খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী নিহত
  ঢাকা শিশু হাসপাতালে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট
  রাজধানীর খিলগাঁওয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় যুবকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
  জাতীয় পতাকার নকশাকার, জাসদ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন

‌’ডক্টরস্ আর দ্যা সেকেন্ড গড অন আর্থ’

প্রফেসর ড. মো: হারুনর রশীদ খান

কোথায় যেন পড়ছিলাম “Doctors are the second God on earth”. আর চিকিৎসকরা যে medical ethics শিখে সেটাতেও এমন কিছু ধারণার আলামত মিলে। বলা হয়, “Medical doctors should have an ethical duty to protect the human rights and human dignity of the patient so the …..” etc.। আমার বিশ্বাস আমাদের দেশ তথা বিশ্বের বেশিরভাগ চিকিৎসকরাই এমন নৈতিকতা ও মানবিক গুন সম্পন্ন। কিছু বিচ্যুতি যেই নেই তা নয়, সব পেশাতেই তা থাকে। উদাহরণস্বরূপ করোনা মোকাবিলার কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বে অসংখ্য চিকিৎসক মানুষ বাঁচাতে তাদের নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আবার তার উল্টো চিত্রও রয়েছে। অর্থ আয়ের হীন উদ্দেশ্য ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট দিয়ে কেউ কেউ আবার হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এই ভাল মন্দের ভীড়ে আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে আমার দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক গুণাবলী ও মূল্যবোধ সম্পন্ন চিকিৎসকের কথা বেশ মনে পড়ছে।

১৯৯৭ সাল, আমি তখন জাপানে মনবুশো স্কলারশিপ প্রোগ্রামে পিএইচডি গবেষক। আমার মেয়ের পায়ে একটা সমস্যা ধরা পড়লে Saga Medical College হসপিটালে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। ডাক্তার অনেকগুলো পরীক্ষানিরীক্ষা করে সমস্যাটা ধরতে পারলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি করি। পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করছি শুনে আমকে ওয়েটিং কর্নারে একটু অপেক্ষা করতে বললেন।

আধা ঘন্টা পরে আমাদের ডাকলেন। দেখি আরও দুজন ডাক্তার এসছেন যার একজন বেশ সিনিয়র। তিনি পরিচয় বললেন ঐ মেডিকেল কলেজের Orthopedics এর প্রধান তিনি। আমাকে বললেন, “আপনি যেহেতু বিজ্ঞান বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা এবং গবেষণা করছেন সুতরাং আপনার মেয়ের পায়ের সমস্যাটা আশাকরি আপনি সহজেই বুঝবেন”। এই বলে সে মার্কার পেন দিয়ে বোর্ডে পায়ের মাংসপেশি এবং হাড়ের ছবি একে মিনিট দশকের ছোটখাট একটা লেকচার দিয়ে আমাকে সমস্যা এবং তার চিকিৎসার একটা সম্যক ধারণা দিলেন। এরপর তিনি জুনিয়র একজন ডাক্তারকে পাঠিয়ে একটা বই থেকে পনেরো/বিশ পৃষ্ঠার মত ফটোকপি করে এনে পেন্সিল দিয়ে মার্ক করে আমাকে দিয়ে বললেন বাসায় গিয়ে যেন আমি ওগুলোু পড়ি।

সত্যি কথা বলতে কি মেডিকেল সাইন্স বিশেষকরে Orthopedics সম্পর্কে কোন ধারণা নেই এমন একজন layman এরও ঐ লেকচার শোনার পর সমস্যাটি সম্পর্কে আর কোনো অস্পষ্টতা থাকার কথা নয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে আমার কোন অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান না থাকার পরেও আমি বিষয়টি পুরোপুরিই বুঝলাম। আমি জাপানীজ চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও রোগীর সাথে তাদের dealings দেখে যারপরনাই অভিভূত হলাম। চিকিৎসা সম্পর্কে বললেন তিনি প্রতি তিন মাস পরপর ফলোআপ করবেন এবং ফাইনালি আমি বাংলাদেশে চলে যাওয়ার আগে সার্জারি করবেন। কারণ যে সমস্যাটি দেখা দিয়েছে একমাত্র সার্জারিই তার সমাধান।

