“রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ডিঙ্গা বায় ছেড়া পালে রাঙ্গা মেঘে সাতরায়ে আন্ধকারে
আসিতেছে নীড়ে,
দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।”
প্রকৃতির কবি জীবনান্দ দাশ- রূপসী রূপসা নদী পার হতে হতে এই ভাবেই রূপসার রূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন এই অমর কবিতা।
পল্লী কবি জসিম উদ্দীন পদ্মা নিয়ে লিখেছিলেন কালজয়ী গান “সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে সুধাই, বল আমারে তোর কিরে আর কূল কিনারা নাই, ও নদীর কূল কিনারা নাই, পারের আসায় তারাতাড়ি সকল বেলায় ধরলাম পাড়ি, আমার দিন যে গেলো সন্ধ্যা হলো তবু না কুল পাই?”
নদী মাতৃক বাংলাদেশের প্রতিটি নদ নদী নিয়ে এভাবে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান কবিতা। এসব সাহিত্যে ফুটে ওঠে নদী কেন্দ্রীক মানুষের ভোগান্তি, আনন্দ, দুঃখ, বেদনার কথা। ঢাকা যেতে রূপসা থেকে পদ্মা পাড়ি দিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কত যে ঘাত প্রতিঘাত প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হতো তার আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লঞ্চ ডুবি, স্প্রিড বোর্ড, ট্রলার, দুর্ঘটনায় কত শত মানুষের জীবনহানী, ফেরী ঘাটে যানজটে আটকে কত মুমূর্ষ রোগীর ঘাটেই মৃত্যু ঘটেছে, কত প্রবাসির বিমানের টিকিট বাতিল হয়েছে, কত যুবক ইন্টারভিউ বোর্ডে সঠিক সময় হাজির হতে না পারায় তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে, পচনশীল খাদ্য নষ্ট হওয়ায় কত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ির চোখের পানি ঝরেছে তার হিসাব আমাদের জানা নেই। আজ তারাই কেবল জানে নদীর উপর সেতুর গুরুত্ব কতখানি। প্রতিটি মানুষের কোন না কোন সুখ, দুঃখ বেদনার স্মৃতি জড়িয়ে আছে রূপসা থেকে পদ্মা পাড়ি দিতে।
ব্যক্তি জীবনে ঢাকা থেকে খুলনা ফেরার পথে আরিচার পদ্মা ঘাটে যানজটের শিকার হয়ে কাধে শিশু সন্তানকে নিয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে ফেরিতে উঠতে হয়েছিল। এসব স্মৃতি কোন দিন ভুলবার নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘ ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালে জনতার রায়ে সরকার গঠন করার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ লাঘব ও মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খুলনা থেকে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য রূপসা, মধুমতি ও পদ্মা নদীতে সেতু নির্মানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়েছে। খুলনা থেকে ঢাকার পথে রূপসা, মধুমতি ও পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণ হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের যাতায়াতে দুর্ভোগ লাঘব হয়েছে এবং খুলে গেছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিশাল দুয়ার।
স্বাধীনতার পর থেকে খুলনাবাসীর প্রানের দাবী রূপসা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিভিন্ন সরকার শুধুই অপরাজনীতি করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর জাপান ভ্রমণকালে রূপসা নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণের জন্য জাপান সরকারের সহায়তা কামনা করেন এবং চুক্তি সম্পাদন করে। এই লক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণ, ঠিকাদার নিয়োগ ইত্যাদি অনুষ্ঠানিকতা শেষে ২০০১ সালের ৩০ মে রূপসা নদীর পশ্চিম পাড়ে রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেদিন খুলনা শহরব্যাপি ছিল উৎসবের আমেজ। রূপসা ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে ব্রিজের অদূরে ভিত্তিপ্রস্তরটি আজও দৃশ্যমান।
১৯৯৬ সালের মেয়াদের মধ্যেই তিনি মোল্লারহাটে মধুমতি নদীর উপর সেতু নির্মাণ করেন। এছাড়া ২০০১ সালের ৪ জুলাই তিনি বাঙ্গালীর স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসায় স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ স্থগিত হয়ে যায়। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তব।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার ১৯৯৮-১৯৯৯ অর্থ বছরে পদ্মা সেতুর প্রাক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেন, ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। ২৮ আগস্ট ২০০৭ তারিখ পদ্মা সেতু প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পদ্মা সেতুর নকশা প্রনয়ণ করা হয়। ১১ এপ্রিল ২০১০ তারিখ পদ্মা সেতুর দরপত্র আহব্বান করা হয় এবং অর্থিক সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক, জ্যাইকা, আইডিবি ও এডিবির সঙ্গে ঋণ চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু দেশীয় ও আন্তজার্তিক ষড়যন্ত্রে বিশ্বব্যাংক সহ অনন্য সংস্থা ২০১২ সালের ২৯ জুন সেই ঋণ চুক্তি বাতিল করে। চুক্তি বাতিলের এই সংবাদটি ঐ দিন সন্ধ্যায় ভারতের আজমির শরীফে অবস্থানকালে আমি জানতে পারি। বাংলাদেশের এমন একটি দুঃখের সংবাদে আমার ভ্রমণসঙ্গিরা দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন এবং মাগরিবের নামায অন্তে আমরা আজমির শরীফ মাজারের গেটে দাড়িয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে মোনজাত করেছিলাম।
বিশ্বব্যাংক মিথ্যা দুর্নীতির অপবাদে ঋণচুক্তি বাতিল করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। যার পেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখ পদ্মা সেতুতে প্রথম স্প্যান স্থাপন করা হয় এবং সর্বশেষ ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ স্প্যান স্থাপনের দিন সৌভাগ্যক্রমে সেদিন লঞ্চে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় যাওয়ার পথে সেই দৃশ্য অবলোকন করেছিলাম, যা সারাজীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের মহানায়ক শেখ হাসিনা কর্তৃক ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষনের অপেক্ষায় রয়েছে সমগ্র জাতি, দেশের ১৮ কোটি মানুষ। ঐতিহাসিক এই সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিরকাল বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবেন। যত দিন পদ্মার জল বঙ্গপোসাগরে প্রবাহিত হবে ততদিন শেখ হাসিনা নামটি অমর অক্ষয় হয়ে বেঁচে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানুষের মাঝে। তাই পদ্মা সেতুর নামটি যদি ‘বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা সেতু’ হত, তাহলে মানুষের হৃদয়ে সেতুর নামকরণ নিয়ে আক্ষেপটুকু লাঘব হতো। পরিশেষে এই অঞ্চলের মানুষের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা’র প্রতি জানাই লক্ষ কোটি সালাম, শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা।
(লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ)
খুলনা গেজেট/ আ হ আ