আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই আবেগপ্রবণ মানুষ। তাই আমি নিজে নিজেই মানুষের থেকে ইমোশনাল দূরত্ব বজায় রাখা শিখেছি, যাতে কোনো কষ্ট সহজে আমাকে আঘাত করতে না পারে।
গতকাল প্রফেসর মোবারক হোসেন বিশ্বাসের ইহজগত থেকে প্রস্থান আমাকে তীব্রভাবে আঘাত করেছে। আমার সমস্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়েছে। আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছি।
মোবারক হোসেন বিশ্বাস আমার শ্বশুর। তার মৃত্যুতে আমার এত ভেঙ্গে পড়ার কোনো কারণ নেই। তারপরও কিছু সম্পর্ক কোনো হিসাব মানে না।
বিশ্বাস সাহেবের জন্ম পাবনায়। তার বাবা মারা যান জন্মের পরপরই। এরপর মারা যান তার মা। উনি সম্ভবত: ক্লাস টু তে পড়েন তখন। উনার দাদা ছিলেন ধনী। বাবা মা মারা যাওয়ার পর উনার চাচী উনাকে মানুষ করতে থাকেন।
উনি যখন ক্লাস ফোরে পড়েন, এক সন্ধ্যায় উনার চাচী উনাকে চার আনা পয়সা দিয়ে বলেন, তোকে আজ রাতে তোর চাচারা নৌকায় নদীতে নিয়ে যাবে। তোর সম্পত্তির জন্য তোকে ওরা মেরে ফেলবে। তুই পালিয়ে যা।
সেই চার আনা পয়সা নিয়ে ক্লাস ফোরে পড়া ছাত্রের যে জীবন সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো, গতকাল ৮৮ বছর বয়সে একজন সফল মানুষ হিসাবে তার যবানিপাত হয়েছে।
তিনি চার আনা সম্বল নিয়ে বাড়ী থেকে পালালেন। গ্রামের রাস্তায় রাতে ঘুমালেন। কিভাবে কিভাবে পরের দিন রাতে সম্ভবত: পাবনায় ট্রেন স্টেশনে পৌঁছালেন। না খাওয়া, ক্লান্ত-শ্রান্ত, জীবন হাতে নিয়ে বাড়ী থেকে পালানো একটি বাচ্চা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হলেন। গ্রামের বাইরে তিনি কখনো যাননি। এখন তিনি কোথায় যাবেন? তিনি কাউকে তো চেনেন না।
ক্ষুধায় একা একা কাঁদছেন তিনি, এক ভদ্রলোকের দয়া হলো, জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছো কেন? তিনি সব খুলে বললেন। ভদ্রলোক অন্য জেলার মানুষ। তাকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন। নিজের ছেলের মতো মানুষ করতে লাগলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি বিশ্বাস সাহেব তার পালিত বাবার ব্যবসার কাজকর্ম গায়ে খেটে করে দিতেন।
সম্ভবত: যখন গ্রাজুয়েশন করেন, তখন তার পালিত বাবা মারা গেলেন। উনি চলে গেলেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। ফিলসফিতে মাস্টার্স করলেও ইংরেজীতে তার প্রচন্ড দখল। বেশীরভাগ সময়ই চোস্ত ব্রিটিশ একসেন্টে ইংরেজী বলতেন। পড়াশুনা শেষে তিনি এক বৈচিত্রময় ক্যারিয়ার করছেন। পাকিস্তান শাসন আমলে ইংরেজী সংবাদপত্রে থেকেও অনেক চাকরী করেছেন। ক্যারিয়ার শেষ করছেন কলেজে অধ্যাপক হিসাবে।
ব্যক্তিজীবনে ছিলেন ভয়াবহ নিরহংকারী নির্ঝন্জাট এবং নির্লোভ একজন মানুষ। তিনি নিজের নামে কোনে সম্পত্তি করেননি। তার ছিলো না কেনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, তিনি কোনোদিন টাকার হিসাব রাখেননি। নিজের কাছে কখনো এক টাকাও রাখতেন না। সব করেছেন তার স্ত্রী।
বিশ্বাস সাহেবের ছিলো পড়াশুনার ভয়ংকর নেশা। ইংরেজী সাহিত্য থেকে ইতিহাস, ধর্ম সব কিছুতে ছিলো অগাধ পান্ডিত্য।
সারা পৃথিবীতে তার ৩/৪ জন মাত্র বন্ধু ছিলো। তিনি শঠতা, মিথ্যা বলা এগুলো সহ্য করতে পারতেন না, তাই তিনি যার মধ্যেই এগুলো দেখেছেন, তাদের সাথে তিনি মেশেননি।
তার তিন মেয়ে এবং এক ছেলের চারজন পৃথিবীর চার দেশে থাকে। সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি তিন বার আমাদের কাছে অস্ট্রেলিয়ায় থেকেছেন। ইন্ট্রোভার্ট একজন মানুষ আমাকে ভয়াবহ রকম পছন্দ করতেন। লাঞ্চ বা ডিনারে খাবার টেবিলে আমার তার সঙ্গে তুমুল আলোচনা হতো। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে সিনেমা থেকে বিশ্ব রাজনীতি, কি নয়?
তার ছিলো খুবই উচ্চমানের পার্সোনালিটি। আমার শ্বাশুড়ী পর্যন্ত তার সঙ্গে মজা করতে সাহস পেতেন না সবসময়। আর আমি তার সাথে ধুমায় ফাইজলামি করতাম। লিজা প্রথম দিকে আমাকে বলতো, সে তোমার শ্বশুর, শালা না। সে রেগে গেলে কিন্তু তোমার সাথে দূরত্ব তৈরী করবে।
আসলে আমরা একসময় বন্ধু হয়ে গেছিলাম। তিনিও আমার সঙ্গে দুষ্টুমী করেন। সুখ-দু:খ শেয়ার করতেন। তার অনেক গোপন কথা পৃথিবীতে শুধু আমাকেই বলে গেছেন।
সিডনিতে একদিনে তার দুইবার ওপেন হার্ট সার্জারী হয়েছিলো, তিনি দ্বিতীয় জীবন পেয়েছিলেন।
এবার আমরা কোনো কিছুর বিনিময়ে তাকে আর বাঁচাতে পারলাম না।
তিনি তার জীবন যুদ্ধ একাই করে গেছেন, কারো সাহায্য তিনি নেননি, তিনি প্রত্যাশাও করেননি।
তিনি শুধু আমার শ্বশুর না, তিনি আমার দুর্দান্ত বন্ধুও ছিলেন। এমন বন্ধু আমি আর এ জীবনে পাব না ভাবতেই আমার দু’চোখ ভেসে যায়।
তিনি আমার চোখে পৃথিবীতে দেখা একমাত্র ‘নি:সঙ্গ শেরপা’।
মহান আল্লাহ অবশ্যই তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসে নসীব করবেন।
(১৬ জুলাই ২০২১, গ্রেগরী হিলস্ , সিডনি)