যাইহোক মোটামুটি বছর দেড়েক Orthopedics প্রধান ঐ চিকিৎসক আমার মেয়ের পা ফলোআপ করলেন। আমি জাপান থেকে চলে আসার মাস ছয়েক আগে অপারেশনের তারিখ চূড়ান্ত করলেন। অপারেশন কিছুটা ব্যয়বহুল ছিল এবং তিনি আমাকে খরচের মোটামুটি একটা ধারণাও দিলেন যা বাংলাদেশী টাকায় তখন প্রায় বিশ লাখ টাকার মত ছিল। আমি যেহেতু জাপান সরকার প্রদত্ত স্কলারশিপের অধীনে গবেষণা করছিলাম তাই আমি ও আমার স্ত্রী/কন্যা ন্যাশনাল হেলথ ইনশিওরেন্সের অধীনে ছিলাম যা মোট খরচের ৭০% বহন করবে। বাকি ৩০% অর্থাৎ ছয় লাখ টাকার মত আমাকে বহন করতে হবে।

নির্দিষ্ট দিনে হাসপাতালে আমার মেয়েকে ভর্তি করালাম। আমাদের একমাত্র সন্তান তার ওপর এত ছোট একটা বাচ্চার এমন অপারেশনের কথা ভেবে আমি আমার স্ত্রীর চেয়েও বেশি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লাম। অপারেশন থিয়েটারে নেবার আগে Orthopedics প্রধান ঐ চিকিৎসক স্বয়ং এসে আমার মেয়েকে আমার কোল থেকে তার তার কোলে নিলেন। আমার কাঁধে হাত বুলিয়ে সাহস ও সান্ত্বনা দিলেন। OT ড্রেস পরা ডাক্তারের কোলে উঠে আমার ছোট্র অবুঝ মেয়েটাও আমাকে বিমর্ষ দেখে আধা জাপানীজ আর আধা বাংলায় আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “পাপা কোয়াকু (ভয়) নাই… তুমি এখানে থাক আমি আমার আশি (পা) ঠিক করে আসি”।

প্রায় আট ঘণ্টা পর অপারেশন শেষ হলো। এর মধ্যে প্রতি ঘন্টায় নার্সরা এসে আমাদের আপডেট জানিয়েছেন। অপারেশন শেষে পুরো টিম এসে তারা কি করেছে তা আমাদের ব্রিফ করল। পরদিন সকালে যখন সেন্স ফিরল আমার মেয়ে প্রথম কথাটাই বলল, “পাপা, আমার আশি (পা) কি ঠিক করা হয়েছে”? পুরো সুস্থ হতে প্রায় তিন মাস আমাদের হসপিটালে থাকতে হলো। এই লম্বা সময়ে আমরা চিকিৎসক, নার্সসহ হসপিটালের সবার যে সহযোগীতা ও সহমর্মিতা পেয়েছি সেটা জীবনে কোনদিন ভুলে যাওয়ার নয়।

ডাক্তার যখন ড্রেসিং করতে আসতেন তখন আমার মেয়ে যাতে ভয় না পায় সেজন্য বেশ কিছুক্ষণ তার পুতুল নিয়ে আগে তার সাথে খেলা করে নিতেন। ডাক্তার আমার মেয়ের পুতুলের পায়েও ঠিক একই রকম একটা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলেন। আগে পুতুলের পায়ের ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করে তারপর রোগীর ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করতেন। চিকিৎসকদের সেবা ও মানবতার অসংখ্য উদাহরণ ঐ তিন মাসে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে যা এই অল্প পরিসরে বর্ণনা করা কঠিন। শুধু হসপিটাল থেকে আমাদের রিলিজের দিনের একটা ঘটনা বলি।

