আমন ধানের চালে এই সময়ে ভরপুর থাকে বাজার। এ কারণে দামের পারদও নামার কথা। তবে রেকর্ড আমন উৎপাদনেও এবার চালের দরে উল্টোবাঁক। বছরের শুরুতে ভরা মৌসুমে চালের বাজারে কেন এমন ‘লু হাওয়া’ বইছে, তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। বাজার নিয়ন্ত্রণে দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান শুরু করেছে সরকার। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না।
চাল সরবরাহে টান না থাকলেও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকা– সর্বত্র চড়েছে দাম। পাইকার আর মিলার, দু’পক্ষই পরস্পরকে দাম বাড়ার পেছনের ‘অনুঘটক’ ভাবছে। কেউ কেউ দোষ চাপাচ্ছে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও লাইসেন্সহীন মজুতদারদের ওপর।
এদিকে উৎপাদন ভালো হওয়ায় এ বছর চাল আমদানিতে নজর দেয়নি সরকার। খাদ্যগুদামেও দিন দিন কমছে মজুত। এ পটভূমিতে চালের বাজার আরও বেসামাল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, দাম বাড়ার এ সময়ে উৎপাদন এলাকার মিলার ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ধান-চাল কিনে গুদামে ভরছে। কেউ কেউ নিজের মিলের বাইরে গোপন স্থানেও ধান-চাল লুকিয়ে রাখছে।
তবে ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দুষলেও ভরা মৌসুমে চালের অস্বাভাবিক দরে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। তারা বলছে, কেউ দায় স্বীকার করে না। সবাইকে আইনের আওতায় আনলে বোঝা যাবে, বাজার কার নিয়ন্ত্রণে। তবে সরকার সেদিকে নজর দিচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বাজারের নাটাই আসলে কার হাতে– খতিয়ে দেখার দাবি ক্রেতাদের।
কেজিতে বেড়েছে কত?
খোদ সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে সরু চাল ৫ দশমিক ৩৮, মাঝারি চাল প্রায় ৩ ও মোটা চালের দর প্রায় ৪ শতাংশ বেড়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরু (মিনিকেট) চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়, যা সপ্তাহ দুয়েক আগে বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায়। কেজিতে বেড়েছে সর্বোচ্চ ৭ টাকা। মাঝারি (বিআর-২৮, পায়জাম) চাল কেজিতে সর্বোচ্চ ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায়। এ ছাড়া কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা কেজি।
পাইকাররা দুষছে মিলারদের
দাম বাড়ার জন্য পাইকাররা দায়ী করছে মিলারদের। তবে মিলাররা বলছে, অবৈধ মজুতদারের কারণে দর বাড়ছে। কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী ইসমাইল অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন বলেন, মিলারদের কারসাজি রয়েছে। ধান পাওয়া যাচ্ছে না– এমন ছুতায় কয়েক দিন ধরে দাম বাড়াচ্ছে তারা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শহিদ উল্লাহ বলেন, চালের বাজারে করপোরেট প্রতিষ্ঠান হানা দিয়েছে। তারা মিল ও কৃষক থেকে লাখ লাখ বস্তা চাল কিনে গুদামে মজুত করছে। সরকারি নজরদারি না থাকায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের গুদামে অভিযান চালালে মজুতের বাস্তব চিত্র বেরিয়ে আসবে।
লাইসেন্সহীন ব্যবসায়ীরাও কম যাচ্ছে না
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শহিদুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, এখন চালের ভরা মৌসুম। এ সময়ে দাম বাড়া রহস্যজনক। তবে এর পেছনে মূল কারণ লাইসেন্সহীন মজুতদারের কারসাজি।
তিনি বলেন, কেউ কেউ আছে সরকারি লাইসেন্সের তোয়াক্কা না করে মজুতদারি ব্যবসা করছে। এরাই এখন মূল খেলোয়াড়। সরকারের খাতায় তালিকাভুক্ত নয় বলে তারা তদারকির বাইরে। আগামী দু-এক মাস পর তাদের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে মিলারদের।
তাঁর ধারণা, বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ধান কৃষকের কাছে, ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ মিলারদের কাছে এবং বাকি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ধান রয়েছে মজুতদারের কাছে। মিলাররা ধান ভাঙিয়ে চাল বিক্রি করলেও মজুতদারের কাছে তা রয়ে যাচ্ছে।
করপোরেট সিন্ডিকেট
বাজারের অস্থিরতার পেছনে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের আধিপত্যকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ।
নির্বাচনের পর আট-দশ দিনের ব্যবধানে চাল কি হাওয়া হয়ে গেছে? এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান চালের বাজারে ঢুকেছে। সিন্ডিকেট করে তারা কৃষকের কাছ থেকে এবং মিলগেট থেকে ধান-চাল কিনে নিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো নিজেদের ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি করে বাজার অস্থির করে তুলছে।
তাঁর ভাষ্য, সারাবছরই নানা জাতের ধান উৎপাদন হয়। সরকার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে কখনোই চাল আমদানি করতে হবে না।
এ বছর আমদানি হয়নি
এ বছর ভারত চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। তবে বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়েনি। কারণ, ফলন ভালো হওয়ায় সরকার আমদানির অনুমতি দেয়নি। গত অর্থবছরে মোট চাল আমদানি হয়েছিল ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন।
উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াবে
এই আমন মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। এখন পর্যন্ত ৯৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। তাতে মোট উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ ৫৬৯ হাজার টন চাল। এ মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবু উৎপাদন বেশ ভালো। এমন ইতিবাচক ফলনে কৃষি কর্মকর্তাদের ধারণা, এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে উৎপাদন।
কমছে সরকারের মজুত
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এ অর্থবছরের শুরুতে গত জুলাইয়ে সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত ছিল ১৯ লাখ ৮৪ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ছিল ১৭ লাখ ৬০ হাজার টন এবং গম ২ লাখ ২৪ হাজার টন। গত ছয় মাসের ব্যবধানে মজুত কমেছে প্রায় সোয়া তিন লাখ টন। এখন মজুত আছে ১৬ লাখ ৫৮ হাজার ৬২৪ টন খাদ্য। এর মধ্যে চাল রয়েছে ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪৮ টন। তবে গত বছরের জানুয়ারিতে খাদ্যশস্যের মজুত ছিল আরও বেশি। ওই সময় ১৯ লাখ ৫৭ হাজার টন খাদ্যশস্য ছিল সরকারি গুদামে।
এ ব্যাপারে খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠান যারা চালের ব্যবসা করছে, তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।’
উৎপাদন এলাকাতেও অস্থিরতা
বোরো ধানের মতো আমন ধান কাটা শুরুর পরপরই সক্রিয় হয়ে ওঠে ফড়িয়া বা দালালরা। সরকারি দামের চেয়ে বেশি দিয়ে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুতদারকে দিচ্ছে তারা। এতে কৃষকের কষ্টের ফসল গোলার বদলে যায় গুদামে। তাতে একদিকে যেমন চালের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যে চাল এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬০ টাকা, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। গত বছরের চেয়ে এ বছর চালের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ।
বগুড়ার বিভিন্ন খুচরা বাজারে কাটারি জাতের নতুন চাল ৬৫ থেকে বেড়ে ৭০ টাকা, নতুন কাটারি ৬২ থেকে বেড়ে ৬৬ টাকা, মোটা গুটিস্বর্ণা ৪৫ থেকে বেড়ে ৫০, বিআর-২৮ জাতের চাল ৫২ থেকে বেড়ে ৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে গড়ে সব ধরনের চাল কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে।
কাহালুর কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, ‘ধারদেনা করে ধানের আবাদ করি। ফড়িয়ারা মাঠ থেকে কিনে নিচ্ছেন। মিলে দিতে গেলে নানা ঝক্কি। এত যত্নের ধান গোলায় তুলতে না পেরে কষ্ট হচ্ছে। তার পরও ঋণ তো শোধ দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘মাঠে আর ধান নেই। এখন বাজারে যেটুকু ধান পাওয়া যাচ্ছে, তা কৃষকরা অতি ঠেকায় পড়ে বিক্রি করছেন।’
দুপচাঁচিয়ার চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল সাখিদার ফেরদৌস বলেন, করপোরেট কোম্পানিগুলো অসম প্রতিযোগিতায় নেমে বেশি দামে ধান কিনছেন। এ ছাড়া দেশে নিষেধাজ্ঞা আসছে– এমন গুজব ছড়িয়ে ধান কিনে অনেকে মজুত করছেন। এ কারণে বাজারে ধান ও চালের দাম মণপ্রতি গড়ে ২০০ টাকা বেড়েছে।
বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি দামে ধান কিনেছে। আর বাজারে যে পরিমাণ চালের প্রয়োজন ছিল, তা সরবরাহ করা হয়নি। এ কারণে দাম কিছুটা বেড়েছে।
এদিকে জয়পুরহাটের মিলাররা ধানের দর বাড়ার অভিযোগ করলেও কৃষকরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে দাম বাড়েনি। কৃষকের দাবি, তারা আগের দরেই ধান বিক্রি করছেন। অথচ চালের দর বাড়ানো হচ্ছে। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভ হচ্ছে চালকল মালিক ও মজুতদারদের।
পাঁচশিরা বাজারের চাল বিক্রেতা আবদুল আজিজ আকন্দ বলেন, এখন সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৫-৬ টাকা করে বেড়েছে। এখন চিকন কাটারি চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৬৬ টাকায়। এ ছাড়া স্বর্ণা-৫ (মধ্যম) ৫২ টাকা এবং আটাশ ৪৭-৪৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
জয়পুরহাট হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল বারী জানান, ধানের দাম প্রতি মণে ১৮০-২০০ টাকা বেড়েছে। ফলে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৫ টাকা।
জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রতন কুমার রায় বলেন, কেউ অতিরিক্ত মুনাফা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রংপুরে মোটা চালের দামও ৫৫ টাকা ছাড়িয়েছে। এ অস্বাভাবিক দর বাড়ার পেছনে কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন জেলার পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বড় অটো রাইস মিল মালিকরা কম দামে ধান কিনে মজুত করে শৈত্যপ্রবাহসহ নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়েছেন।
রংপুরের মিল চাতাল মালিক, চাল ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা ও কৃষকদের অভিযোগ, উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৬০০ অটো রাইস মিল মালিক ইচ্ছামতো মজুত করে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। রংপুরের মাহিগঞ্জ, দিনাজপুরের পুলহাট, বগুড়া, নওগাঁ ও রাজশাহী থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক চাল দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। এসব মোকামে কয়েক দিন থেকে অটো রাইস মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বাজারে অভিযান
এদিকে গতকালও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ, খিলগাঁও ও ঠাঁটারীবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। যাত্রাবাড়ীতে কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক নির্দেশে আটাশ চালের কেজিতে এক টাকা কমাতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে গতকাল দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে মজুত করা ২৭০ টন ধান জব্দ করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে গুদাম সিলগালা করা হয়েছে। উপজেলার পাইকপাড়ার ওরিয়েন্টাল এগ্রোর একটি গুদামে এ অভিযান চালায় খাদ্য অধিদপ্তর।