শুভ জন্মদিন প্রিয় খুলনা গেজেট। তোমাকে নিয়ে লিখতে বসেছি। লিখি যে কী কথা নিয়ে কিছুই ভেবে পাইনে। আজকাল লিখতে কাগজ কলম লাগে না। হাতের কাছেই থাকে মোবাইল ফোন। ইচ্ছে করলেই দু’লাইন লেখা যায়। আমার অগোছালো লেখা কেউ না পড়লেও হাতের কাছে সহজ উপায় থাকায় মাঝে মাঝে লেখা হয়ে যায়। মোবাইল ফোনে লেখার কিছু বিড়ম্বনাও থাকে। তবুও তোমার জন্মদিনকে ঘিরে আজ কিছু বলার চেষ্টা করছি।
তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। সে কথাটি হয়তো তুমিও জানো। তবু মনে হয় ভাল করে তুমি জানো না। তাই বার বার তোমাকে মনে করিয়ে দিতে মন চায় –
তোমার জন্য আমার পরাণ পোড়ে।
এই পরাণ পোড়ার কথা মনে হওয়ায়, আমার ছোট বেলার একটা মজার কাহিনী মনে পড়ে গেল।
আমার একজন প্রতিবেশী দাদী ছিলেন। তাঁকে আমরা রাঙা দাদী বলে ডাকতাম। আবার সম্মন্ধ অনুযায়ী কেউ রাঙা চাচী, রাঙা ভাবী, রাঙা বু, রাঙা খালা ইত্যাদিভাবে সম্বোধন করতো। আমাদের রাঙা দাদী ছিলেন ছোটখাটো ফুটফুটে একজন সহজ সরল মানুষ। গায়ের রং ছিল টুকটুকে ফর্সা। তার শারীরিক গঠন অনুযায়ী তাকে ‘রাঙা দাদী’ বললে খুব একটা বেমানান মনে হতো না।
এই রাঙা দাদীর বড় ছেলের একটা ছেলে ছিল। তার নাম হুমায়ুন। ছেলেটি দেখতে বেশ সুন্দর হলেও দুষ্টুর শিরোমণি হিসেবে সবাই তাকে জানতো। কিন্তু রাঙা দাদীর চোখে সে ছিল দুনিয়ার সেরা ছেলে। হুমায়ুনের চেয়ে ভাল কোন ছেলে সারা পৃথিবীতে হতেই পারে না বলে রাঙা দাদীর একান্ত বিশ্বাস ছিল।
হুমায়ুনের বাবা-চাচারা ছিলেন দুই ভাই। তারা ভীষণ সাদাসিধা মানুষ ছিলেন। স্বাধীনতার যুদ্ধ চলাকালীন একদিন হানাদার বাহিনী তাদের দুই ভাইকে ধরে নিয়ে রাস্তার পাশে একসাথে আরো চৌদ্দ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে মেরে ফেললো। দুই ছেলেকে হারিয়ে রাঙা দাদী পাগলিনীর মতো হয়ে গেল। সাথে সাথে হুমায়ুনের প্রতি তার স্নেহ মমতা আরো বেড়ে গেল।
হুমায়ুন ছিল আমাদের সমবয়সী। আমরা একসাথে খেলাধুলা করতাম। একদিন খেলা শেষে বিকাল বেলায় আমাদের মনে একটা দুষ্টু বুদ্ধির উদয় হলো। সকলে মিলে হুমায়ুনকে বললাম – তুই মিছেমিছি শুয়ে থাক। আমরা কয়েকজন কাঁধে করে তোকে বাড়িতে নিয়ে তোর দাদীর সামনে যাবো। দেখা যাক কী হয়।
যে কথা সেই কাজ। হুমায়ুনকে কাঁধে নিয়ে বাড়ির কাছে যেতেই রাঙা দাদীর চোখে পড়লো। মূহুর্তের মধ্যে রাঙা দাদীর চিৎকারে সারা পাড়ার মানুষ জড় হয়ে গেল। উঠোনের ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে খেতে রাঙা দাদীর অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে হুমায়ুন ভনিতা ছেড়ে দৌঁড়ে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললো-
দাদী, এই দ্যাখ আমার কিছু হয়নি। আমরা তোকে পরীক্ষা করার জন্নি একটু ফাজলামি করলাম।
রাঙ দাদী অল্প সময়ের মধ্যেই মূল রহস্য বুঝতে পেরে চোখ মুছে, শরীরের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন-
তোরা আমার সাথে এমন এরিশ ক্যান কদিহি। আমার হুমায়ুনির জন্নি আমার পরাণ পোড়ে। ওর কিছু হলি আমি বাচপো না। তোরা কী তা বুঝিস!
আমরা সবাই তখন একসাথে হো হো করে হেসে উঠলাম। আমাদের মজা আরো বেড়ে গেল।
হুমায়ুনের প্রতি রাঙা দাদীর ভালবাসা ও আস্থার আর একটি ঘটনা বললে তাঁর পরাণ পোড়ার বিষয়টি আরো খোলসা হবে।
রাঙা দাদীর শরীরে ব্যাথার জন্য একবার ডাক্তার আনা হলে ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন- বুড়িমা আপনার কোথায় কোথায় ব্যাথা?
