আবেদন করার পর যথাযথ প্রক্রিয়ায় দ্রুততম সময়ে অবসরকালীন টাকা পাওয়ার কথা শিক্ষকদের। কিন্তু দীর্ঘ জটিলতায় আটকে আছে শিক্ষকদের টাকা। আগে ছিল লাল ফিতার দৌরাত্ম্য আর এখন সরকার পরিবর্তন হলেও সরকারি তহবিলে অর্থসঙ্কট এবং ব্যাংকের তারল্য সঙ্কটের অজুহাতে নিজের অবসর ভাতা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকার জন্য হন্যে হয়ে পথে পথে ঘুরছেন ৩৫ হাজার শিক্ষক। তাদের মধ্যে অধিকাংশই বৃদ্ধ এবং অসুস্থ।
শিক্ষকদের এই সঙ্কট সমাধানে যাদের উদ্যোগ নেয়ার কথা সেই পুরনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অনেকেই এখন লাপাত্তা। ফলে শিক্ষকদের এই টাকা প্রাপ্তি নিয়ে তৈরি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যানের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা প্রফেসর এ বি এম রেজাউল করীম জানিয়েছেন, ট্রাস্টের কর্মকর্তা পর্র্যায়ে শিগগিরই পুনর্গঠন হবে। আর অর্থসঙ্কটের বিষয়টিও সমাধান হবে। আশা করছি শিক্ষকদের এই দুর্ভোগ আর বেশি দিন থাকবে না।
অপরদিকে অবসর বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ৩৫ হাজারের বেশি শিক্ষকের আবেদন জমা পড়ে আছে। এগুলো নিষ্পত্তি করতে তিন হাজার কোটি টাকা দরকার। কিন্তু ফান্ডেতো এত টাকা নেই। ফলে আবেদনকারীদের কেউ টাকার বিষয়ে খোঁজ নিতে এলে তাদের পরে আসতে বলা হচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে বোর্ডের সচিব নিয়মিত না থাকায় অনেক সমস্যার সমাধানও করা যাচ্ছে না।
সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষকদের অবসর বোর্ডের টাকা প্রাপ্তিতে এখন বড় সমস্যা হচ্ছে ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট। কেননা অবসর বোর্ডের টাকা রাখা হয়েছে তিনটি ব্যাংকে। সেগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক এবং অগ্রণী ব্যাংক। আর কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা রাখা হয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে। বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক কিছুটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে থাকলেও বাকি দুটি ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট থাকায় এসব ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফার করতে ভয় পাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম বলেন, নতুন কমিটির জন্য উপদেষ্টার কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সেটি অনুমোদন হলেই কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে এখন আছে এক হাজার কোটি টাকার মতো। এটা দিয়ে তো আমরা কিছু করতে পারব না। আমরা উপদেষ্টাকে টাকা দেয়ার কথা বলেছি। এটি দিলে সব শিক্ষক টাকা পেয়ে যাবেন।
অবশ্য শিক্ষকদের অভিযোগ, অবসরের পর শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের টাকা পেতে পদে পদে ভোগান্তির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এই দুই ফান্ডের টাকা পেতে বছরের পর বছর দফতরে দফতরে ঘুরতে হয় বলে বরাবরই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। চাকরিকালীন সময়ে প্রতি মাসে দুই ফান্ড মিলিয়ে বেতন থেকে কেটে রাখা নিজেদের দশ শতাংশ টাকা পেতেই গলদঘর্ম হতে হয় তাদের। টাকার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অসুস্থতাজনিত কারণে অনেক শিক্ষকের মৃত্যুও হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন বরাবরই শিক্ষকদের এই দু’টি ফান্ডে টাকার সঙ্কট থাকে। এর সাথে এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট। নানা অনিয়মের কারণে সম্প্রতি অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়া এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও হত্যা মামলায় কারান্তরীণ আনিসুল হকের মালিকানাধীন সিটিজেনস ব্যাংকে কল্যাণ ও অবসর ফান্ডের অধিকাংশ টাকা জমা আছে। কিন্তু এই দু’টি ব্যাংকই বর্তমানে রুগ্ণ দশায় নিপতিত। গত মঙ্গলবার রাজধানীতে পাওনার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরা।
সূত্র মতে, অবসরে যাওয়ার পর এককালীন কিছু আর্থিক সুবিধা পান বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। আর এই সুবিধা পেতে চাকরিকালীন তাদের প্রতি মাসের এমপিও (বেতন-ভাতার সরকারি অংশ) থেকে অবসর ও কল্যাণ ফান্ডে যথাক্রমে ৬ ও ৪ শতাংশ করে টাকা কেটে রাখা হয়। বিধান অনুযায়ী সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর প্রতি মাসের এমপিও থেকে চাঁদা বাবদ কর্তন করা কোটি কোটি টাকা জমা থাকার কথা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। সেখান থেকে সুদ পাওয়া যায়। ফলে জমা টাকার মূলধন বাড়ে। পদাধিকার বলে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি শিক্ষাসচিব। আর ২১ সদস্যের কমিটির দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হলেন সচিব। যিনি মূলত কোনো এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ।
উল্লেখ্য সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের বেশি। তাদের অবসর ও কল্যাণসুবিধা দেয়া হয় দু’টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে কল্যাণ সুবিধার টাকা দেয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে। আর অবসর সুবিধার টাকা দেয়া হয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আগের অবসর সুবিধা বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। বিশেষ করে বোর্ডের সচিব শরীফ আহমদ সাদী গত ৫ আগস্ট থেকে অফিসে অনুপস্থিত। এমন পরিস্থিতিতে অবসর সুবিধা বোর্ড পুনর্গঠন জরুরি হয়ে উঠেছে।
খুলনা গেজেট/এইচ