খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ঝিনাইদহে ২ ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ট্রাক চালকের মৃত্যু
  ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাই : জামায়াত আমির
  অ্যান্টিগা টেস্ট: প্রথম দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলল ২৫০, বাংলাদেশ পেল ৫ উইকেট

আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন : জুলাই থেকে বাড়বে ঋণের সুদ

গেজেট ডেস্ক

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিকল্প হিসাবে চালু হবে বাজারভিত্তিক সুদের হার। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক লন্ডন আন্তঃব্যাংক অফার রেটের (লাইবর) মতো একটি কাঠামো তৈরি করছে। এর আওতায় সরকারের বিভিন্ন ট্রেজারি বন্ডের গড় সুদের হারকে ভিত্তি ধরা হবে। এর সঙ্গে ৩ বা ৫ শতাংশ যোগ দিয়ে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদের হার নিরূপণ করবে। এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে নির্ধারিত হবে আমানতের সুদহার।

এ প্রক্রিয়ায় ঋণের সুদের হার নিরূপণ করলে তা এক লাফে ৩ থেকে ৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। কোনো কোনো ব্যাংকে আরও বেশি বাড়বে। সব মিলে আকাশ ছোঁবে সুদের হার। উল্লেখ্য, বর্তমানে সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ।

একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের নীতিনির্ধারণী সুদের হার নিরূপণের বিষয়ে একটি করিডর তৈরি করবে। এর ভিত্তিতে সময়ে সময়ে নীতিনির্ধারণী সুদের হারে পরিবর্তন আনা হবে। এছাড়া এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে ব্যাংকগুলো ঋণ ও আমানতের সুদের হারে পরিবর্তন আনবে। নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঋণের সুদের হার ২ থেকে ৩ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখন কাঠামো তৈরির কাজ করছেন। আগামী জুলাইয়ে নতুন অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় ঋণের সুদের হারের বিষয়ে এ কাঠামো ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকগুলোকে কিছু সময় দিয়ে এ নীতি কার্যকর করা হবে। এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ, ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর কাঠামো ঘোষণা করা হবে। এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সুদের হারের বিষয়ে এটিই হবে প্রথম আন্তর্জাতিক মানের একটি নীতি। কিন্তু এ নীতিতে সুদের হার এক লাফে ৩ থেকে ৫ শতাংশ বাড়তে পারে।

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, ঋণের সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।বেসরকারি খাতের বিকাশ হুমকির মুখে পড়বে। এমনিতেই গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। সুদের হার বাড়লে খরচ আরও বাড়বে। কাজেই কোনো ক্রমেই ঋণের সুদের হার বাড়ানো ঠিক হবে না।

সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া আছে। আইএমএফ এ সীমা আগামী জুনের মধ্যে প্রত্যাহার করার শর্ত দিয়েছে। এ সীমা তুলে দিয়ে সুদের হারকে লাগামহীনভাবে বাড়তে দিতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কারণে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশে উঠেছিল।

সেই অভিজ্ঞতা থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নীতিকাঠামোর আওতায় রেখে এ হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে চায়। এজন্য একটি কাঠামো তৈরির কাজ শুরু করেছে। সরকারের ৫টি বন্ড রয়েছে বাজারে। এসবের মাধ্যমে সরকার ঋণ নেয়। এগুলো হচ্ছে ২, ৫, ১০ ও ২০ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সরকার ট্রেজারি বন্ড।

এর মধ্যে ২ বছর মেয়াদির ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, ৫ বছর মেয়াদির ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ, ১০ বছর মেয়াদির ১২ দশমিক ১২ শতাংশ, ১৫ বছর মেয়াদির ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এসব বন্ডের গড় সুদের হার দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। কয়েক মাস আগে এসব বন্ডের গড় সুদের হার ছিল সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে। সরকারের ঋণের চাহিদা বাড়ায় বন্ডের সুদের হারও বাড়ছে।

ওই গড় সুদের হারের সঙ্গে ব্যাংকভেদে ৩ থেকে ৫ শতাংশ যোগ করে ঋণ দিতে হবে। এ হিসাবে ঋণের সুদের হার দাঁড়াচ্ছে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ, যা বর্তমানে বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সুদের হারের চেয়ে ৩ থেকে ৫ শতাংশ বেশি। কোনো কোনো ব্যাংক বর্তমানে সাড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশ সুদেও ঋণ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে সুদের হার এক লাফে সাড়ে ৪ থেকে ৬ শতাংশ বাড়ছে।

এদিকে আমানতের সুদের হারও বাড়বে। বর্তমানে গড়ে আমানতের সুদের হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ। কোনো কোনো ব্যাংক ১২ শতাংশ সুদে স্থায়ী আমানত নিচ্ছে। ওইসব ব্যাংকে ঋণের সুদের হারও বেশি।

বর্তমানে লন্ডন ইন্টার ব্যাংকে ৬ মাস মেয়াদি ডলার বন্ডের গড় সুদের হারকে ভিত্তি ধরে ২ থেকে ৫ শতাংশ যোগ করে বিভিন্ন দেশ বা সংস্থা বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোও এ নীতিতে বায়ার্স ক্রেডিট বা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নিতে গ্রাহককে গ্যারান্টি দিচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো তাদের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট (ওবিইউ) বা বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায়ই তা ঋণ হিসাবে বিতরণ করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এ ধরনের ঋণ দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক মানের সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু হলে কোনো সমস্যা হবে না। এতে সরকারের ঋণ গ্রহণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ পদ্ধতিতে সুদহারজনিত ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমবে।

কিন্তু এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এ ধরনের আন্তর্জাতিক নীতি প্রয়োগের সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর নেই। এ নীতিতে ঘন ঘন সুদহারে পরিবর্তন আসবে। ফলে গ্রাহকরাও বিভ্রান্ত হবে।

এ ধরনের নীতি প্রয়োগের আগে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তা না হলে এর সুফল মিলবে না।

সূত্র জানায়, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে আমানতের গড় সুদহার ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। আমানতের গড় সুদের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। ওই হারে জমা টাকার ক্ষয় হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ফি ও সরকারি কর কেটে নেওয়া হয়। ফলে টাকার ক্ষয় আরও বেড়ে যায়।

বর্তমানে ঋণের গড় সুদহার ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমানতের গড় সুদ ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ঋণের সুদ ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। নতুন পদ্ধতি আরোপের কারণে সুদের হার আরও বাড়বে।

আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী আগামী জুনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করার শর্ত ছিল। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী জুলাই থেকে করবে। তবে এর জন্য একটি কাঠামো তৈরি করবে। গ্রস রিজার্ভের সঙ্গে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের তথ্য তুলে ধরবে।

বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। গ্রস রিজার্ভ ৩ হাজার ১০৬ কোটি ডলার। জুলাইয়ে রিজার্ভ আরও কমে যেতে পারে। আইএমএফ-এর মতে, নিট রিজার্ভ ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারে নামতে পারে। তখন ওই রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।

কিন্তু আইএমএফ বলেছে, কমপক্ষে চার মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ রাখতে হবে। এজন্য নিট রিজার্ভ প্রয়োজন হবে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।

ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ২০০৩ সালের মে থেকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। কিন্তু এটি কখনোই কার্যকর ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপেই এর দাম নির্ধারিত হতো। এবার আইএমএফ-এর শর্তে ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

তবে এর দামের ওপর ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তখন ডলারের দাম আরও বাড়বে। বর্তমানে আমদানির জন্য ডলার কেনার অফিসিয়াল দর আছে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা। কিন্তু এ দামে বেশির ভাগ ব্যাংকেই ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ১০৫ থেকে ১২২ টাকা তারা ডলারের দাম রাখছে।

সূত্র জানায়, আইএমএফ-এর শর্ত বাস্তবায়ন করতে আগামী অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখানকার মুদ্রানীতিতে শুধু বিভিন্ন খাতে মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়। আগামী মুদ্রানীতিতে এগুলোর পাশাপাশি কিছু মৌলিক নীতি থাকবে। যার আলোকে সুদের হার ও ডলারের দর নির্ধারিত হবে।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!