নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর জাতি স্বাধীনতা লাভ করে। শত্রুমুক্ত হয় তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ নামক ভূ-খন্ড। ভৈরব ও রূপসা বিধৌত খুলনার বিজয় আসে একাত্তরের সতের ডিসেম্বর। সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার শ্যামনগর থেকে শরণখোলা পর্যন্ত মুক্ত বাতাসে উড়তে থাকে স্বাধীনতার পতাকা। পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-নির্যাতনের অবসান হয়। রাজাকারদের দাপট কবরের সাথে মিশে যায়। জাতি বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়ে। মুক্তিপাগল মানুষের কণ্ঠে শ্লোগান ‘জয় বাংলা’, স্বাধীনতা এনেছি, শেখ মুজিবকে আনব।
সতের ডিসেম্বর বিজয়ের পর খুলনার সাব-জেল থেকে বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। হাজতি ও কয়েদিরা জেলখানা থেকে ছাড়া পায়। নতুন করে কারাবন্দী হয় রাজাকার, আলবদর ও পাকিস্তানি সেনারা। বাহাত্তরের জানুয়ারির প্রথম থেকে স্বাভাবিক জীবনযাত্র ফিরে আসে। শহরের বড় বাজার, নতুন বাজার, চিত্রালী বাজার ও দৌলতপুর বাজারে পণ্য বেচাকেনা হয় পাকিস্তানি ও ভারতীয় মুদ্রায়। স্কুল-কলেজ বন্ধ। ছাত্রবাসে শিক্ষার্থীরা আসতে শুরু করে। জিলাস্কুলে মিত্রবাহিনী, রূপসাস্থ বিডিআর ক্যাম্প (আজকের সিএসএস), ইউনাইটেড ক্লাব, শপিং কমপ্লেক্স, আযম খান কমার্স কলেজ, রূপসা খেতওয়াত অয়েলমিলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান। বিজয়ের পূর্বে খুলনার অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তান বাহিনী এস্টেট ব্যাংকের মজুত সকল টাকা পুড়িয়ে ফেলে। ডিনামাইট চার্জ করে সার্কিট হাউজ সংলগ্ন টিএন্ডটি’র ওয়্যারলেস টাওয়ার ও গল্লামারীস্থ রেডিও পাকিস্তান খুলনা কেন্দ্রের ট্রান্সমিটার ধ্বংস করে দেয়। খুলনা তখন ধ্বংসস্তুপের শহর। ফেরীঘাট, পশ্চিম বানিয়াখামার ও খালিশপুর বিহারী পল্লীতে থমথমে অবস্থা। বিহারীরা ঘরের বাইরে আসতে পারে না।
নয় নম্বর সেক্টরের প্রথম দিককার অধিনায়ক মেজর এম এ জলিল তার বাহিনী নিয়ে রূপসাস্থ বিডিআর ক্যাম্পে অবস্থান নেন। একই সেক্টরের শেষ দিককার অধিনায়ক মেজর জয়নাল আবেদীন খান তার বাহিনী নিয়ে ইউনাইটেড ক্লাবে অবস্থান করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে তখনও অস্ত্র। পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যবহৃত যানবহনগুলো সার্কিট হাউজ ও শিরোমণিতে পড়ে থাকে। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরা তোপের মুখে ছিল। তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে বন্ধু ভাবতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের শহরের ক্যাম্পে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ এ সংকট নিরসন করতে পারেননি। বিত্তবান ব্যক্তিরা মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার যোগান দেয়।
আট জানুয়ারি আকাশ বাণী ও বিবিসি থেকে প্রচারিত হয় স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তখনকার দিনে ঢাকার সাথে টেলিযোগাযোগ সহজতর ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানীয় ক্যাম্পে চারিদিকে বিজয়োল্লাস। নয় জানুয়ারি স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল পার্ক, হেলাতলা মোড় ও খেতওয়াত অয়েল মিলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আকাশ পানে ফাঁকা ফায়ার করতে থাকে। বেতারে প্রচারিত ইথারে-ইথারে খবর মুহূর্তের মধ্যে খুলনাবাসীর কানে পৌঁছে যায়। গল্লামারীস্থ রেডিও পাকিস্তান খুলনা কেন্দ্র ধ্বংস হওয়ার কারণে রেডিও থেকে খবর প্রচারের সুযোগ ছিল না। স্থানীয় সাপ্তাহিক কাগজগুলো তখনও প্রকাশিত হয়নি। দশ জানুয়ারি তারিখে সাপ্তাহিক জন্মভূমি প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীন বাংলাদেশে খুলনা থেকে প্রকাশিত এ পত্রিকার গর্বিত সম্পাদক এম এম সিটি কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক আলী আহম্মদ। ইকবালনগরের অধিবাসী সরদার ঈমান উদ্দিনের আর্থিক সহযোগিতায় শহর ছাত্রলীগের সভাপতি হুমায়ুন কবীর বালুর ব্যবস্থাপনায় লিবার্টি প্রেস থেকে পত্রিকাটি ছাপার কার্যক্রম শুরু হয়।
আট জানুয়ারি বেতারে সংবাদ প্রচারের পর রকেটযোগে ছাত্রলীগের একটি অংশ বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় দেখার জন্য রওনা হয়। ছাত্রলীগের এ অংশের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান শেখ আব্দুল কাইয়ুম। নৌ-কমান্ডো ও কপিলমুনি যুদ্ধের অধিনায়ক গাজী রহমত উল্লাহ দাদু বীরপ্রতীক বঙ্গবন্ধুর গার্ড অব অনার দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। এ দিনটি ছিল তার জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের। দশ জানুয়ারি সকাল থেকে খুলনার রাজপথে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের খন্ড-খন্ড মিছিল। মিছিলকারীদের হাতে ছিল স্বাধীনতার পতাকা। আর কণ্ঠে ছিল ‘স্বাধীনতা এনেছি, শেখ মুজিবকেও এনেছি’।
খুলনা গেজেট/এমএম