সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, কাঁধে ব্যাগ, হাতে লাঠির বয়োবৃদ্ধ সুনীতি কুমার বিশ্বাসকে (১৮.১০.১৯২৭-০৮.০৫.২০২১) গত ছয়-সাত বছর ধরে চিনতাম। নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতি ও মুর্শিদাবাদ জেলা সাংবাদিক সংঘের অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখেছি। মুখোমুখি হলেই শ্রদ্ধাবনত হয়েছি। নবতিপর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর শারীরিক সক্ষমতা ও মানসিক সজীবতা দেখে আশা করেছিলাম তিনি হয়তো শতায়ু হবেন। কিন্তু হল না, করোনায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তবে তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবন তাঁকে কিংবদন্তির পর্যায়ে উন্নীত করেছে, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সুনীতি কুমার বিশ্বাসের জন্ম এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর জন্মের এক বছরের মধ্যেই তাঁর বাবা পুলিশ অফিসার ললিত মোহন বিশ্বাস হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সেই সময় তাঁর অন্য চার ভাইবোনের বয়স ছিল সাত থেকে ষোলো বছরের মধ্যে। স্বামীর অকাল ও আকস্মিক প্রয়াণে তাঁর মা নগেন্দ্রবালা বিশ্বাস বহরমপুরের সরকারি বাসা ছেড়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে হাসানপুরে ভাইয়ের বাড়িতে চলে আসেন। কিন্তু এখানে তাঁদের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। বহরমপুরের ব্যাঙ্কে নিরাপদে রাখার নাম করে সুনীতিবাবুর মায়ের সংগ্ৰহে থাকা প্রায় দেড়শো ভরি সোনার গহনা তাঁর এক মামা নিজের জিম্মায় নিয়ে নেন, যা আর তাঁরা কখনও ফেরত পাননি। সুনীতিবাবুর দশ বছর বয়সের মধ্যেই তাঁর দুই দিদির বিয়ে হয়ে যায় এবং তাঁর দুই দাদা বহরমপুরে নিজেদের মতো ব্যবস্থা করে থাকতে শুরু করেন। হাসানপুরে তিনি একাই মায়ের সঙ্গে থাকেন। দুঃসহ অভাব-অনটনের মধ্যে তাঁদের দিন কাটে। মা-ছেলেকে অনেকদিন অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হয়। সেই কঠিন দিনগুলো সম্পর্কে সুনীতিবাবু লিখেছেন, “আমি আর আমার মা ধামা আর দাউলি নিয়ে মাঠে যেতাম গরুর ঘাস সংগ্ৰহ করতে। প্রায় সারা বছরই এ কাজ করতে হত।”
সুনীতিবাবু ১৯৩৮ সালে হাসানপুর মাইনর স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু পরবর্তী তিন বছর অর্থাভাবের কারণে কোনও হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। ১৯৪১ সালের শেষ দিকে হাসানপুরের জমিদার প্রকাশ চৌধুরীর অসুস্থ স্ত্রীর দেখভাল করার জন্য সুনীতিবাবুর মাকে বহরমপুরে আসতে হয়। এখানে ঘাটবন্দরের একটি ভাড়া বাড়িতে আগে থেকেই তাঁর ছোড়দা বিনয় বিশ্বাস থাকতেন। তিনি জনগণনার কাজে যুক্ত ছিলেন আর টিউশনি করতেন। ১৯৪২ সালে সুনীতিবাবু হার্ডিঞ্জ স্কুলে (বর্তমানে মণীন্দ্রচন্দ্র বিদ্যাপীঠে) সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় চোখের কঠিন পীড়া নিয়ে পরীক্ষা দিয়েও ১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীতে ম্যাট্রিক পাস করেন। ইন্টারমিডিয়েট বা আইসিএস পরীক্ষায় কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে তিনি ইংরেজি, ফিজিক্স ও অঙ্কে সর্বোচ্চ নম্বর পান এবং এই রেজাল্টের ভিত্তিতে একাধিক স্কলারশিপ ও সরকারি স্টাইপেণ্ড লাভ করেন। কিন্তু অনার্সের জন্য বাড়তি দু’টাকা ফিজের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়ে পাস কোর্সে বি এস সি-তে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় ভাকুড়ির মেয়ে মেনকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পরে ‘সুনীতি’র সঙ্গে মিলে রাখতে স্ত্রীর নতুন নামকরণ হয় ‘মিনতি’।
১৯৫০ সালে ডিস্টিংশন নিয়ে সুনীতিবাবু ডিগ্ৰি কোর্স কমপ্লিট করেন। ছাত্রাবস্থায় লাঠি, বক্সিং ও কুস্তি খেলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। ওই সময় বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থেকে পূর্বোক্ত খেলাগুলোর প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা আয়োজনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালেও তাঁর নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চার অভ্যাস ছিল।
