বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দমন-পীড়ন, গুম-খুন, জুলাই-আগস্টে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এখন পর্যন্ত ২৩টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর তদন্ত চলমান। তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে।
প্রসিকিউশনের (রাষ্ট্রপক্ষের) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে ১৪১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এসব পরোয়ানা জারি করেছেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত ৫১ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের পর এই ট্রাইব্যুনালেই তাদের আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। এরই মধ্যে চারটি মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ঈদের পরপরই এসব মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে।
এই চারটি মামলার মধ্যে রয়েছে রাজধানীর উপকণ্ঠে সাভারের আশুলিয়ায় হত্যার পর ছয়টি লাশ পোড়ানোর অভিযোগ, রাজধানীর চানখাঁরপুলে চালানো গণহত্যার অভিযোগ, রাজধানীর রামপুরায় চালানো গণহত্যার একটি অভিযোগ এবং শেখ হাসিনা ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগে করা মামলাটি। আশুলিয়ায় হত্যার পর ৬ ছাত্রের লাশ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগে করা মামলাটির বিচার কার্যক্রম আগে শুরু করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘এখন পর্যন্ত চারটি মামলার তদন্ত ফাইনাল স্টেজে (শেষ পর্যায়ে) রয়েছে। একটি মামলার তদন্তের খসড়া আমার হাতে এসেছে। এটি ঘষামাজার কাজ চলছে। যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আশা করছি, এ মাসের শেষে ও আগামী মাসের মধ্যে চারটি মামলার চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট আমাদের হাতে এসে পৌঁছাবে। তদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর এক মাসের মধ্যে আমরা আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব।’
প্রথম কোন মামলাটা দিয়ে বিচার শুরু করবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আমরা যেটার তদন্ত রিপোর্ট হাতে পাব, সেটা প্রথমে আশুলিয়ায় ৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনটা আগে আসবে বলে মনে করছি। এরপর চানখাঁরপুলের হত্যাকাণ্ডের একটি রিপোর্ট পাব, এরপর রামপুরার একটি ঘটনার রিপোর্ট আমরা পাব, এটা পুরো রামপুরার না। রামপুরায় অনেক ঘটনা ঘটেছিল। এরপর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগে করা একটি মামলার তদন্ত রিপোর্ট হাতে পাব। সব তদন্ত রিপোর্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
শেখ হাসিনাকে দিয়ে গণহত্যার বিচার শুরু হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, প্রথম মামলাতে আমরা শেখ হাসিনাকে আনব না। একটি অথবা দুটি মামলার পরে শেখ হাসিনার মামলাটি আনব। প্রথমে একটি স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড মামলা দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সব মামলাতেই শেখ হাসিনা অভিযুক্ত থাকবেন। তবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ওই মামলাগুলোতে প্রসিড করব না। তবে সব মিলিয়ে কমান্ড রেসপনসিবিলিটির মামলায় তাকে অভিযুক্ত করব। সেক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে আমরা প্রসিড করব, তারা হবেন ওই সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ অফিসার অথবা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী অথবা স্থানীয় এমপি অথবা কমিশনার যারা থাকবেন, তাদের দিয়ে বিচার শুরু করব।
শেখ হাসিনাকে দিয়েই গণহত্যার বিচার শুরু হচ্ছে—গণমাধ্যমের এমন খবরের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি সেটাকে ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, চারটি মামলার তদন্ত রিপোর্ট প্রায় একই সময়ে আসবে। তবে বিচার শুরুর ক্ষেত্রে আমরা শেখ হাসিনাকে এক নম্বরে আনতে চাই না। একেবারেই একটি স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড মামলা দিয়ে আমরা বিচার শুরু করব। প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে পর্যাপ্ত ডিজিটাল এভিডেন্সের পাশাপাশি জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্টও সাপোর্টিং ডকুমেন্টস হিসেবে কাজ করবে বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর।
‘আশুলিয়ায় ৬ লাশ পোড়ানোর সেই লোমহর্ষক ঘটনা’
ছাত্র আন্দোলনে বিজয়ের দিন ৫ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নিপীড়ক পুলিশ, স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলাম ও তার ক্যাডার বাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে আশুলিয়ায় নিহত হন অন্তত ৩১ জন। পরদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ১৫ জন মারা যান। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল দেড় হাজারের বেশি মানুষ। যাদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। সাভার ও আশুলিয়ায় ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা যায় অন্তত ৭৫ জন। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে লাশ পোড়ানোর একটি ভিডিও। মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও লোমহর্ষক ওই ঘটনায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ছিল ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের। ভিডিতে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকাদের দুজন পুলিশ সদস্যের একজন হাত ও একজন পা ধরে ভ্যানে একটি লাশ নিক্ষেপ করছেন। সর্বশেষ লাশটি তুলে একটি ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। শেষে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি দেখা মেলে। ভিডিওর ১ মিনিট ৬ সেকেন্ডে একটি পোস্টার দেখা যায়, যা স্থানীয় ধামসোনা ইউনিয়ন সভাপতি প্রার্থী ও ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী আবুল হোসেনের। সেই পোস্টারটি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ভিডিওটির ঘটনাস্থল আশুলিয়া থানার আশপাশে। পুলিশ লাশগুলো তাদের থানার সামনে নিয়ে যায়। সেখানে একটি পুলিশভ্যানে লাশগুলো রেখে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় গত ১১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি অভিযোগ করা হয়। দুটি অভিযোগই অভিন্ন হওয়ায় একটি মামলা হয়। এ মামলায় গত ২৪ ডিসেম্বর স্থানীয় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এ মামলায় সাইফুল ইসলাম পলাতক থাকলেও ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, তৎকালীন ওসি এ এফ এম সায়েদ, ডিবি পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক এবং কনস্টেবল মুকুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ মাসের শেষে অথবা আমাগী মাসের প্রথম সপ্তাহে এ মামলাটির তদন্ত প্রাতবেদন দাখিল করা হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ মামলার তদন্তে স্পষ্ট এভিডেন্স রয়েছে, ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। আসামিও বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে। তা ছাড়া ঘটনাটিও অত্যন্ত অমানবিক ও নির্মম। এ কারণে প্রসিকিউশন এ মামলাটির বিচার প্রথমে করতে যাচ্ছে।
‘চানখাঁরপুল গণহত্যা’
৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুলে নির্বিচারে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের গুলিতে দশম শ্রেণির ছাত্র আনাসসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। একটি ভিডিও থেকে দেখা যায়, গত ৫ আগস্ট বেলা ১১টায় চানখাঁরপুলে বোরহানউদ্দিন কলেজের পাশে সুজন হোসেন কখনো দাঁড়িয়ে বা কখনো শুয়ে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে এই ভিডিও ভাইরাল হয়। পরে আনাসের বাবা পলাশ প্রসিকিউশন বরাবরে একটি আবেদন করেন।
এ মামলার ব্যাপারে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ৫ আগস্ট গেন্ডারিয়ার বাসা থেকে গোপনে বেরিয়ে চানখাঁরপুলে আন্দোলনে যোগ দেয় দশম শ্রেণির ছাত্র আনাস। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে। আমরা কিছু ভিডিও পেয়েছি, কীভাবে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সেখানে অলিগলিতে ঢুকে গুলি করেছে। তিনি বলেন, আনাস বাসা থেকে গোপনে বের হওয়ার সময় তার স্কুলের খাতায় বাবা-মায়ের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে আসে। চিঠিতে সে বলে, ‘আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে গর্বিত হইয়ো। জীবনে প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।’ এ ঘটনায় তার বাবা পলাশ প্রধানমন্ত্রীসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন।
গত ১ জানুয়ারি চানখাঁরপুলে পাঁচজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পুলিশের কনস্টেবল সুজন হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১২ জানুয়ারি তাকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। পরে এ মামলায় অভিযুক্ত শাহবাগ থানার তৎকালীন ওসি (তদন্ত) আরশাদ হোসেন ও কনস্টেবল ইমাজ হোসেন প্রামাণিককে যথাক্রমে ২ মার্চ ও ৩ মার্চ এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এ মামলায় প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২২ এপ্রিল দিন ধার্য রয়েছে।
‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির মামলায় হাসিনা ও মামুন’
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার উদ্যোগ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৭ অক্টোবর থেকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯ অক্টোবর প্রথমবারের মতো শুনানি হয় ট্রাইব্যুনালে। গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলাটি করা হয় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এ মামলায় তাকে একাই আসামি করা হয় এবং সেদিন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার জন্য সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগ আনা হয়। সর্বশেষ গত সোমবার এ মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার (১৬ মার্চ) এ আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের বলেছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে একটা মামলা আছে। তার সঙ্গে আসামি হিসেবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে যুক্ত করে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়েছিল। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তা মঞ্জুর হয়েছে। ফলে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে সহ-আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলেন। এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে এক দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তাজুল ইসলাম। তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা দেখেছি, শেখ হাসিনার যে কমান্ড রেসপনসিবিলিটি, তার সবকিছু বাস্তবায়নের ডান হাত ছিলেন তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সে কারণে তাকে এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
খুলনা গেজেট/ টিএ