খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ শ্রাবণ, ১৪৩১ | ২৭ জুলাই, ২০২৪

Breaking News

  কাপ্তাই হ্রদে গোসল করতে নেমে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু
  ধ্বংসযজ্ঞে জড়িতদের খুঁজে বের করতে জনগণকে সহযোগিতার আহবান প্রধানমন্ত্রীর

আজব (?) এক ডাক্তার

এ এম কামরুল ইসলাম

আমি তাকে চিনি না, তবে নাম জানি। তার চিকিৎসা সেবাও নিয়েছি। তিনি থাকেন আমেরিকায়। একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক।

হয়তো ভাবছেন- চিনি না, জানি না তবু তাকে ‘আজব’ কেন বললাম বা কিভাবে তার চিকিৎসা সেবা নিলাম।

হ্যা, সত্যিই তিনি ‘আজব’ ডাক্তার। অন্ততঃ আমার কাছে তিনি ‘আজব’ ডাক্তার এবং না দেখেই ‘আজব’ মানুষ।

ডাঃ বি এম আতিকুজ্জামান। দীর্ঘদিন আমেরিকায় থেকে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত আছেন। গ্রামের বাড়ি নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার খড়লিয়া মির্জাপুর গ্রামে হলেও দীর্ঘদিন পরিবার পরিজনসহ আমেরিকায় বসবাসের কারণে গ্রামের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। তবু মনেপ্রাণে তিনি খাঁটি বাঙালির মতো দেশ ও গ্রামের জন্য অন্তরে অগাধ মমতা লালন করেন। বিশাল আমেরিকায় তার নিজস্ব এলাকায় অত্যন্ত সুনামের সাথে মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়ে চলেছেন।

ইন্জিনিয়ার ড. সালাম আজাদ দীর্ঘদিন যাবৎ আমেরিকায় থাকেন। ড. সালাম আজাদ ও ডাঃ আতিকুজ্জামান পেশাগত জীবনে আলাদা হলেও পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

ড. সালাম আজাদ আমার অত্যন্ত স্নেহের ছোট ভাই। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আমরা দু’জন দু’জনকে ছাত্রজীবন থেকে ভীষণ পছন্দ করি। ড. সালাম আজাদ ও আমার বাড়ি পাশাপাশি গ্রামে। খুলনা সরকারি বিএল কলেজে পড়াকালীন আমরা পাশাপাশি থাকতাম। ড. সালাম আজাদ থাকতেন তার আপন চাচা বি এম শওকত আলী সাহেবের বাড়িতে। তিনি সম্পর্কে আমার মামা। তবে ঘনিষ্ঠতা ছিল আপন মামার চেয়ে বেশি। ওই বাড়িতে আমরা সময় পেলেই তাসের আড্ডায় বসতাম। ড. সালাম আজাদ কখনো আমার পার্টনার, আবার কখনো আমার প্রতিপক্ষ থাকতেন। ড. সালাম বরাবরই মেধাবি ছাত্র ছিলেন। তাস খেলাতেও তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। তার তুলনায় আমি ছিলাম নিতান্তই সাধারণ।

পড়াশোনার এক পর্যায়ে আমি চলে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর ড. সালাম আজাদ ভর্তি হলেন ঢাকার বুয়েটে। তারপর থেকে দু’জনের আর তেমন যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য ড. সালামের খোঁজ খবর আমি প্রায়ই শওকত মামার পরিবারের মাধ্যমে পেতাম। তার মতো মানুষের খবর পেতে বেশি কষ্ট করা লাগে না। সূর্যের আলো যেমন সকাল হলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি ড. সালাম আজাদের কৃতিত্বের কথা এলাকার সবার মতো আমিও জানতাম।

আমি চাকরির কারণে দেশ বিদেশে থাকি। তাই ড. সালাম আজাদের বাংলাদেশ ভ্রমণের সময়ের সাথে মিল না থাকায় আমার সাথে তেমন দেখা হতো না। তবে আমার চাকরিতে অবসর নেওয়ার পর বছর দুয়েক আগে তার বাড়িতে যাবার খবর পেয়ে তাকে দেখার জন্য সরাসরি গ্রামে হাজির হলাম। আমেরিকা থেকে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য বাড়িতে গিয়ে ড. সালাম তখন গ্রামের মানুষ দেখতে বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তার এক ফাকে সামান্য সময় দেখা করে তৃপ্তি পেলাম না। তাই আমাদের এলাকার স্বনামধন্য ব্যক্তি প্রফেসর ড. আনোয়ার এইচ. জোয়ার্দার সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে খুলনা নর্দান ইউনিভার্সিটিতে পরের দিন কয়েক ঘন্টা একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। সেই অনুষ্ঠানে আমরা সবাই একত্রিত হয়ে দীর্ঘ সময় মনের মতো ভাব বিনিময় করেছিলাম। তারপর তিনি আবার ফিরে যান সেই আমেরিকায়।

