বর্তমানে বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং মানব সম্পদ উন্নয়নের অবস্থান সহজে বোঝার জন্য আধুনিক যুগের প্রাক্কালে এবং উত্তর আধুনিক যুগের সূচনালগ্নে বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত প্রয়াশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে মোটামুটি তিনটি বৃহৎ গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা: উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ,এবং স্বল্পোন্নত দেশ। এই তত্ত্বের উপর নির্ভর করেই বর্তমান বিশ্বের সকল দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি পরিচালিত হচ্ছে।
বিখ্যাত ইতালিন সমাজবিজ্ঞানী ভিলফ্রেডো পেরেটো ১৯০৫ সালে বলেছিলেন ‘We are the followers of Elites’ যার ভাবার্থ ‘আমরা ধনীদের অনুসারি’। এই উক্তিটির উদাহরণ আমরা দেখতে পাই আজকের বিশ্বের এই তিনটি শ্রেণিবিভাগের মধ্যে, যেখানে স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি সর্বদা উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার একে-অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা এবং চেষ্টায় রত। ঠিক এই সময়ে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত Sustainable Development Goals (SDGs) বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, যার নির্ধারিত সময় ২০৩০, এই প্রতিযোগিতায় এনে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। যদি কোন প্রতিযোগিতা বৃহৎ স্বার্থের জন্য এবং সমষ্টিগত উন্নয়নের লক্ষ্যে হয়ে থাকে তাহলে তাকে সুস্থ প্রতিযোগিতা বলা যায়, যার দ্বারা একটি জাতি পায় তার বেঁচে থাকার নতুন উপজীব্য এবং রেখে যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক নতুন পরিচয়। এজন্য আমরা উন্নয়নের এই প্রতিযোগিতাকে সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা করব। কেননা, একটা তরুণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এই প্রতিযোগিতার অংশ। যদিও বাংলাদেশকে একটি তরুণ দেশ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়; কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এঁকে তরুণ বলার থেকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পুনঃজন্ম নেওয়া এক প্রতিভার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা অধিকতর শ্রেয়।
বাংলার ইতিহাস তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস সবসময় আধ্যাত্মিকতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ শিক্ষা এবং সম্পদের প্রাচুর্যতার ইতিহাস। কিন্তু, শতাব্দীর পর শতাব্দী বিদেশিদের আগ্রাসনের ফলে এ দেশ যেন তার অস্তিত্ব সঙ্কটের চরম মুহূর্তে উপনীত হয়েছিল। ভুলেই গিয়েছিলো ‘বাঙালি’ নামে কোন জাতি আছে। অতীত বীরত্বের গাঁথাগুলো হারিয়ে গিয়েছিল এক অজানা ইতিহাসের অন্ধকারে। অতঃপর, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং তারই ধারাবাহিকতায় স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া বাঙ্গালিকে বিশ্ববাসী চিনল এক নতুন পরিচয়ে। ‘বাংলাদেশ ̶ না এটা কোন পাকিস্তানের অংশ নয়, নয় ইংরেজদের গোলাম বা মুগলদের দাস, এটা দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষা এক দেশ ̶ বাঙালির দেশ, এতো নিজেদেরই পরিচয়। দক্ষ নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে নিজেদের হারানো এই পরিচয় নিজেদের কাছে ফিরিয়ে আনার জন্যই বোধ হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বলা হয়। যার আদর্শে দীক্ষিত হয়ে বঙ্গকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ও আপামর জনসাধারণের নিরলস প্রচেষ্টাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশ আজ রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশ হতে এক দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে।
