বিশাল একখানি গ্রন্থ। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৩০০ অধিক। বস্তুগত ওজন ২ কেজি ৭০০ গ্রাম। লিখিত মূল্য ১৩০০ টাকা। প্রকৃত ওজন পরিমাপের অসাধ্য এবং মূল্য হিসাবের উর্ধে। গ্রন্থটির নাম- ‘ব্রজলাল কলেজের ইতিহাস’। লেখক- জীবন্ত কিংবদন্তি প্রফেসর মোঃ বজলুল করিম স্যার।
আমি তখন আমার কর্মস্থল ঢাকার কোতোয়ালি থানায় ভীষণ কর্মব্যস্ত। হঠাৎ করে সেন্ট্রী কনস্টেবল জানালো, খুলনা থেকে কয়েকজন ভদ্রলোক এসেছেন। তারা আমার সাথে দেখা করতে চান।
খুলনার নামে আমি বরাবরই একটু বেশি দুর্বল। বলতে পারেন, এ বিষয়ে আমি ভীষণ স্বজনপ্রীতিতে অভ্যস্ত। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও খুলনার মানুষদের সময় দিতে আমি কোনদিন একটুও কার্পণ্য করিনি। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
আলাপের এক পর্যায়ে খুলনার প্রিয় অতিথিদের একজন ব্যাগ থেকে একটি বিশাল গ্রন্থ বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “বি করিম স্যার তাঁর লেখা এই বইটি আপনার জন্য পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে আপনার নামসহ আপনার শহীদ পিতা ওয়াসেক আলী আকুন্জীর নাম উল্লেখ আছে।”
একথা শুনে আমি শুধু বিস্মিত হইনি, রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার পিতা ওয়াসেক আলী আকুন্জী তেমন কোন মহাপুরুষ ছিলেন না। স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজাকারের গুলিতে তিনি জীবন দিয়েছিলেন। সন্তান হিসেবে এটা আমার কাছে বিশাল কিছু হলেও দেশ ও জাতির কাছে তুচ্ছ ঘটনা। অতএব এই মহাগ্রন্থে আমার বাবার নাম থাকার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। উপরন্তু আমার নামও নাকি আছে!
অতিথিদের মধ্যে একজন বললেন, “বইটি লেখার সময় আপনার ছবি চাওয়া হয়েছিল সেটা আপনি হয়তো ভুলে গেছেন।” আমার ভুলো মন হলেও, তার কথা শুনে ঘটনাটি মনে পড়লো। সাথে সাথে ছবি না দেওয়ার কারণটাও মনে পড়লো।
আমার যোগ্যতা ও পদমর্যাদা আমি জানতাম। বি. এল কলেজের ইতিহাসে আমার নাম উঠার মতো কোন যোগ্যতা আমার মধ্যে না থাকায় সেদিন ইচ্ছে করেই আমি ছবি দেইনি।
আমার ছবি না দিলেও ব্রজলাল কলেজের ইতিহাসের মহান হৃদয়ের লেখক অধ্যাপক মোঃ বজলুল করিম স্যার তাঁর হৃদয়ের মাঝে আমাকে রেখেছিলেন। তাইতো তাঁর রচিত বিশাল গ্রন্থের এক জায়গায় আমার শহীদ পিতার নামে গড়ে তোলা ‘ওয়াসেক আলী শিক্ষা প্রকল্পে’র নাম উল্লেখ করতে গিয়ে ঐ প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমার নামটিও লিখেছিলেন। সেই সুবাদে আমার অজান্তেই মহাগ্রন্থের এক কপি আমার কাছে পৌঁছে দিতেও তিনি ভুল করেননি।
আমার হাতে যখন মহান মানুষের লেখা মহাগ্রন্থখানি তুলে দেওয়া হলো আমি তখন এর ভার বহন করতে অক্ষম ছিলাম। এতবড় গ্রন্থে এত বড় মানুষের মনে আমি ঠাঁই পাবো তা কখনও ভাবিনি। হঠাৎ মনের মাঝে কবিগুরুর সেই গানের সুর বেজে উঠলো,
“আকাশ ভরা সূর্য তারা
তাহারই মাঝখানে
আমি পেয়েছি মোর স্থান।
বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার প্রাণ।”
এই লেখাটি আমি যখন লিখছি তখন সেই মহাগ্রন্থখানি আমার সামনে। গ্রন্থখানি দেখছি; দেখছি সেই কিংবদন্তি বি. করিম স্যারের ছবিসহ প্রিয় বি. এল কলেজে ছবি। আরো দেখছি, এই কলেজের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ ও কৃতি ছাত্র ছাত্রীদের ছবি। বার বার ফিরে যাচ্ছি নষ্টালজিয়ায়।