তখন রাঙা দাদী হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে বললেন- ও হুমায়ুন, কদিহি আমার কনে ব্যাথা?
অর্থাৎ রাঙা দাদীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাঁর শরীরে কোথায় ব্যাথা থাকতে পারে তা হুমায়ুন অবশ্যই বুঝবে। কারণ, হুমায়ুনের সকল ব্যাথা রাঙা দাদী মর্মে মর্মে বুঝতে পারতেন।
ছোটবেলা থেকে এই ‘পরাণ পোড়া’র কথা শুনে আসছি। সাধারণত গ্রামের মানুষ অন্যের প্রতি নিজের ফিলিংস বুঝাবার জন্য ‘পরাণ পোড়া’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এই ‘পরাণ পোড়া’ যে কেমন তা অন্যকে বুঝানোর মতো তেমন কোন ভাষা আমার জানা ছিল না।
১৯৯২/৯৩ সাল। আমি তখন জাতিসংঘ মিশন কম্বোডিয়ায় কর্মরত ছিলাম। আমার চার/ পাঁচ বছর বয়সের একটি মেয়ে ও ৪/৫ মাস বয়সের একটি ছেলেকে রেখে জীবনে প্রথম দেশের বাইরে থাকায় আমার বেশ মন খারাপ হতো। ছুটিতে দেশে এলেই তাদের খুব আদর করতাম। একদিন আমার মেয়েটিকে বললাম-
আমি কম্বোডিয়ায় চলে গেলে তোমার কেমন লাগে?
সে তার শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বললো-
তুমি চলে গেলে তোমার জন্য আমার পরাণ পোড়ে।
আমি তার কথা শুনে সেই রাঙা দাদীর কথা আর একবার মনে করলাম এবং মেয়েকে বললাম, তোমার পরাণ পুড়লে কিভাবে বুঝতে পারো?
সে একটু হতচকিত হলেও আমাকে সাবলীলভাবে পরাণ পোড়ার অনুভূতি বুঝাতে গিয়ে বললো-
প্লেনে উঠলে আকাশ থেকে নিচে নামার সময় বুকের ভিতরে যেমন ঝিম মেরে ধরে, তোমার কথা মনে হলে আমার বুকের ভিতরে ঠিক তেমন লাগে। তাতে আমি বুঝি, আমার পরাণ পুড়ছে।
পরাণ পোড়ার অনুভূতি প্রকাশের এত সহজ ভাষা আমি সারা জীবনে আর একটিও খুঁজে পাইনি।
আমার মেয়েটা আজ অনেক বড় হয়েছে। সুদূর অষ্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া শেষ করে বর্তমানে আমেরিকায় একটি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে কাজ করছে। কাজের ব্যস্ততায় মাঝে মাঝে আমাদের সাথে কথা বলে। এখন তার জন্য আমার পরাণ পোড়ে। কিন্তু সেই ছোট্ট বয়সে সে আমাকে যত সুন্দর করে তার পরাণ পোড়ার অনুভূতি বুঝাতে পেরেছিল, আমি এখন এই পূর্ণ বয়সেও আমার মেয়েকে তার জন্য আমার পরাণ পোড়ার অনুভূতি বুঝাতে পারি না।
আমার প্রিয় ‘খুলনা গেজেট’। তুমিও আমার সেই ছোট্ট মেয়েটির মতো এখন শিশু। আমি দূরে থাকলে হয়তো তোমার পরাণ পোড়ে। তুমি তোমার পরাণ পোড়ার অনুভূতি আমাকে অনেক সহজেই বুঝাতে পারো। কিন্তু, আমি এতটা পূর্ণ বয়স্ক হলেও আমার পরাণ পোড়ার অনুভূতি তোমাকে কখনো প্রকাশ করতে পারবো না। তবুও প্রিয় খুলনায় গেলেই সময় সুযোগ করে তোমার কাছে ছুটে গিয়ে মনের ক্ষুধা মিটাতে চেষ্টা করি।
আমার মেয়েটির মতো তুমিও একদিন অনেক বড় হবে। দেশ বিদেশে তোমার কীর্তি ছড়িয়ে পড়বে। সারা বিশ্ব তোমাকে পড়বে এবং দেখবে। হয়তো তখন আমি থাকবো না। তবুও তোমার জন্য আমার পরাণ পুড়বে। তোমার ডালে ডালে, পাতায় পাতায় ফুটবে ফুল। ভ্রমণ গাইবে গান। মাধুকরী কুড়াবে মধু। পাখি বাঁধবে বাসা। অগণিত ভক্ত তোমাকে চতুর্দিকে ঘিরে থাকবে। তার মাঝেও আমার জন্য যদি তোমার সামান্য পরাণ পোড়ে তাতেই আমি ধন্য হবো।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)
খুলনা গেজেট/এমএম