স্বল্পোন্নত দেশ
স্বল্পোন্নত দেশ (Least Developed Countries, (LDC)) ধারণাটি ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে উদ্ভূত হয়েছিল। ‘দারিদ্র্য’ হল এর প্রথম পরিচয়। যার মানদণ্ড ২০১৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারণ হয়েছিলো ১০২৫ থেকে ১২৩০ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, যে দেশের গড় মাথাপিছু আয় ১০২৫ মার্কিন ডলারেরও কম তারা এই তালিকার প্রথম দিকে অবস্থান করবে আর তালিকা থেকে নিজেদের বের করতে চাইলে গড় মাথাপিছু আয় দেখাতে হবে ১২৩০ ডলারেরও বেশি। অর্থনৈতিক সূচক ছাড়াও এ জাতীয় দেশগুলি নির্ধারণ করার আরও দুটি মানদণ্ড আছে। যা হল, মানব সম্পদ দুর্বলতা যেটি বিবেচনা করা হয় পুষ্টি, স্বাস্থ্, শিক্ষা এবং প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষরতার সূচকের ভিত্তিতে। এবং অন্যটি হল, অর্থনৈতিক দুর্বলতা যা নির্ধারণ করা হয় কৃষি উৎপাদনের অস্থিতিশীলতা, পণ্য ও সেবার রফতানির অস্থিতিশীলতা, অপ্রথাগত কার্যক্রমের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, পণ্য রফতানির ঘনত্ব, অর্থনৈতিক ক্ষুদ্রতার প্রতিবন্ধকতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যার শতাংশের ভিত্তিতে। স্বল্পোন্নত দেশগুলির প্রথম দলটি ইউএন কর্তৃক ১৮ নভেম্বর ১৯৭১ সালে ২৭৬৮ (XXVI) এর রেজুলেশনে তালিকাভুক্ত হয়েছিল।
উপরে উল্লেখিত তিনটি মানদণ্ড (মানব সম্পদ, অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং মাথাপিছু মোট জাতীয় আয়) প্রতি তিন বছরে উন্নয়ন নীতি কমিটি দ্বারা মূল্যায়ন করা হয়। দেশগুলিকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা প্রাপ্তির জন্য বিবেচনা করার জন্য পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় তিনটি মানদণ্ডের মধ্যে দুটি পূরণ করতে হবে। উন্নয়ন নীতি কমিটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলকে (ইসোসোক) অনুমোদনের জন্য সুপারিশ পাঠায়। এলডিসি বিভাগ শুরু করার পরে, পাঁচটি দেশ উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। প্রথম দেশটি ছিল ১৯৯৪ সালে বটসওয়ানা। দ্বিতীয় দেশটি ছিল ২০০৭ সালে কেপ ভার্দে। মালদ্বীপ ১ জানুয়ারী ২০১১ সালে, সামোয়া ২০১৪ সালে এবং ইকুটোরিয়াল গিনি ২০১৭ সালে ̶ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করে । ভানুয়াতু ২০২০ সালে, অ্যাঙ্গোলা ২০২২ সালে, ভুটান ২০২২ সালে এবং সাও টোমে এবং প্রানসিপে এবং সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ২০২৪ সালে এই বিভাগে ছাড়বে। নেপালকে ২০১৮ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে স্নাতক হওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। তবে নেপালের কর্তৃপক্ষ এটিকে ২০২১ সালের জন্য স্থগিত করার অনুরোধ করেছিল। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক অধিদফতরের মতে, বাংলাদেশ ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো মানদণ্ডটি পূরণ করেছে এবং ২০২৪ সালে পূর্ণাঙ্গভাবে মর্যাদা লাভ করতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশ
উন্নয়নশীল দেশের সংজ্ঞায়নটি একটু জটিল। পাওয়ে বোইক (২০০৬)এর মতানুসারে, যে সকল দেশের অর্থনীতি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অধিকতর অগ্রগামী কিন্তু উন্নত দেশের সমপর্যায়ের নয়, তারা নব শিল্পাঞ্চলভিত্তিক দেশ বা উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত। আবার, যে সকল দেশের জীবনযাত্রার মান কম, অনুন্নত শিল্পাঞ্চলভিত্তিক এবং মানব উন্নয়নসূচক অপরাপর দেশের তুলনায় নিম্নমুখী সেগুলো উন্নয়নশীল দেশরূপে চিহ্নিত। এই সংজ্ঞায়নের উপর ভিত্তি করে আমরা দুই ধরনের রাষ্ট্র দেখতে পাই, যথাঃ নিম্ন মধ্য-আয়ের দেশ বা উদীয়মান অর্থনীতির দেশ এবং উচ্চ মধ্য-আয়ের দেশ। বিশ্বব্যাংকের ২০১১ সালের রূপরেখা অনুসারে যেসব দেশের গড় মাথাপিছু আয় ১০২৬ ও ৪০৩৬ মার্কিন ডলারের মধ্যে তারা নিম্নতর মধ্য-আয়ের দেশ এবং যাদের গড় মাথাপিছু আয় ৪০৩৬ ও ১২৪৭৬ এর মধ্যবর্তী তারা উচ্চ মধ্য-আয়ের দেশ হিসাবে পরিচিত হবে।
একটি দেশের উন্নয়নের মানদণ্ড বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যানগত সূচকের মাধ্যমে নিরূপণের ব্যবস্থা রয়েছে। তন্মধ্যে মাথাপিছু আয় (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন), প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল, সাক্ষরতার হার অন্যতম। জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন সূচকের ধারনাটির উন্নয়ন ঘটিয়েছে। এতে প্রয়োজনীয় উপাত্তের সাহায্যে উপরের পরিসংখ্যানগত জটিল পদ্ধতিতে দেশগুলোর উন্নয়নের স্তর নিরূপণ করতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এজন্য, ঐ সমস্ত দেশগুলোকেই উন্নয়নশীল দেশ বলা যায় যাদের জনসংখ্যার অনুপাতে উল্লেখযোগ্য হারে শিল্পখাতের প্রসার ও উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রয়োজনীয় সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐ সকল দেশের জীবনযাত্রার মান মাঝারি থেকে নিম্নমানের হয়ে থাকে। বাংলাদেশ সম্প্রতি মাথাপিছু আয় ১৮২১ মার্কিন ডলার, মানবসম্পদ সূচকে ৭৫.৩ পয়েন্ট, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ২৫.২ পয়েন্ট পেয়ে এই তালিকায় অনেক এগিয়ে গিয়েছে। ১ নং চিত্রের দিকে একটু লক্ষ্য করলে বাংলাদেশের উন্নয়নের বর্তমান অবস্থা আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি।
উন্নত দেশ
বিশ্ব ব্যাংকের মতে, যে সকল দেশের মাথাপিছু আয় ১২,৪৭৬ মার্কিন ডলারের বেশি তারা উচ্চ আয়ের দেশ হিসাবে বিবেচিত হবে। তবে উন্নত দেশের মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাটি প্রদান করেছে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আন্নান। তিনি উন্নত দেশের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন, ‘উন্নত দেশ বলতে যে সকল দেশ তার নাগরিকদের মুক্ত ও নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণ বা নিরাপত্তাসহ উপযুক্ত পরিবেশে স্বাস্থ্যকর জীবন প্রদানে সক্ষম তাকে বুঝাবে’। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হিসেবে জনগণের মাথাপিছু আয়, মোট দেশজ উৎপাদন, শিল্পায়নের স্তর, বিস্তৃত অবকাঠামোর বিন্যাস এবং সাধারণ জীবনযাত্রার মান এর প্রধান মাপকাঠি। তবে অনেক দেশ জনগণের সুখকেও এর মানদণ্ড হিসাবের দেখছে। ২০১১ সালে শীর্ষ দশ উচ্চ অর্থনীতির দেশ হিসেবে ̶ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, কানাডা, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশ SDG লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে নিজেদের এই তালিকার অংশ করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটল বাংলাদেশের। ২০১৮ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো এবং চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্তভাবে এই সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। ফলে বাংলাদেশের এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ভোগ করতে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা রইল না। স্বাধীনতা উত্তর উন্নয়নের এ যাত্রা সবসময় সরলরৈখিক ছিল না। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের বিস্তীর্ণ পালা বদলের পর আজকের বাংলাদেশ ধাবিত হচ্ছে এক নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে। আলোচনার এ পর্যায়ে আমারা জানব বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন প্রতিবন্ধকতাসমূহ । (চলবে)
(লেখক : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
খুলনা গেজেট/কেএম