আমার মনের এই না বলা কথাগুলো হয়তো কোনদিন বলা হতো না, যদি বি. এল কলেজের আর একজন কৃতি ছাত্র আমাকে রীতিমতো শাসনের সুরে সুযোগ করে না দিতেন। তিনি হলেন- ব্রজলাল কলেজের ইতিহাস গ্রন্থের লেখকের মূল সাহায্যকারী ও প্রতিভাবান ছাত্র অধ্যাপক বিভূতিভূষণ মন্ডল। তিনি এই কিংবদন্তি অধ্যাপক মোঃ বজলুল করিম স্যারের উপর একটি গ্রন্থ সম্পাদনার কাজে হাত দিয়েছেন। মূলতঃ তাঁর শাসন এড়াতে না পেরে আমাকে লিখতে হচ্ছে।
আমি লেখালেখিতে একেবারে দুর্বল ও অলস। তবুও অধ্যাপক বিভূতি বাবু কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আমার প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে কিছু লিখতে পারার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য হলাম।
ছাত্রজীবনে বি. করিম স্যারের একান্ত সান্নিধ্যে পৌঁছাবার সুযোগ বা সাহস হয়নি। শুধু দূর থেকে দেখতাম ছোটখাটো অথচ বিশাল সাদা মনের মানুষটি বি. এল কলেজের সকল কিছুতেই সদা বিরাজমান। খেলার মাঠ, রোভার স্কাউটস, সভা সমাবেশ সবখানেই ছিলেন বি. করিম স্যার। কিন্তু তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে যাবার মতো কোন যোগ্যতা আমার ছিল না।
কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে আমি তখন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি । আমার প্রিয় বি. এল কলেজের কথা মাথায় রেখে এই কলেজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমার গড়া ‘সোনামুখ পরিবার’ এর আরো একটি শাখা কলেজের গেটের সামনে খোলা হলো। স্বল্প সময়ের মধ্যে সোনামুখ পরিবারের শিক্ষা ও সেবামূলক কার্যক্রম আশাতীতভাবে ছড়িয়ে পড়লো। বি. এল কলেজের আঙিনায় তৈরী হলো ‘সোনামুখের দেশ’ নামে একটি নান্দনিক পার্ক। কলেজের মূল ফটকের সামনে বিশাল অফিস নিয়ে চলতে থাকলো শিক্ষা ও সেবামূলক কর্মকাণ্ড। সোনামুখ পরিবারের কর্মকান্ডে অনেক গুণী শিক্ষকসহ আকৃষ্ট হলেন দীর্ঘদিন আগে অবসর নেওয়া এই চিরতরুণ শিক্ষক অধ্যাপক মোঃ বজলুল করিম স্যার। তিনি একদিন সোনামুখ পরিবারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে এলেন বি. এল কলেজের পুকুর পাড়ে ‘হেমন্তের কবিতা পাঠের আসর’- এ অতিথি হয়ে।
চিরতরুণ এই মানুষটি ছাত্র শিক্ষকদের সাথে কবিতা পাঠের আসরে শরীক হলেন। সোনামুখ পরিবারের জন্য প্রাণখুলে দোয়া করলেন। সেদিনও তিনি তাঁর তারুণ্যের নিদর্শন দেখিয়ে উপস্থিত সকল সোনামুখদের তুষ্ট করলেন। তিনি একাকি দাড়িয়ে কথা বলতে পারবেন না ভেবে আমরা যতবার তাঁকে সাহায্য করতে গিয়েছি তিনি ততবার চির তারুণ্যের ছাপ রেখে নিজেই দাড়িয়ে কথা বলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সোনামুখ পরিবারের ছেলেমেয়েদের কবিতা আবৃত্তি শুনে তিনি আরো তরুণ হয়ে গিয়েছিলেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই সাদা মনের মানুষটি নিজেই তরুণ আবৃত্তিকার হয়ে গেলেন। কলেজে উপস্থিত আরো অনেক গুণী শিক্ষক অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হয়ে বি. করিম স্যারের তারুণ্য উপভোগ করলেন। বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র ছাত্রীরা দেখলো এককালের কলেজ কাঁপানো সেই কিংবদন্তির শিক্ষককে। আমিও ছাত্র জীবনের অপূর্ণ আশা প্রাণভরে উপভোগ করলাম। সোনামুখ পরিবার বি.এল কলেজ রোড শাখার জন্ম সার্থক হলো।
আমাদের এই কিংবদন্তি বি. করিম স্যারের সু্যোগ্য সন্তান রুমি করিম। তিনি বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। আশির দশকে তিনি ছিলেন দেশবরেণ্য ফুটবল খেলোয়াড়। রুমির নাম শুনলে ঢাকাসহ দেশের ফুটবল আসরে প্রতিটি মাঠ দর্শকে কানায় কানায় ভরে যেতো। তাঁর ফুটবল যাদুতে মাঠের দর্শক বিমুগ্ধ হতো। ছাত্রজীবনে আমি ছিলাম তাঁর সমসাময়িক।
