খুলনা, বাংলাদেশ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ | ২৯ মার্চ, ২০২৪

Breaking News

রুবাইয়াত-ই-গাজী আবদুল্লাহেল বাকী

প্রফেসর নন্দলাল শর্মা

ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের কৃতী ছাত্র ও প্রথিতযশা অধ্যাপক গাজী আবদুল্লাহেল বাকী একজন গীতিকবি ও দক্ষ অনুবাদক। ইরানি সাহিত্যে তার পান্ডিত্য অপরিমেয়। কবিতা ছাড়া প্রবন্ধ ও সমালোচনা সাহিত্যেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য। ধ্যানী কবি অধ্যাপক বাকী ব্যক্তি জীবনে সুফি আদর্শের একজন মননশীল জ্ঞানসাধক। ইরানের ঐতিহ্যবাহী বিশ্বসাহিত্যে সুপরিচিত রুবাই অধ্যায়ন ও অনুশীলনে তিনি জীবনের দীর্ঘ কয়েক যুগ অতিবাহিত করেছেন। তাই বাংলা ভাষায় রুবাই রচনায় তার অধিকার অনস্বীকার্য। আর এ কাজে তিনি সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। পারস্যের বিশ্ববিশ্রুত কবি ওমর খৈয়াম, হাফিজ, শেখ সাদি, রুদাগি, জামি, রুমি প্রমুখ মরমি সাধকদের সাধনার ভাবসম্পদ তিনি আত্মস্থ করেছেন। সুফি সাহিত্য ও দর্শনে তার পান্ডিত্য সর্বজন স্বীকৃত। ওমর খৈয়ামের ওপর অভিসন্দর্ভ রচনা করে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

ছাত্রজীবন থেকেই অধ্যাপক বাকী ফারসি সাহিত্য অনুশীলন করে চলেছেন। তাই বাংলা ভাষায় মৌলিক রুবাই রচনায় তার অধিকার আছে। আর এ কাজে যে ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করবেন তা স্বাভাবিক। তার রুবাইয়াত-ই-গাজী আবদুল্লাহেল বাকী নামক ২০০ রুবাই সম্বলিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে, ১৫৭০টি রুবাই সম্বলিত ৪১০ পৃষ্ঠার বৃহদায়তন গ্রন্থটির বর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে।

গ্রন্থের প্রতিটি রুবাই-এ সুফিতত্ত্বোর মরমিবাদ ও আধ্যাত্মিকতা অনুকরণীয় ভাব ও ভাষায় ফুটে উঠেছে। সুফিতত্তো বা ফারসি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত পাঠকও এই গ্রন্থ একবার পাঠ শুরু করলে শেষ না করে পারবেন না। এই মোহনীয় শক্তি আছে প্রতিটি রুবাই-এর। আর গ্রন্থটি পাঠ শেষ করলে সুফিতত্ত্বোর ফারসি সাহিত্যের আবহের সঙ্গে পাঠক সুপরিচিত হবেন। রুবাইগুলোর ভাষা, ছন্দ, ভাব, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। এখানেই কবি ও পান্ডিত্যের অধ্যাপক বাকীর কবিত্ব শক্তি ও পান্ডিত্যের সাফল্য নিহিত।

ইরানের কাব্যধারার ভাবসম্পদ ও প্রকরণ-এর সাথে পাঠক পরিচিত হবেন এই দেড় সহস্রাধিক মৌলিক রুবাই পাঠে। গ্রন্থটির কোনো রুবাই-ই অনুবাদ নয়–মৌলিক রচনা। কেবল আঙ্গিক পারস্য সাহিত্যের। তাই আলোচ্য গ্রন্থের রুবাইগুলোতে কবির জীবনব্যাপী সুফি সাধনা ও ব্যক্তিগত অনুভূতি অপরূপ বাক্সময় হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষায় এ ধরনের কোনোও কাব্য গ্রন্থ আমার হাতে পড়েনি। তবে দু-চারজনের মৌলিক রুবাইয়াত-এর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়। যাহোক, ১৯৭০ সাল হতে রুবাই রচনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে অধ্যাপক বাকী এ ব্যাপারে পথ প্রদর্শক।