স্নাতক হওয়ার অব্যবহিত পরেই তিনি হাসানপুরে সদ্য গড়ে ওঠা হাইস্কুলে অস্থায়ী ভাবে শিক্ষকতা শুরু করেন।এ ই সময় নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে যাচাই করার জন্য বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসা তাঁর নেশা হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরনের একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫০ সালে পুজোর ছুটির পর খাদ্য দপ্তরের অধীনে মাসিক ২০০ টাকা বেতনের চাকরিতে যোগদান করেন। কিন্তু মাস পাঁচেক পরেই ঐ সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি অপেক্ষাকৃত অনেক কম মাইনের স্কুল মাস্টারির কাজে ফিরে আসেন। এ ব্যাপারে আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, “শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনও পেশায় যুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্তটা আগেই নিয়ে ফেলেছিলাম।” ১৯৫১ সালের ১ এপ্রিল সুনীতিবাবু অমৃতকুণ্ড কে কে বিদ্যাপীঠে বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ওই বছরই ১০ আগস্ট তিনি খাগড়া বয়েজ হাইস্কুলে (১৯৫৭ সাল থেকে নাম হয় গুরুদাস তারাসুন্দরী ইন্সটিটিউশন- জি টি আই) চলে আসেন। ১৯৫৪-৫৫ বর্ষে তিনি বহরমপুর ইউনিয়ন খ্রিস্টান ট্রেনিং কলেজ থেকে বি টি পড়েন এবং ১৯৬০ সালে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্ৰি অর্জন করেন। ১.১০.১৯৬২ থেকে ৩১.৩.১৯৬৩ পর্যন্ত ৬ মাস তিনি কাশিমবাজার মণীন্দ্রনগর হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার পর পুনরায় জি টি আই-এ সহকারী শিক্ষক পদে ফিরে আসেন।
১৯৭৭ সাল থেকে দশ বছর সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৪ সালের ৩০ নভেম্বর অবসর গ্ৰহণের দিন পর্যন্ত প্রধানশিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন। তাঁর নেতৃত্বে স্কুলের খেলাধুলা, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল- সবকিছুতেই উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। বরাবর সাদা রংয়ের পোশাক পরিধান আর বিদ্যালয়ের সকল কাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করার জন্য ছাত্র মহলে তিনি White Tiger উপাধি লাভ করেন।
সুনীতিবাবু একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার লক্ষ্যে সর্বদা অবিচল থেকেছেন। তিনি খাগড়া বয়েজ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষককে বলেছিলেন, “স্যার, আমাকে রুটিনে দৈনিক সব কটা পিরিয়ডেই ক্লাস দিয়ে দেবেন।” স্কুলের প্রার্থনা সভায় তাঁর উপস্থিতি ছিল প্রায় একশো শতাংশ। শ্রেণীকক্ষে ঢুকতে কখনও দেরি করতেন না এবং পাঠদানের বিষয়ে যথেষ্ট তৈরি থাকতেন। তিনি জিনগত ভাবেই অঙ্কশাস্ত্রে দক্ষ ছিলেন। লালগোলা এম এন একাডেমির প্রধান শিক্ষক ও ‘Some Novel Methods in Arithmetic’ গ্ৰন্থের লেখক তাঁর মেজোমামা হরিচরণ চৌধুরী গণিত শাস্ত্রে অসাধারণ দক্ষতার জন্য বাংলার সর্বত্র প্রভূত সম্মান লাভ করেন। তাঁর ছোড়দা বিনয় বিশ্বাস ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কম্পালসারি ও অ্যাডিশনাল- দুই অঙ্কেই একশো শতাংশ নম্বর পান।
যাইহোক, বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পড়ানোর জন্য সুনীতিবাবু বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয় নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। শিক্ষকতা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মূল্যায়ন হল, “এক কথায় স্কুল জীবনের প্রায় চুয়াল্লিশ বছর আমি খুবই উপভোগ করেছি।” তবে ১৯৬৬-এর খাদ্য আন্দোলন থেকে ১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত তাঁর কাছে রাজনৈতিক কার্যকলাপই প্রাধান্য পেয়েছিল। এই এক দশক শিক্ষকতার ক্ষেত্রে কিছু বিঘ্ন ঘটার কথা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা ছিল না তাঁর।
