবেশ করে যশোরের মনিরামপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
তিনি আরও জানান, প্লাটুন কমান্ডার নাজমুলের নেতৃত্বে আখড়াখোলার রায়পুর থেকে মিজান, রশিদ, কাদের, দিলীপ, হাসান, মোর্জতা, আব্দার, নজরুলের গ্রুপটি সকাল ১০টায় সাতক্ষীরায় পৌঁছায়। মুজিব বানিহীর উপ-অঞ্চল প্রধান কাজী রিয়াজের নেতৃত্বে আনোয়ার, লিয়াকত, শাহাবুদ্দিন, সরোয়ার, আব্দুর রশিদের দল সরাসরি বিনেরপোতায় যায়। এদিকে এফএফ বাহিনীর প্রধান স ম আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে ৬৫ জন মুক্তিযোদ্ধার দল কপিলমুনি যুদ্ধে যোগ দেন। গেরিলা কমান্ডের পদ্মা গ্রুপের প্রধান সুভাষ সরকারের নেতৃত্বে অতুল, সুশীল, বক্কার, কার্তিক, রমেশের দলটি মাগুরা যুদ্ধ শেষ করে কপিলমুনি পৌঁছায়। লে. (অব) রহমতুল্লা দাদু বীর প্রতীকের নেতৃত্বে পাইকগাছা হাতিয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করে যুদ্ধ করেন কোকিল, আলফাজ, শফি, বজলু, মুজিবর ও গফ্ফার। দীর্ঘ নয় মাসে পাক সেনাদের সাথে সাতক্ষীরা অঞ্চলে যে সকল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেগুলো হলো- তার মধ্যে টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ, ভোমরা যুদ্ধ, কাকডাঙ্গা যুদ্ধ, বসন্তপুর যুদ্ধ ও বেলেডাঙ্গা যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সাতক্ষীরা শহরে পাকিস্তান বিরোধী মিছিলে রাজাকাররা গুলি করলে শহীদ হন আব্দুর রাজ্জাক। এছাড়া মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সাতক্ষীরার যে সমস্ত তরুণ তাদের অমূল্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে শামছুজ্জোহা খান কাজল, নাজমুল আরেফিন খোকন, কমান্ডো সিরাজুল ইসলাম, নারায়ন চন্দ্র ধর, আবুল কালাম আজাদ, জোলযার, হারুনার রশিদ, আনছার আলী, মোজাম্মেল হক, আমিন উদ্দিন গাজী, রফিকুল ইসলাম, আজিজার রহমান, আবু বক্কর গাজী, হাফিজ উদ্দিন, এনামুল হক, আবুল কাশেম, সলিল কুমার, আব্দুল আজিজ, কমান্ডো আব্দুল কাদের, নায়েক সফি চৌধুরি অন্যতম।
এদিকে, দিনটি স্মরণে সকাল সাড়ে ৮টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও র্যালি, সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে শহীদ আব্দুর রাজ্জাকের কবর জিয়ারত, সাড়ে ১০টায় শিল্পকলা চত্বরে লাঠিখেলা ও আলোচনা, বিকাল ৪টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও রাত ৭টায় শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে আতশবাজি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির জানান, ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবসের তাৎপর্য নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তাহলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণায় নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, শহরের সরকারি বয়েজ স্কুলের পাশে একটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। জেলায় যে সব বধ্যভূমি রয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেগুলো সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খুলনা গেজেট/এনএম