১৯৯০ সালের কথা। বাংলাদেশের ফুটবল অঙ্গনে আবাহনী – মোহামেডান ফুটবল দল আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয় ছিল। তখন রুমি খেলতেন ঢাকা আবাহনী ক্লাবে। ঢাকায় চাকরি করার সুবাদে আবাহনী ও মোহামেডান ক্লাবের সাথে আমার দারুণ সখ্যতা ছিল। তৎকালীন সময়ে আবাহনী – মোহামেডানের খেলোয়াড়দের সাথে দেখা করা ছিল ভাগ্যের বিষয়। কিন্তু ফুটবলের ভক্ত হিসেবে আমি উভয় দলের খেলোয়াড়দের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম।
আমার গ্রামের নাম আন্দুলিয়া। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানায় আমার গ্রামটি বরাবরই ফুটবলের তীর্থস্থান। তাই এলাকার ফুটবলপ্রেমী মানুষের দীর্ঘদিনের মনের আশা মিটাতে তৎকালীন আবাহনী-মোহামেডানের সেরা খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে একটি টীম গঠন করে আন্দুলিয়া ফুটবল ময়দানে বিশাল ফুটবল খেলার আয়োজন করেছিলাম। দেশের সকল সেরা ফুটবল খেলোয়াড়দের ঢাকায় বসে সমন্বয় করে তাঁদেরকে সরাসরি আমার গ্রামের মাঠে নিয়েছিলাম। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে সেদিন রুমি করিম খুলনার দৌলতপুরের বাসায় অবস্থান করছিলেন। সকল খেলোয়াড় খুলনায় পৌঁছাবার পর তৎকালীন আবাহনীর ক্যাপ্টেন কিংবদন্তির ফুটবলার সেখ মোহাম্মদ আসলাম ভাই কোন প্রকার পূর্ব আলোচনা ছাড়াই রুমি করিমকে আন্দুলিয়া ফুটবল ময়দানে খেলার প্রস্তুতি নিয়ে হাজির থাকতে বললে তিনি যথাসময়ে মাঠে হাজির হয়ে খেলায় অংশগ্রহণ করেন। আমরা সকলে জানি তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের তারকা ফুটবলার রুমি করিমকে পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিলো। কিন্তু নিরহংকারী সাদা মনের মানুষ অধ্যাপক মোঃ বজলুল করিম স্যারের সুযোগ্য সাদা মনের সন্তান তৎকালীন তারকা ফুটবলার রুমি করিম তাঁর বাবার মতো সাদা মনের পরিচয় দিয়ে বিনা বাক্যব্যায়ে আমার গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলে সমগ্র এলাকাবাসীকে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়েছিলেন। এই বিরল ঘটনা প্রমাণ করে বি. করিম স্যারের পুরা পরিবার কত বড় সাদা মনের অধিকারী।
অবশেষে এই মহান মানুষটির লেখা ব্রজলাল কলেজের ইতিহাস গ্রন্থে তাঁর লেখা ‘প্রকাশকের কথা’ থেকে একটু উদ্ধৃতি টেনে শেষ করতে চাই।
এই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “লেখার বিষয় আমার মনে পড়ে পরম শ্রদ্ধেয় পিতা মোঃ রফিজউদ্দিন বিশ্বাস, মাতা বেগম বিধুজান, অগ্রজ মোঃ রেজাউল হকের কথা। আমার প্রতি তাদের বরাবরই উপদেশ ছিল, ‘যথাসম্ভব সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাও। উত্তরসূরীরা যাতে উৎসাহিত ও উপকৃত হন সেভাবে পরিশ্রম করে যাও’।
তাঁর এই লেখা আরো প্রমাণ করে, তাঁদের পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে বংশ পরম্পরায় মহান হৃদয়ের অধিকারী। সৃষ্টিকর্তা এই মহান ব্যক্তিটির সুযোগ্য বংশধরদের দীর্ঘদিন সুস্থ শরীরে বাঁচিয়ে রাখুক।
এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার আগেই আজ শুক্রবার ১৬ জুলাই সকালে ইহকাল ত্যাগ করেছেন শ্রদ্ধেয় বি. করিম স্যার। আল্লাহ তাঁর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে বেহেস্ত নসিব করুন।
(লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা)