বিনোদন জগতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে নোংরা পলিটিকসের শিকার হয়েছিলেন বাংলাদেশের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা আমিন খান। মনোবল শক্ত ছিল, পরিবার পাশে ছিল; তাই হয়তো আত্মহত্যা করেননি বলে জানান তিনি। আমি আমার মতো করে লড়ে গেছি, সিনেমা জগতে জায়গা করে নিয়েছি বলেও জানান আমিন খান।
একসময়ে শুটিংয়ে অ্যাকশন-কাটে যার দিন কেটেছে, এখন তিনি পুরোদস্তুর চাকরিজীবনে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় দায়িত্বে আছেন অভিনেতা আমিন খান। মাঝে ২০২৩ সালে নতুন করে আলোচনায় আসেন আরাভ খানকাণ্ডে। পুরোনো এক সাক্ষাৎকারে সেই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় সোনা ব্যবসায়ী আরাভ খানকে নিয়ে বেশ কিছু খবর। নামের মিল থাকায় অনেকে মনে করছেন, ওই আরাভ খান বাংলাদেশের ঢালিউড নায়ক আমিন খানের ভাই, যা নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় খানের পরিবারকে।
সেই সময় একটি গণমাধ্যমে আমিন খান বলেছিলেন—দুবাইয়ের আরাভ খান আমার ভাই নন। কী যে এক ঝামেলায় পড়েছি, আরাভ খান নামের আমার কোনো ভাই নেই। যে আরাভ খান মনে করে অনেকেই আমার কাছে জানতে চাচ্ছেন, তিনি কি আমার ভাই, সেই আরাভ খানকে আমি চিনি না। গণমাধ্যমের খবরে জানতে পারলাম তার কথা। অনেকেই ভুল করে তাকে আমার ভাই মনে করছেন, জানতে চাইছেন—এ ঘটনায় বিব্রত বোধ করছি। আমার ভাইয়ের নাম আশরাফুল ইসলাম। সে একটি সিনেমায় অভিনয় করেছিল। সেখানে তার নাম আরাভ থাকতে পারে। এখান থেকে কেউ কেউ মনে করছেন তিনিই আমার ভাই। এ ঘটনায় সবার ভুলটা ভাঙানো দরকার।
নব্বই দশকে নতুন মুখের সন্ধানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আমিন খানে যাত্রা। এই কার্যক্রমে নির্বাচিত হয়েও ফিল্মি পলিটিকসের কারণে দুই বছর কোনো সিনেমার কাজ করতে পারেননি তিনি। ১৯৯৩ সালে মুক্তি পায় প্রথম সিনেমা ‘অবুঝ দুটি মন’। মোহাম্মদ হোসেন পরিচালিত এ সিনেমা মুক্তির আগে বাদল খন্দকারের ‘দুনিয়ার বাদশা’ সিনেমায় কাজ করেন তিনি। সিনেমাটি সুপারহিট ব্যবসা করে। এ সিনেমাই তাকে অ্যাকশন ঘরানার আগ্রহী হওয়ার রাস্তা তৈরি করে দেয়, তার আগে মুখোমুখি হতে হয় অনেক ঘটনার।
চাচার উৎসাহে ১৯৯০ সালে এফডিসি আয়োজিত নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রমে অংশ নেন আমিন খান। সেই সময় ২০ থেকে ২২ হাজার প্রতিযোগীর মধ্য থেকে নিজেকে সেরা হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরেন তিনি। সেই সময়কার কথা মনে করে আমিন খান বলেন, খুলনা থেকে ঢাকায় আসি। গ্রাম থেকে আসা আমি কাউকে চিনি না ও জানি না। একমাত্র অভিভাবক আমার চাচা। তিনিও সিনেমার কেউ নন। ডানে যাব না, বাঁয়ে যাব— কিছুই জানি না। তারপরও অডিশনে টিকে গেলাম। অডিশনের পরই বাংলাদেশের স্বনামধন্য ও প্রভাবশালী একজন পরিচালক আমাকে দিয়ে সিনেমা বানানোর আগ্রহ প্রকাশ করলেন। প্রতিযোগিতা শেষে সিনেমার নামও ঘোষণা করলেন, কিন্তু আমাকে নিলেন না। আমি চুপচাপ রইলাম। সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রেখে চলেছি। তা না হলে হয়তো আত্মহত্যা করতাম। এর মধ্যে সেই সময় সবচেয়ে মেগা হিট তিনটি সিনেমার প্রস্তাবও আমার কাছে আসে। কিন্তু পরিচালককে কথা দেওয়ার কারণে সিনেমাগুলো আমার করা হয়নি। ওই পরিচালকের একজন শিষ্য আমাকে নিয়ে সিনেমা বানাতে চাইলেন, অজ্ঞাত কারণে তা–ও হলো না!
‘অবুঝ দুটি মন’ করার আগে তিনটি সিনেমার সাইনিং মানি নিয়েছিলাম। কোনোটিতে কাজ করা হচ্ছে না। এদিকে আমাকে প্রস্তাব দেওয়া সিনেমাগুলোও মুক্তি পেতে লাগল, মন খারাপ লাগা শুরু হলো। বুঝে গেছি, পলিটিকসে পড়ে গেছি। চাচার সঙ্গে ইস্কাটনে থাকতাম। লজ্জায় বাড়িতেও যেতে পারতাম না। দুই বছরে ঈদেও খুলনায় যেতে পারিনি।
তবে এই কষ্টের সময়ে সেই সময়ের সাংবাদিকদের খুব ভালোভাবে পাশে পেয়েছেন আমিন খান। তারা এই আমিন খান নামটিও দেন। সবার কাছে আমিন খান নামে পরিচিত হলেও তার আসল নাম ছিল আমিনুল ইসলাম খান, ডাকনাম আমিন। ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচিতি অনুষ্ঠানে নামটি দেন তারা।
সেই সময়ের সাংবাদিকরা আমাকে মানসিকভাবে ভীষণ সাপোর্ট করেছেন। ভাই ও বন্ধুর মতো ছিলেন। সাংবাদিক আহমেদ কামরুল মিজান ভাই তো ‘অবুঝ দুটি মন’ সিনেমাতে অভিনয়ের ব্যবস্থা করে দেন। এই পরিচালকের ‘আজকের হাঙ্গামা’ সিনেমাটি তখন সুপারহিট। ওই সিনেমার প্রস্তাবও আমার কাছে এসেছিল। ততদিনে নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রম থেকে নির্বাচিত হওয়ার দুই বছর কেটে গেছে। ভাবলাম— এখন আর বসে থাকার মানে হয় না। তারপর কাজ শুরু করলাম। কার্টেসি হিসেবে সেই প্রভাবশালী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। জানতে পারি, তিনি দেশের বাইরে। তার ঢাকায় আসার আগে আমার সিনেমার মহরত আর শুটিং শুরু হয়ে যায়। আসার খবর শুনেই তাকে আবার বলতে যাই— তখন যে খারাপ ব্যবহার আমার সঙ্গে করেছিলেন, আশাহত হলাম। চরম বাজে ব্যবহার, যা আজও ভাবলে অবাক হই।
এফডিসিতে পা ধরে সালাম করতে চাইলে পা সরিয়ে নেন। তাদের বড় একটা সিন্ডিকেট ছিল। আমার প্রথম সিনেমা রিলিজের পর এই সিন্ডিকেট সক্রিয় হলো। নেতিবাচক প্রচার করতে লাগল। ১০ বছর আমাকে তাদের সিন্ডিকেটের সঙ্গে কাজ করতে দেয়নি।
আমিন খানের মতে, তার পেছন ফিরে যাওয়ার জায়গাও ছিল না। তাই শতবঞ্চনা সত্ত্বেও মাটি কামডে পড়ে ছিলেন। সমস্যা যেন পিছু ছাড়ে না আমিনের। ‘অবুঝ দুটি মন’ মুক্তির দুই বছর পর কাজ শুরু করেন ‘প্রিয়জন’ সিনেমার। এর মধ্যে আরও কয়েকটি সিনেমাতে অভিনয় করা হয়েছে তার। ত্রিভুজ প্রেমের সেই গল্পের সিনেমার পরিচালক মোহাম্মদ হোসেনই।
১৯৯৫ সালে ব্যাংককে ‘প্রিয়জন’ সিনেমার শুটিং করতে গেলাম। আমি ছাড়াও আছেন রিয়াজ ও শিল্পী। ১২ দিনের শুটিংও করলাম। গান, দৃশ্যসহ অনেক কিছুই করা হয়েছে। ঢাকায় ফিরলাম। ঢাকায় আসার পর আমার সঙ্গে সিনেমাসংশ্লিষ্ট কারও যোগাযোগ নেই। এরই মধ্যে সাংবাদিকরা আমাকে জানালেন— সালমান শাহকে নিয়ে ‘প্রিয়জন’ সিনেমার মহরত হবে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। কী পরিমাণ হতাশায় পড়ে যাই বলে বোঝাতে পারব না। আমি সিনেমার জন্মদাতা মোহাম্মদ হোসেনের কাছে জানতে চাই— তার সিনেমা থেকে এভাবে বাদ পড়ার অর্থ। তিনি বললেন— আমিন খান তুমি ভালো অভিনেতা না, বাজারে তোমার চাহিদা নেই। তাই তোমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। রাগে-দুঃখে ও কষ্টে এফডিসিতে যাওয়া বন্ধ করে দিই। এর মধ্যে একদিন আমারই আরেকটি সিনেমার ডাবিং করে বের হয়ে দেখছি, সেই ‘প্রিয়জন’ সিনেমারই শুটিং হচ্ছে ডাবিং থিয়েটারের সামনে। অভিনেতা বলেন, বলতে পারেন— আমার জীবন সিনেমার মতো হয়ে গেল। আবার বড় একটা আঘাত। সৃষ্টিকর্তার কী নির্মম পরিহাস, সালমান শাহ তখন হটকেক। তার আগপর্যন্ত কোনো সিনেমা ফ্লপ নেই তার ডিকশনারিতে। ‘প্রিয়জন’ দিয়েই প্রথম ফ্লপের দেখা পায় সালমান শাহ। ভাগ্য ভালো আমি ছিলাম না, তা না হলে ফ্লপের ভাগিদার আমিই হতাম। আমি তখন সময় কাটাতে চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। তখন কাজের চাপও ছিল না। একটা সময় ওই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠি।
আমিন খান বলেন, ২০০৮ সালে মান্না ভাই মারা যাওয়ার পর আরেকটি গ্রুপ সক্রিয় হলো। সিন্ডিকেট তৈরি হলো। আমাদের সময়ে যারা প্রোডাকশন বয় কিংবা ক্রেন চালাত, তারা প্রযোজক বনে গেল। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক কিছু করা শুরু করল। ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভাবল না। আমার কাছে বিষয়গুলো পছন্দ না হওয়াতে সরে গেলাম। আর নিয়মিত হলাম না।
দেশের সিনেমায় লম্বা সময় ধরে কাজ করতে গিয়ে একটা উপলব্ধি হয়েছে আমিন খানের। জানালেন সারা পৃথিবীতে সিনেমাতে কাস্টিং ডিরেক্টর থাকেন। গল্পের প্রয়োজনে যাকে কাস্টিং করা দরকার, তিনি তাকে নির্বাচিত করেন। অডিশন নেন। অথচ বাংলাদেশে এই মনোভাব তৈরি হয়নি। নিজের জীবনের একটা অভিজ্ঞতার কথাও বললেন একসময়ের জনপ্রিয় এ নায়ক। একবার প্রযোজক ও পরিচালক আমার কাছে অসাধারণ একটা গল্প নিয়ে হাজির হলেন। সবকিছু শোনার পর তাদের বলেছিলাম— আমাকে নিয়েন না। এ সিনেমাতে রিয়াজকে নিয়েন, ভালো হবে। কারণ আমার রোমান্টিসিজমের প্যাটার্ন আলাদা, অন্য রকম। পরিচালক ও প্রযোজক আমার কথা শুনে থ হয়ে যান।
বাংলাদেশের সিনেমার কাজে এখনো পেশাদারি মনোভাব গড়ে ওঠেনি বলে জানান আমিন খান। তার মতে, ‘বাংলাদেশে প্রফেশনালিজমের চেয়ে ইমোশনাল ব্যাপারগুলো কাজ করে বেশি। যার সঙ্গে যার খাতির বেশি, আবদারের সম্পর্ক, তাকে দিয়ে কাজ করানো হয় বেশি, যা অনেক বড় একটা অন্তরায়। বলতে পারেন চলচ্চিত্রজগতের পলিটিকস আমার ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমিন খান বললেন, চলচ্চিত্রের জীবনটা খুব মিস করি। ওটাই আমাকে নতুন জন্ম দিয়েছে। নায়ক আমিন খান হয়ে বাঁচতে চাই।
উল্লেখ্য, ১৯৯৩ থেকে একটানা ২০০২ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন আমিন খান। ১৯৯৮ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী স্নিগ্ধা খান। ২০০২ সালে প্রথম বাবা হন। জন্মের পর নানা জটিলতায় ভোগার পর দুই বছরের মাথায় তার সেই সন্তান মারা যায়। এই দুই বছরে মাত্র তিনটি সিনেমাতে কাজ করেন তিনি। এরপর তাকে আবার কাজে নামতে হয়। টানা ২০১০ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৬৫টির মতো সিনেমাতে কাজ করেন তিনি। এরপর আগ্রহ কমতে থাকে।
আমিন খান এখন সে রকমভাবে চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে নেই। স্ত্রী স্নিগ্ধা খান ও দুই ছেলে রাইয়ান খান আর মাঈন খানকে নিয়ে বর্তমানে ঢাকার উত্তরায় থাকেন। দুই ছেলে স্কুলে পড়ে।
খুলনা গেজেট/জেএম