অমৃতকুণ্ড কে কে বিদ্যাপীঠে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের এক সপ্তাহের মধ্যেই সুনীতিবাবুকে নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির সদস্য করে নেওয়া হয়। তিনি সেই সদস্যপদ আমৃত্যু নিয়মিত নবীকরণ করেন এবং সমিতির বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন। ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত এ বি টি এ-র জেলা সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি সন্তোষ ভট্টাচার্যকে পুনর্নিয়োগ করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন যেটি আশ্চর্যজনক ভাবে নাকচ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, এ বি টি এ-র আহ্বানে ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে দু’দিনের কর্মবিরতি পালন করার জন্য হার্ডিঞ্জ হাইস্কুলের শিক্ষক বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা সন্তোষ ভট্টাচার্যকে ‘৫০ সালের জানুয়ারি মাসে বরখাস্ত করা হয়। পরে ১৯৫২ সালে সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে। ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক কর্মবিরতির কর্মসূচিকে সামনে রেখে মুর্শিদাবাদ জেলায় আন্দোলন পরিচালনার জন্য পাঁচজনের যে সংগ্ৰাম পরিষদ গঠিত তার অন্যতম সদস্য ছিলেন সুনীতিবাবু। ১৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রাজপথে একজন আন্দোলনকারী হিসেবে তিনি গ্ৰেফতারবরণ করেন এবং সত্যপ্রিয় রায় ও অনিলা দেবী সহ সমিতির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কারাগারে থাকেন। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনশন সত্যাগ্ৰহে তিনি মুর্শিদাবাদ জেলা কেন্দ্রে মূল অনশনব্রতী হন। অনশনের পঞ্চম দিন বিকেল পাঁচটার পর তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং তিন ঘণ্টা পর হাসপাতালে তাঁর জ্ঞান ফেরে। আসলে ওই কর্মসূচির কিছুদিন আগে তিনি প্লুরিসি রোগে আক্রান্ত হন এবং শারীরিক দুর্বলতা দূর হতে না হতেই চিকিৎসকদের নিষেধ সত্ত্বেও শুধুমাত্র মানসিক শক্তিকে সম্বল করে অনশনে বসে পড়েন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি সমিতির জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।তাঁর সময়েই সমিতির বর্তমান জেলা কার্যালয় নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তবে জেলা সম্পাদক হিসেবে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে সুনীতিবাবু খুব একটা খুশি ছিলেন না।এ সম্পর্কে তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “আমি ভাল জেলা সম্পাদক ছিলাম না। সময় দিতে পারতাম না।হাড়ে হাড়ে বুঝতাম আমার সীমাবদ্ধতার কথা।”
১৯৫১ সালে অমৃতকুণ্ড কে কে বিদ্যাপীঠে যোগদানের কিছু দিনের মধ্যেই সুনীতিবাবু সি পি আই দলের সদস্যপদ লাভ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর বড়দা নরেন বিশ্বাস কমিউনিস্ট লীগের (অধুনা আর সি পি আই) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ১৯৩৭ সালে তিনি কৃষক সভার জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। যাইহোক, ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ হলে সুনীতিবাবু সি পি আই এম-এ যোগ দেন। ১৯৬৭ সালের শুরু থেকেই তিনি কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত হন এবং পরবর্তী দশটি বছর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন গড়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন।একাধিকবার তাঁর বিরুদ্ধে গ্ৰেফতারি পরোয়ানা জারি হয় এবং তিনি আত্মগোপন করেন। সাতের দশকের প্রথমদিকে যখন অতি-বামপন্থী নকশালদের হাতে মূল ধারার বামপন্থী নেতাকর্মীরা খুন হন তখন সুনীতিবাবুকেও টাগেট করা হয়। একদিন জি টি আই-এ পাঠদান চলাকালে জানালার উপর পেট্রল বোমা ছোঁড়া হয়। আলো জ্বলে ওঠে।ছাত্রদের চেঁচামেচির মধ্যেই দুষ্কৃতীকে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি চ্যালেঞ্জ করেন, তৎক্ষণাৎ সে ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে যায়।সেই সময় স্কুল বিল্ডিংয়ের সর্বত্র আলকাতরা দিয়ে লেখা হয়- “সুনীতি বিশ্বাসকে খুন কর।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘৭১ সালের ৪ জানুয়ারি মণীন্দ্রচন্দ্র বিদ্যাপীঠের শিক্ষক কনকজ্যোতি রায় ও ৬ এপ্রিল সন্তোষ ভট্টাচার্য খুন হন। সুনীতিবাবু ১৯৭০ সালে নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুবাদকের ভূমিকা পালন করেন। এই সম্মেলনেই সি আই টি ইউ গঠিত হয় আর সুনীতিবাবু রাজ্য কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে কেরল ও বোম্বের শ্রমিক সম্মেলনেও তাঁকে বাঙালি প্রতিনিধিদের বোঝার সুবিধার জন্য অবাঙালি নেতৃবৃন্দের ইংরেজি বক্তৃতা বাংলায় অনুবাদ করার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।তিনি একাধিকবার সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলনেও প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন।পার্টির জেলা নেতৃত্বের মধ্যে তীব্র মতানৈক্যের জেরে ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের প্রাক্কালে সি পি আই এম-এর সঙ্গে সুনীতিবাবুর সম্পর্ক ছিন্ন হয়। ২০০২ সালে তিনি পুনরায় পার্টির সদস্যপদ গ্ৰহণ করেন এবং আমৃত্যু তা বহাল থাকে।
সুনীতিবাবু ছিলেন একজন খাঁটি সমাজকর্মী। যেকোনো সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হতে ভালোবাসতেন। সুস্থ সমাজ-প্রকৃতি গড়ে তোলার আহ্বানকে কখনও উপেক্ষা করতেন না। নব্বইয়ের দশকে জেলায় সাক্ষরতা অভিযানে সুনীতিবাবু অগ্ৰণী ভূমিকা পালন করেন। স্টুডেন্টস হেলথ হোম বা ছাত্র-স্বাস্থ্য আন্দোলনেরও তিনি একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংগঠন পিপলস রিলিফ কমিটির আজীবন সদস্য ছিলেন। জনবিজ্ঞান আন্দোলনেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ১৯৯৫ সালে তাঁকে বিজ্ঞান মঞ্চের আজীবন সদস্য করা হয়। ‘মা ও শিশুর সুরক্ষা’ তাঁর অত্যন্ত প্রিয় বিষয় ছিল। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে সমাজ থেকে কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক মানসিকতা ও ধর্মান্ধতার ক্ষতিকর প্রভাবগুলো দূর করতে সচেষ্ট হন। পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার উপর তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। জীবনাবসানের মাত্র কিছুদিন আগে বহরমপুর শহরের জলাভূমিগুলো যথেচ্ছ ভাবে ভরাট করে তার উপর বহুতল নির্মাণের প্রতিবাদে প্রয়োজনে আমৃত্যু অনশন করার কথা বলেন তিনি।
সুনীতিবাবু খুব বড় একজন পাঠক ছিলেন। বিদ্যালয়ে সফলভাবে পাঠদানের প্রয়োজনে যেমন পড়তেন তেমনি শুধুমাত্র অজানাকে জানার আগ্ৰহেও পড়াশোনা করতেন। মার্কসবাদকে আত্মস্থ করতে বহু বইপত্র অধ্যয়ন করেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিবন্ধ-প্রবন্ধ রচনাতেও তাঁর দক্ষতা ছিল। জেলা ও রাজ্যের নানান পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে। ২০১৬ সালের শেষ দিকে লেখেন আত্মজীবনীমূলক গ্ৰন্থ ‘রক্তে-ঘামে আঁকা জীবনের আলপনা’। করোনা অতিমারির কোপে গৃহবন্দী জীবনের মানস-ক্রিয়ার ফসল হিসেবে তাঁর লেখা পুস্তিকা ‘ভারতীয় প্রেক্ষাপটে মার্কসীয় অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ’ প্রকাশিত হয় ২০২১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে। আজ স্মরণ করতে খুব ভালো লাগছে ও গর্ব হচ্ছে যে, ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলা সাংবাদিক সংঘে আমার লেখা ‘মুর্শিদাবাদ: সংসদীয় রাজনীতি’ শীর্ষক পুস্তক প্রকাশ অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন অলংকৃত করেছিলেন এই মহান মানুষটিই।
আশৈশব পিতৃহীন সুনীতিবাবুর মাতৃভক্তি ছিল অতুলনীয়। ১৯৬১ সালে পক্ষাঘাতগ্ৰস্ত হয়ে পড়া ৬৬ বছর বয়সী মায়ের সেবাশুশ্রূষা করার ব্যাপারে তিনি যে কর্তব্যবোধের পরিচয় দেন তার কোনও তুলনা হয় না। সুনীতিবাবুর কথাতেই তাঁর মাতৃসেবার বর্ণনা করে এই শ্রদ্ধার্ঘ-রচনা শেষ করবো- “মাকে দেখভাল করার পুরো দায়িত্ব আমার উপর, মাঝে মাঝেই বিছানায় পায়খানা, প্রস্রাব করে ফেলেছেন মা। নিজ হাতে সে সময় এসব পরিষ্কার করে মাকে চিন্তামুক্ত হতে দেখে আমি যেন বেশ স্বস্তি পেতাম। আমার স্ত্রীকে এসব ক্ষেত্রে কিছু করতে দিতাম না। এ যেন জন্মের ঋণ শোধ করা।”
খুলনা গেজেট/ এস আই