এখন আবার ‘আজব’ ডাক্তার সাহেবের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের ঘনিষ্ঠ শত্রু অথচ যাকে ছাড়া আমার চলেই না এমন একজন মহিলা তার সন্তানদের সাথে দেখা করতে মাস দু’য়েকের জন্য আমেরিকা গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক পর্যায়ে সফর শেষ না করেই দেশে ফেরার মনস্থ করেন। এসব কথা শুনার পর আমি নিজেও কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ি। শেষ পর্যন্ত একান্ত নিজের মানুষ ও পরোপকারী জেনে আমি সেই ভদ্র মহিলার কথা ড. সালাম আজাদকে মোবাইলে অবহিত করলাম। তিনি আমার কথা শুনে নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং তার বন্ধু আমেরিকার বিশিষ্ট ডাক্তার বি এম আতিকুজ্জামান সাহেবের নম্বর দিয়ে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে বললেন। তারা দু’জন পরস্পর ঘনিষ্ঠ হলেও আমি অপরিচিত একজন অখ্যাত মানুষ হিসেবে আমেরিকার মতো জায়গায় এতবড় একজন ডাক্তারের সাথে আলাপ করে ফ্রী ফ্রী সেবা নিতে ইতস্তত বোধ করছিলাম। ড. সালাম আজাদ তা নিমিষেই অনুধাবন করে সরাসরি ডাক্তার সাহেবের সাথে আমাকে কনফারেন্স কলে ধরিয়ে দিলেন। আমি রোগীর আদ্যোপান্ত ঘটনা খুলে বললাম। ডাক্তার সাহেব ধৈর্য্য ধরে মন দিয়ে আমার কথা কনফারেন্স কলে শুনে রোগের ঔষধ দিতে পারতেন। কিন্তু না। তিনি তার আরও মূল্যবান সময় নষ্ট করে (হয়তো সামনে রুগী বসিয়ে রেখে) সরাসরি রুগীর সাথে কথা বলতে চাইলেন। আমি সামান্য কুন্ঠিত হলেও স্বার্থপরের মতো তাঁর আরো মূল্যবান সময় নষ্ট করে রুগীকে কনফারেন্স কলে ধরিয়ে দিলাম। একজন পেশাদার ভিজিট নেওয়া আদর্শ ডাক্তারের মতো তিনি পুনরায় রুগীর কাছে আদ্যোপান্ত শুনলেন। এক পর্যায়ে তিনি ঔষধের ফর্দ বলতে শুরু করলেন। ড. সালাম আজাদ, রুগী নিজে ও আমি তার কথা শুনে কোন ঔষধের নাম লিখতে পারছিলাম না। ডাক্তার সাহেব সেটা উপলব্ধি করে বললেন-

আচ্ছা, আমি প্রেসক্রিপশন লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তিনি এও বললেন- আমেরিকায় প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোন ফার্মেসি ঔষধ দিবে না। অতএব আমি এমন দুটো ঔষধের নাম দিবো যা যেকোন বড় শপিং মলে পাওয়া যাবে।

কথা শেষ করেই তিনি তার সুচিন্তিত প্রেসক্রিপশন মোবাইলে লিখে পাঠিয়ে দিলেন। সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঔষধ খেয়ে রুগী সুস্থ হয়ে গেলেন। অতএব রুগীর আমেরিকা সফর সার্থক হলো।

অনেকে হয়তো মনে করবেন- এ আর এমন কি বড় আজব ব্যাপার হলো। এমনতো শত শত ডাক্তার করে থাকেন। এমন ছোটখাটো ঘটনা নিয়ে আবার লেখালেখির কী দরকার।

আমিও তাই মনে করি। পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে এটা একটি সামান্য ঘটনা হলেও আমার কাছে তা ‘আজব’ বলে মনে হয়েছে সেইদিন, যেদিন সেই ডাক্তার সাহেবের সাথে আমার দ্বিতীয়বার আলাপ হয়েছিল।

আমি জানতাম- আমেরিকায় ডাক্তার এবং উকিল সাহেবগন ভীষণ ব্যাস্ত থাকেন। তাঁদের সাথে কথা বলতে হলে আগে থেকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ভিজিট দিয়ে তারপর কথা বলা লাগে এবং এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা। তাইতো ঐ ডাক্তার সাহেবের চিকিৎসায় রুগী সুস্থ হয়ে যাওয়ায় আমি আর তাঁকে ফোন করে বিরক্ত করিনি। অবশ্য ড. সালাম আজাদকে বেশ কয়েকবার জানিয়েছিলাম এবং ডাক্তার সাহেবকে ধন্যবাদ জানাতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি হয়তো সুযোগমতো আমার ধন্যবাদ পৌঁছে দিয়েছিলেন। ড. সালাম আজাদও ভীষণ বিজি মানুষ। তাঁর ব্যস্ততার মধ্যেও আমেরিকার মাটিতে বসে দেশ ও বিদেশের মানুষের জন্য অনেক সেবা করেন। তিনি মাঝে মাঝে পবিত্র কোরানের বিভিন্ন মূল্যবান দিক নির্দেশনা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ লেখা প্রকাশ করে থাকেন।

