বিচার বিভাগের ২৭ জায়গায় সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এ বিষয়ে গঠিত কমিশনপ্রধান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে নীতিমালা তৈরি, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস বিধিমালা প্রণয়ন, দেওয়ানি-ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন, অবকাঠামো সংস্কার এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান গতকাল রোববার সমকালের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন।
ঢাকায় বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের কমিশন কার্যালয়ে তিনি বলেন, অংশীজনের গ্রহণ করা মতামত যাচাই-বাছাই করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। সেটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।
শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান জানান, বিচারপ্রার্থী মানুষের হয়রানি ও খরচ কমানোর উপায় খুঁজে বের করতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের প্রস্তাবনা পাঠাবে কমিশন। পাশাপাশি সারাদেশে আদালতে বিচারাধীন থাকা মামলাজট কমানো ও উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হবে। এর পাশাপাশি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস বিধিমালা তৈরির কাজ চলছে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে হাতে নেওয়া একগুচ্ছ কাজ সবটা শেষ করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম চলমান থাকা উচিত। খণ্ডকালীন নয়, স্থায়ী কমিশন থাকা উচিত। সমস্যা হচ্ছে, সমাধান করতে হবে। আগামীতে কী ধরনের সমস্যা হবে, আগে থেকে বলা যাচ্ছে না।
মামলাজট, বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি, আদালতে এজলাস সংকটসহ নানা সমস্যা থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব সমস্যা এক দিনে সমাধান করা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে করতে হবে। আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশনকে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। এই স্বল্প সময়ে কতটুকু করতে পারব, তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তা ছাড়া আমাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে কিনা, সেটাও জানি না। তবে আমাদের কাজ অব্যাহত রয়েছে। বিচার বিভাগের জন্য একটা কিছু করে দিতে পারলে মনে সান্ত্বনা থাকবে।
জানা গেছে, বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে গত ৩ অক্টোবর গঠন করা হয় এ কমিশন। এর পর থেকে কমিশনের সদস্যরা গতকাল পর্যন্ত ৩০টির বেশি বৈঠক করেছেন। কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করার পাশাপাশি আইনজীবী, বিচারকসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে কমিশন। গত সোমবার ঢাকায়, বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে, আজ সোমবার সিলেটে অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করবে কমিশন।
এ সময় বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও অংশীজনের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া সহজীকরণ, মানবাধিকার সুরক্ষায় বিচার বিভাগের ভূমিকা, বিচারাঙ্গনকে নারী ও শিশুবান্ধব করা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ও আইনগত সহায়তা কার্যক্রমকে কার্যকর করা এবং বিচারপ্রার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করা হয়।
অংশীজন উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, সৎ ও যোগ্য পিপি এবং জিপি নিয়োগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার প্রস্তাব করেন। তারা মামলাজট নিরসনে উন্নত মামলা ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেন।
সভায় জাতীয় মহিলা সংস্থা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিস ট্রাস্ট, ব্র্যাক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ, মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম, অধিকার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন, বি-স্কান, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, রূপান্তর, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কালেক্টিভ, বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম, নারীপক্ষ, এসিএলএবি, আইপিডিএস, হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন, ইউএনডিপি, ইউএন ওমেন, ইউএনএইচসিআর, ইউএনওডিসি, সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি ইন দ্য ন্যাশনাল কলসালটেশন ও আইওএম অংশ নেয়।
এদিকে গতকাল জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ জাতীয় আইনজীবী সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় করে কমিশন।
মতবিনিময়ের পর বাংলাদেশ জাতীয় আইনজীবী সমিতির সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মোহাম্মদ খসরুজ্জামান বলেন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন, বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় স্থাপন, মাসদার হোসেন মামলার রায় পূর্ণ বাস্তবায়নসহ ১৭ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছি।
এর আগে প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনালের কার্যালয়, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, ইউএনডিপি, ইউএস এমবাসি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এবং ঢাকা আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা, বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় স্থাপন, শৃঙ্খলা বিধিমালা বাতিল এবং বিচার বিভাগের জন্য আলাদা বাজেট করার প্রস্তাবনা দিয়েছি। তা ছাড়া মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হলে তদন্ত করে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করেছি।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে দীর্ঘদিনের বিতর্কের সমাধান করতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের বিষয়ে সুপারিশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে সংস্কার কমিশন। এ কমিশন শুধু বিচারক নিয়োগই নয়, তাদের শৃঙ্খলার বিষয়টিও দেখভাল করবে। এ কমিশন-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে সম্প্রতি মতবিনিময় করেছে কমিশন।
মতামত দেওয়ার সময় বাড়ল
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন (জেআরসি) অংশীজনের মতামত নেওয়ার জন্য একটি ওয়েবসাইট চালু করে। গত ২৩ নভেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে মতামত দিতে হবে।
গতকাল রোববার পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মতামত দেওয়ার সময় আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কমিশনের ই-মেইলে (bangladeshirc@gmail.com; info@jrc.gov.bd) অথবা কমিশনের ঠিকানায় (বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ১৫ কলেজ রোড, ঢাকা-১০০০) প্রস্তাব পাঠানো যাবে।
খুলনা গেজেট/এইচ