স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে রাজধানীর বায়তুল মোকাররমসহ সারা দেশে হামলা ও তাণ্ডব চালানোর অভিযোগে করা মামলার সব বিষয় খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সত্য-মিথ্যা যাচাই শেষে অপরাধ প্রমাণিত হলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকসহ ১৭ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সোমবার দিবাগত রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্টন থানায় আরিফ-উজ-জামান নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তিনি মামলায় ১৭ জন এজাহারনামীয় আসামিসহ দুই থেকে তিন হাজার অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেছেন। মামলায় বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করে সংবিধান লঙ্ঘন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস ও সরকার উৎখাতের পরিকল্পনার অভিযোগও আনা হয়েছে।
পুলিশের দাবি, মামলা করার সময় আরিফ-উজ-জামান একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। পরে পুলিশ জানতে পারে আরিফ-উজ-জামান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক। মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) এনামুল হক মিঠু এ তথ্য জানান।
মামলার এজাহারে নাশকতা ও হামলার নির্দেশদাতা ও এক নম্বর আসামি করা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও খেলাফতে মজলিসের মহাসচিব হিসেবে মামুনুল হককে। মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে শুধু হেফাজতের ১৭ নেতাকর্মীর কথা বলা হয়নি, জামায়াত-শিবির-বিএনপির মৌলবাদীদের কথাও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, সবাই মিলে গোপন বৈঠকে বসে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিলেন। সে অনুযায়ী সারা দেশে তাণ্ডব চালায় দুই থেকে তিন হাজার জন।
এডিসি এনামুল হক মিঠু বলেন, ‘মামুনুল হকসহ যাদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা হয়েছে, পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যাদের নির্দেশনায় হামলার কথা বলা হচ্ছে, তারা নির্দেশ দিয়েছিলেন কি না, তারা হামলার সময় বাইতুল মোকাররমে উপস্থিত ছিলেন কি না, তা যাচাই করা হবে। মামলায় সরকার উৎখাতের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে, সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।’
এনামুল হক মিঠু বলেন, ‘গতকাল রাতে মামলাটি ব্যবসায়ী পরিচয়ে একজন করেছেন। পরে আমরা জানতে পেরেছি বাদী একজন যুবলীগনেতা। সুতরাং মামলাটিতে তদন্তের অনেক কিছু রয়েছে। বাদী ঢালাওভাবে অভিযোগ করেছেন। আমরা মামলার পুরো অভিযোগের বিষয়ে জানতে কাজ করছি।’
‘মামলায় জামায়াত-শিবির-বিএনপিকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তারা গোপনে মিটিং করেছিল কি না, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। আমরা বাইতুল মোকাররমের চারপাশে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখব। মোদ্দাকথা, এই মামলার সব বিষয় তদন্ত করে দেখা হবে। তদন্ত শেষে বাদীর অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত মামুনুল হকসহ সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে কে কোন দল করে, তা দেখা হবে না। পুলিশ দেখবে ব্যক্তির অপরাধ।’
মামলার আসামিরা হলেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা ফলায়েদ আল হাবিব, মাওলানা লোকমান হাকিম ও নাসির উদ্দিন মনির, নায়েবে আমির মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, মাওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী (ঢাকা), মাজেদুর রহমান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মাওলানা হাবিবুর রহমান (লালবাগ, ঢাকা), মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, সহকারী মহাসচিব মাওলানা জসিম উদ্দিন (লালবাগ), সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মাসুদুল করিম (টঙ্গী), অর্থ সম্পাদক মুফতি মনির হোসাইন কাশেমী, প্রচার সম্পাদক মাওলানা যাকারিয়া নোমান ফয়েজী, মাওলানা ফয়সাল আহমেদ (মোহাম্মদপুর, ঢাকা), সহকারী দাওয়াহ সম্পাদক মাওলানা মুশতাকুন্নবী, ছাত্র ও যুব সম্পাদক মাওলানা হাফেজ মো. জোবারের ও দপ্তর সম্পাদক মাওলানা হাফেজ মো. তৈয়ব।
মামলার এজাহারে বাদী আরিফ-উজ-জামান বলেন, গত ২৬ মার্চ শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আমি বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যাই। ফরজ নামাজ শেষে মসজিদের ভেতর কিছু উচ্ছৃঙ্খল, ধর্মান্ধ ব্যক্তিকে জুতা প্রদর্শনসহ বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান দিতে দেখি। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে বাইরে উত্তর গেটের সিঁড়িতে কয়েক হাজার জামায়াত-শিবির, বিএনপি, হেফাজতের উগ্র মৌলবাদী ব্যক্তিদের উচ্ছৃঙ্খল জমায়েত দেখতে পাই।
আরিফ-উজ-জামান বলেন, তাদের স্লোগান ও কথোপকথন থেকে জানতে পারি যে, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বে শীর্ষ স্থানীয় জামায়াত-শিবির, বিএনপি, হেফাজতের নেতারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে দেশি-বিদেশি সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিকে বানচাল করতে সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করে।
এজাহারে বলা হয়েছে, তারা দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রসহ দা, ছুরি, কুড়াল, কিরিচ, হাতুড়ি, তলোয়ার, বাঁশ, গজারি লাঠি, শাবল ও রিভলবার, পাইপগানসহ অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সাধারণ মুসল্লিদের ওপর হামলা করে।
আরিফ-উজ-জামান অভিযোগ করেন, হেফাজতের নেতা মাওলানা মামুনুল হকের নির্দেশে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব তাঁর হাতে থাকা লোহার রড দিয়ে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় আঘাত করেন। পরে তিনি আমার ডান হাঁটু পিটিয়ে জখম করেন। এ সময় আমি মাটিতে পড়ে গেলে মাওলানা লোকমান হাকিম ও নাসির উদ্দিন মনির তাঁদের হাতে থাকা বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করেন। একপর্যায়ে মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া তাঁর হাতে থাকা ধারালো কিরিচ দিয়ে আমার মাথার পেছনে আঘাত করেন। পরে নুরুল ইসলাম জিহাদী বাঁশের লাঠি দিয়ে বাম বাহুতে পেটান।
স্থানীয় জনতার শক্ত প্রতিরোধের কারণে হেফাজতের নেতাকর্মীরা পিছু হটে এবং দুটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া তারা টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের আশপাশের দোকানে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। আসামিরা বায়তুল মোকাররমসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।
খুলনা গেজেট/এনএম