আমি আজকাল ভীষণ অকেজো একজন মানুষ। একেবারে কোন কাজ করি না বললেই চলে। তারপর আবার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। আমাদের সমাজে মানুষের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত লোকজন নিয়ে এক ধরনের ভীতি আছে। তারা নাকি লোকজন পেলেই নানাভাবে গল্প শুরু করে দেয়। তারপর আর থামতে চায় না। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী হওয়ায় ফলে আমিও এর বাইরে নই। তবুও ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলার অদম্য আগ্রহ থাকলেও নিজেকে বেশ সংবরণ করে রেখেছিলাম। এমন কফি আমার সেই বিশেষ রুগীটি বার বার অনুরোধ করার পরও আমি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলাম- বিনা ভিজিটে তাঁর কাছ থেকে একবার ঔষধ নিতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট করিয়েছি। আমি সালামের মাধ্যমে ধন্যবাদ পৌঁছে দিয়েছি। অতএব পুনরায় ফোন করে তার সময় নষ্ট করার দরকার নেই।

এভাবে ১৫/২০ দিন কেটে গেল। প্রায় প্রতিদিন ডাক্তার সাহেবের কথা মনে করেও কথা বলি না। হঠাৎ মনে হলো তাঁকে অন্তত একটা মেসেজ দিয়ে রাখি। তিনি সময় পেলে হয়তো দেখবেন।

আজকাল হাতের কাছে সবসময় মোবাইল ফোন থাকে। তাই একটা সস্তা মেসেজ দিয়ে ডাক্তার সাহেবের খবর নিয়ে রোগীর সুস্থ থাকার কথা জানিয়ে দিলাম। সাথে সাথে তিনি খুশী হয়ে আমার মেসেজের উত্তর দিলেন। আমিও সুযোগ বুঝে চ্যাটিং শুরু করলাম এবং এক পর্যায়ে তার অনুমতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি অনুমতি দিলেন। আমি তার মোবাইলে কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তাকে ‘আজব’ ডাক্তার বলার কারণটি এখানে খুলে বলি।

তিনি আমার সাথে কথার শুরুতে বললেন- “একজন ডাক্তারের দায়িত্ব হলো- কোন রুগীর সেবা দেওয়ার পর সেই রুগীর পরবর্তী অবস্থা কেমন হলো তার খোঁজ খবর নেওয়া। আমি আপনার রুগীর খবর নিতে পারিনি বা রুগীর বর্তমান অবস্থা জানি না, এজন্য আমি তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। রুগী সুস্থ আছেন শুনে ভাল লাগছে”।

এরপর আমি তার সাথে আরও কথা বলার অনুমতি চাইলে তিনি তার ব্যাস্ততার মধ্যেও অনেক সময় দিলেন। তার গ্রামের বাড়ি ও পরিবার পরিজনের খবরাখবর জানলাম। আমার ভীষণ ভালো লাগলো। সুযোগ পেলে বাংলাদেশে এলে তাকে আমার বাসায় বেড়ানোর জন্য অনুরোধ করলাম।

এসব কিছু মিলে তিনি আমার মতে একজন ‘আজব’ ডাক্তার। কারণ রুগী নিয়ে এমন আন্তরিকতার কথা এর আগে কোন ডাক্তারের মুখে শুনে আমি অভ্যস্ত নই। বিশেষ করে বাংলাদেশে। তাও আবার বিনা ভিজিটে।

সামান্য সময় তার সাথে কথা বলে আমি আরো অন্তরঙ্গ হয়ে গেলাম এবং এক পর্যায়ে তার ফেসবুক আইডি জানতে চাইলে তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর আইডি পাঠিয়ে দিলেন। তার ফেসবুক আইডি দেখে আরো একবার ‘আজব’ ডাক্তার বলতে বাধ্য হলাম। তার আইডি ছিল বাংলায়। দীর্ঘদিন আমেরিকায় বসবাস করেও তিনি বাংলায় ফেসবুক আইডি ধরে রেখেছেন। এবার তাকে শুধু ‘আজব’ ডাক্তার বললে একটু কম কম মনে হয়। তিনি আসলে একজন ‘আজব’ মানুষ। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল।

আমার সেই রুগীর মুখে আরও একটা ঘটনা শুনে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলাম। ডাক্তার আর রুগীর মধ্যে কথোপকথনের সময় এক পর্যায়ে জানাজানি হলো তারা দু’জনে একই বছরে এসএসসি পাশ করেছিলেন। তাই তারা ইয়ারমেট। সুতরাং তাদের আর ‘আপনি আপনি’ করে কথা বলার দরকার নেই। এখন তারা ‘তুমি তুমি’ হয়ে গেছেন।

এই মহান মানুষটির জন্য রইলো আমার টুপিখোলা স্যালুট। বাংলাদেশে কিছু কিছু এমন ডাক্তার হোক এই প্রত্যাশায় রইলাম।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!