রিলিজের দিন সকালবেলা আমি একাউন্টসে বিল পরিশোধ করতে গেলে তারা আমাকে একটি কাগজ দিয়ে নিকটস্থ একটি অফিসে যেতে বলল। আমি সে অফিসে গিয়ে ঐ কাগজটি দিলে তারা আমাকে আর একটি কাগজ দিয়ে আবার একাউন্টসে পাঠালেন। আমি একাউন্টসে ঐ কাগজটির সাথে আমার ক্রেডিট কার্ড দিলাম বিল পরিশোধের জন্য। তারা ক্রেডিট কার্ড ফিরিয়ে দিয়ে বললেন আমি যে কাগজটি নিয়ে এসছি ওটাই বিল পেমেন্টের কনফারমেশন। আমার আর কিছুই পে করতে হবে না। অর্থাৎ আমি যে অফিসে গিয়েছিলাম তারাই ইনশিওরেন্সের বাইরে যে ৩০% (ছয় লাখ টাকা) আমার পে করার কথা তা পে করে দিয়েছেন। কি ভাবে এটা হলো, কে করল জিজ্ঞেস করলে তারা আমাকে Orthopedics প্রধান ঐ চিকিৎসক যিনি অপারেশন করছিলেন তার কাছ থেকে জেনে নিতে বললেন। আমি তার সাথে দেখা করলে তিনি বললেন, “আপনি তো এখনও Ph.D স্টুডেন্ট তাই আমি ভাবলাম এত টাকা পরিশোধ আপনার জন্য কষ্টকর হবে। তাই আমি আগেই ঐ অরগানাইজেশনে যোগাযোগ করে সুপারিশ করে রাখছি এবং তারা সব টাকা পরিশোধে রাজি হয়েছে”। অথচ তখন ঐ ছয় লাখ টাকা পরিশোধের যথেষ্ট সামর্থ্য এবং মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিল। দেড় বছর আগে প্রথম যেদিন এই চিকিৎসকের কাছে এসছিলাম সেদিন থেকে আজ বিদায় বেলা পর্যন্ত তার প্রত্যেকটি কর্মকান্ড এমনই ছিল। অথচ এই জেষ্ঠ্য চিকিৎসক প্রতিনিয়ত শত শত রোগী handle করেন এবং প্রত্যেককেই আমকে যেমন সেবা দিলেন ঠিক এমন সেবাই দিয়ে থাকেন। এবার বলুন, “Are these types of Dr. 2nd God?”.

সুস্থ হবার পর ডাক্তার আমার মেয়েকে একসেট খেলনা OT সামগ্রী গিফট করছিল। আর আমার মেয়ে বাসায় বসে ঐ সব ছুরি কাঁচি দিয়ে সকাল বিকাল তার সব পুতুলের পায়ে অপারেশন করত। ছোটবেলায় ঐ হাসপাতাল থেকেই আর ঐ খেলনা OT সামগ্রী থেকেই তার মনে স্বপ্ন লালিত হলো বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে আর সবাইকে সুজুতসু (অপারেশন) করবে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে তার সে স্বপ্নই এখন পূরণের পথে। আমার সে দিনের সেই ছোট্ট মামনি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে MBBS ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে কামনা তিনি যেন তাকে জাপানের ঐ চিকিৎসকের মত মানবিক গুণাবলী ও মূল্যবোধ সম্পন্ন চিকিৎসক বানান। সে যেন তার মেধা, জ্ঞান ও মননশীলতা দিয়ে মানুষের সেবায়, আর্ত মানবতার সেবায় সর্বদা নিয়োজিত থাকে, টাকা পয়সা কামানোর অন্ধ মোহ যেন তাকে স্পর্শ না করে …। (ফেসবুক ওয়াল থেকে)

খুলনা গেজেট/এআইএন

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!