খুলনা, বাংলাদেশ | ৩ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৮ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ১৬ ডিসেম্বর ঘিরে কোনো ধরণের হামলার শঙ্কা নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  মহাখালীতে সড়ক-রেললাইন অবরোধ শিক্ষার্থীদের, সারা দেশের সঙ্গে ঢাকার ট্রেন চলাচল বন্ধ
আশ্রমে এখনো ৪৫টা বাচ্চা আছে

অপারেশনের নামে হাত-পা কেটে পৈশাচিক আনন্দ পেতেন মিল্টন সমাদ্দার

গেজেট ডেস্ক

পথে, রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা গরিব ও অসহায় মানুষকে তুলে এনে আশ্রয় দেওয়া হতো ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমে। তাদের কারও কারও হাত-পায়ে পচনও ধরেছিল। যখন প্রয়োজন হতো অপারেশন তখন আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার নিজে ব্লেড ছুরি দিয়ে তাদের হাত, আঙুল কেটে ফেলতেন। রক্ত ঝরিয়ে, অপারেশনের নামে হাত-পা কেটে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করতেন মাদকাসক্ত মিল্টন সমাদ্দার।

রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় করা মামলায় তিনদিনের রিমান্ড শেষে রোববার (৫ মে) দুপুরে মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে মিল্টন সমাদ্দারকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত লোমহর্ষক তথ্য সম্পর্কে জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের মতো সাইকোপ্যাথিক মানুষ কীভাবে মানবতার ফেরিওয়ালা হয়? তা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি যে নির্যাতন করে, ব্লেড ছুরিতে নিজেই অপারেশন করতেন, টর্চার সেলে মানুষকে পেটাতেন তাদের যে বানর বলে অভিহিত করতেন, পিটিয়ে নিস্তেজ করতেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে, এসব করে তিনি পৈশাচিক আনন্দ পেতেন। আমরা তার টর্চার সেল থেকে আলামত জব্দ করেছি। কথিত অপারেশন থিয়েটার থেকে ব্লেড ছুরি জব্দ করেছি।

তিনি বলেন, মিল্টন সমাদ্দার ভয়াবহ অপরাধ করেছেন। একটি দুটি অপরাধ করেননি, তার বিরুদ্ধে উঠা সব অভিযোগ তো ভয়াবহ। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তার অ্যাকাউন্টে এখনো ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা আছে। এতোগুলো টাকা থাকার পরও তিনি কাউকে চিকিৎসা করাননি। তিনি নিজেই হয়ে গেছেন অপারেশন থিয়েটারের হেড। তার অপারেশন থিয়েটারে থাকতো একটা ছুরি ও কিছু ব্লেড। তিনি এগুলো দিয়েই নিজেই অপারেশন করাতেন। এরকম ভয়াবহ, অমানবিক আচরণ, অসভ্য আচরণ, এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্যই তো লজ্জাজনক। যারা তার সঙ্গে জড়িত, যারা পেট্রোনাইজ করেছে, সহযোগিতা করেছে, ফেসবুকে ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য যারা পেট্রন করেছে, ফাউন্ডেশনের মেম্বার তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, যে ছেলেটা সেই উজিরপুর থেকে বাবা পিটিয়ে ঢাকায় এসে ঔষধের দোকানে চুরি করেছে, এরপর একটা আশ্রম গড়ে তোলেন। যেখানে তিনি অসহায়, গরিব শিশু, বৃদ্ধ, প্যারালাইজড, বাকপ্রতিবন্ধী, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে সংগ্রহ করে আশ্রমে নিতেন। তাদের দেখিয়ে তিনি ফেইবুকে ফলোয়ারের মাধ্যমে টাকা ইনকাম করতেন। সেই টাকা আবার তিনি খরচ করতেন না।

তার আশ্রমে ৯০০ লোক মারা গেছে বলে নিজেই প্রচার করতেন উল্লেখ করে হারুন অর রশীদ বলেন, মানুষগুলো মারা গেছেন। জানাজা হলো না, রাতের অন্ধকারে কবর দেওয়া হলো, আত্মীয়-স্বজনকে জানানো হলো না, মিথ্যাভাবে সিল স্বাক্ষর দিয়ে নিজেই ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন, বানিয়েও রেকর্ডে রাখলেন না, পরেও স্বজনদের জানালেন না, এসবই আমাদের তদন্তে আসবে।

যেসব শিশু তার আশ্রমে ছিল তাদের খোঁজ পাওয়ার পর দেখা করতে দেওয়া হতো না স্বজনদের। ওই শিশুদের ক্ষেত্রে আসলে কি ঘটেছিল? বিক্রি করতো? কিছু পেয়েছেন আপনারা? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবিপ্রধান বলেন, একটু ধৈর্য ধরেন সবই বেড়িয়ে আসবে। এরকম আরও যেসব মিল্টন সমাদ্দার বাংলাদেশে যদি আরও থেকে থাকে, তথাকথিত মানবতার ফেরিওয়ালা নামে যারা এ ধরণের অপকর্ম করে থাকে তাদের ব্যাপারেও খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।

মিল্টন সমাদ্দার নিজেই বলেছেন, ৯০০ লোকের প্রাণ নিভে গেল! কীভাবে নিভে গেল? তিনি তো তাদের হাসপাতালে নেননি, ডেথ সার্টিফিকেটও নেননি, থানা পুলিশকে অবহিত করেননি। আবার ৯০০ লোকের প্রাণ যাওয়ার যে কথা তিনি বলেছেন, সেটা আদৌ সত্য কিনা, নাকি এটা টাকা ইনকামের একটা কথার কথা! সত্য হলে কি করেছেন। সব তদন্তে নিয়ে আসব। এই আশ্রমের সঙ্গে আরও যারা যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

৯০০ লোকের মৃত্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন সমাদ্দার ডিবি পুলিশকে জানিয়েছে, আসলে ৯০০ মানুষ মরেনি। তাহলে কতজন মারা গেছে? বলেন ১৩৫ জন মারা গেছে। তাদের দাফন করেছি। সেটারও তিনি রেজিস্টার্ড সংগ্রহে রাখেননি। যারা মারা গেলেন তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়নি। এতোগুলো মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে অবশ্যই তাকে জবাব দিতে হবে।

হারুন বলেন, অটিজম শিশুদের সঙ্গে যা করা হয়েছে তা লজ্জাজনক। কারণ বঙ্গবন্ধুর নাতনি প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম নিয়ে সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অফিসের (ডব্লিউএইচওএসইএআরও) আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন বৈশ্বিক অটিজম বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল)। আর সেই দেশে অটিজমের নাম ধারণ করে অসহায়, বাক প্রতিবন্ধী ভারসাম্যহীন মানুষ সংগ্রহ করে ফেইসবুকে প্রচার করে ফলোয়ারদের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করেছেন। অন্যদিকে তিনি সেই টাকা খরচও করেননি। এটা তো লজ্জাজনক।

তাকে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি কীভাবে ডেথ সার্টিফিকেট দিতেন। আমরা তো সেখানে যাতায়াত করা ডাক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তিনি বলেছেন, মিল্টন সমাদ্দার তার সিল স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ডেথ সার্টিফিকেট দিতেন। যা তিনি জানতেন না। মিল্টন সমাদ্দার নিজেও তা স্বীকার করেছেন। তিনি নাকি মানবতার ফেরিওয়ালা। এসব অপকর্ম করে কীভাবে একজন মানুষ মানবতার ফেরিওয়ালা হয়?

‘আশ্রমে ৪৫টা বাচ্চা আছে, ডিবিকে বলেন নিয়ে যেতে’

‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমে বর্তমানে ৪৫ জন শিশু আছে বলে আদালতকে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার। শুনানির একপর্যায়ে তিনি বলেন, আশ্রমে বর্তমানে ৪৫টা বাচ্চা আছে। ডিবিকে বলেন তাদের নিয়ে যেতে।

এরপর তাকে মানবপাচার আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোসহ সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক শিকদার মাইতুল আলম। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেরা মাহবুব তাকে মানবপাচার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন। এছাড়া শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম শান্তা আক্তারের আদালত তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এদিন মিল্টনের আইনজীবী আব্দুস সালাম শিকদার আদালতে বলেন, যে বাচ্চাকে কেন্দ্র করে মামলাটি করা হয়েছে সেই বাচ্চাকে আশ্রমের বাবুর্চি লিখিত স্ট্যাম্প দিয়ে দত্তক নিয়েছেন। ১৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে তার কোনো সন্তান না হওয়ায় তিনি বাচ্চাটিকে দত্তক নিয়েছেন। এসময় ফিরিস্তি যোগে সেই স্ট্যাম্প আদালতে দাখিল করেন আইনজীবী।

এর আগে বেলা ১টার দিকে মিল্টন সমাদ্দারকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়। এসময় তাকে সিএমএম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়।

গত ২ মে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জাল মৃত্যু সনদ তৈরির অভিযোগে মিরপুর মডেল থানার মামলায় মিল্টনের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

এর আগে ১ মে রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তার বিরুদ্ধে জাল মৃত্যু সনদ তৈরি, টর্চার সেলে মানুষজনকে নির্যাতন ও মানবপাচারের অভিযোগে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়।

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি শেরেবাংলা নগর থানাধীন ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের সামনে দুই বছরের এক শিশুকে পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর তিনি থানায় ফোন করেন। কিন্তু থানা পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে ফোন করলে মিল্টন সমাদ্দার ওই শিশুকে নিয়ে যান। তখন বাদী নিজেও তাদের সঙ্গে যান। মিল্টন সমাদ্দার তাকে (বাদী) অজ্ঞাতনামা শিশুর অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে মিল্টন সমাদ্দারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে শিশুটিকে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে ভর্তি করা হয়। এরপর মিল্টন সমাদ্দার জানান, আদালতের মাধ্যমে শিশুটিকে দত্তক নেওয়া যাবে।

এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ একদিন ফোন করে মিল্টন সমাদ্দার আমাকে গালাগাল করেন এবং বলেন আমি যেন তার প্রতিষ্ঠানে আর না যাই, শিশুটির খোঁজখবর না নিই। এরপর আরও বেশ কয়েকজন ফোন করে আমাকে হুমকি দেন ও ভয়ভীতি দেখান। প্রাণভয়ে আমি আর সেখানে যাইনি। সম্প্রতি একটি খবর চোখে আসার পর গত ২৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিশুটিকে পাওয়া যায়নি। শিশুটি কোথায় আছে, সে ব্যাপারেও সদুত্তর মেলেনি। বাদীর অভিযোগ, শিশুটিকে পাচার করা হয়েছে।

এদিকে মিল্টন সমাদ্দারের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে মিরপুরের পাইকপাড়া এবং বরিশালের উজিরপুরের সাধারণ মানুষজন। এছাড়া গত বুধবার রাতেই রাজধানীতে আনন্দ মিছিল করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠন। গ্রেপ্তারের পর থেকেই ভুক্তভোগীদের অনেকে মিল্টনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

উল্লেখ্য, রাজধানীর মিরপুর থেকে গত বুধবার রাতে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মিরপুর জোনাল টিম। তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মিরপুর মডেল থানায় ৩টি মামলা করা হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলার প্রস্তুতি চলছে।

গত বৃহস্পতিবার মিল্টনকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমে জাল মৃত্যুসনদ দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

খুলনা গেজেট/এএজে

 

 

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!