রুবাইগুলোতে ইরানি আবহ বিদ্যমান। ইরানের রুবাইগুলোতে রূপক বা প্রতীক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত শব্দ-শরাব, সাকি, কুঁজো, আশেক, মাশুক, গোলাপ, বুলবুল প্রভৃতি শব্দগুলো অধ্যাপক বাকীর রুবাইয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। সাধারণ পাঠক মনে করবেন এগুলো ইরানি কবিতার অনুবাদ। এখানেই কবির সাফল্য। ইরানি আদর্শ বাংলার রুবাই রচনা যে কতো স্বার্থক ও সফল হতে পারে অধ্যাপক বাকীর গ্রন্থটি এর উজ্জ্বল প্রমাণ। ভাবে ও ভাষায় ইরানের আবহ বজায় রেখে কবি বাংলায় রুবাই রচনায় যে সাফল্য দেখিয়েছেন এটা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন। গ্রন্থটি ইরানি আবহে রচিত হলেও বাঙালি জীবনের সুখ-দুঃখ আনন্দ অনুভূতির পরিচয় এতে আছে। ইরান ও বাংলাদেশের সম্মিলিত আবহে গ্রন্থটির প্রতিটি রুবাই সরস ও সুখপাঠ্য।

সুফিতত্ত্বোর সঙ্গে বাংলার বাউল ও বৈষ্ণব দর্শনের মিল আছে। রুবাই রচনায় অধ্যাপক বাকী সে কথা মনে রেখেছেন। তাই তার কবিতায় বাঙালি জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সমাজতত্ত্ব, প্রকৃতি ও পরিবেশ বাক্সময় হয়ে উঠেছে শৈল্পিক কারুকার্যে। একজন সফল ও সার্থক কবির হাতের পরশে ইরানি রুবাইয়ের আদলে বাংলা রুবাই রচনার ধারা সফলভাবে প্রবর্তিত হয়েছে। বস্তুত বলা চলে ফারসি রুবাইয়ের নবরূপায়ন বাংলা রুবাই পার্থক্য প্রকরণগতভাবে ফারসি রুবাই মধ্যযুগীয় আর অধ্যাপক বাকীর রুবাই আধুনিক। ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে সুপন্ডিত, মৌলিক কবিত্ব শক্তির অধিকারী, সুফি দর্শনের সাধক বলেই কবির পক্ষে এমন মহৎ ও দুরূহ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভবপর হয়েছে। অধ্যাপক বাকীর কাব্যগ্রন্থে সুফি অধ্যত্মচেতনা কীভাবে ব্যাপক হয়েছে তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি।

মুক্ত যদি না হও তুমি সত্তা হতে নিজ খাঁচার,
দেখবে ছায়া চাঁদের তুমি বিদ্ধ হয়ে বাণ ব্যথার।
নিজ মুকুরে ফুটবে যেদিন সত্য প্রেমের খাস ছবি,
নাগাল পাবে কুল-কিনারা উষ্ণ পাবে দীন প্রভার।

এই কবিতা সাধারণ পাঠক ওমর খৈয়ামের রুবাই-এর অনুবাদ বলেই মনে করতে পারেন। কবি ফারসি রুবাই কতোটা আত্মস্থ করেছেন এটা তার প্রমাণ। কবি ফারসি রুবাই-এর ছন্দ সার্থকভাবে অনুসরণ করেছেন। এর অন্ত্যমিল হচ্ছে ক ক খ ক। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। বাংলাভাষায় ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত অনুবাদ করে অমর হয়ে আছেন কান্তিচন্দ্র ঘোষ, নরেন্দ্র দেব, কাজী নজরুল ইসলাম এবং সিকান্দার আবু জাফর। বাংলাভাষায় মৌলিক রুবাই রচনায় কয়েকজন কবি এগিয়ে এসেছেন। তবে তাদের সঙ্গে অধ্যাপক বাকীর পার্থক্য হচ্ছে ছন্দ মিলের ক্ষেত্রে। একমাত্র অধ্যাপক বাকী ফারসি রুবাইয়ের ছন্দ মিল রক্ষা করেছেন, তার রচিত রুবাইয়ের সংখ্যাও বেশি; ভাব ভাষা ও ছন্দে অধিকতর আকর্ষনীয়। রুবাইয়াতের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য কবি অপরূপভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা ‘কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্বল’ হয়ে থাকবে।

ফারসি সাহিত্যের ভাবধারা ছাড়া বাংলা কবিতার মৌলিক ভাবধারায়ও অধ্যাপক বাকী আধুনিক শিল্প-চাতুর্যে রুবাই রচনা করেছেন। ফারসি রুবাই-এর ছন্দে তিনি লিখেছেন-আমাদের জীবনের কথা। তার অধ্যাত্মবাদী মন আধুনিক ইংরেজি ও বাংলা কবিতার রসে সিক্ত। তাই তো তার পক্ষে লেখা সম্ভবপর হয়েছে:
এই দুনিয়ার সকল মানুষ এক যে হবে–কোনো একদিন,
এমন মিথ্যা বিশ্বাস করতেন সুবিজ্ঞানী আইনস্টাইন।
থামবে যখন বিশ্বলীলা শান্তি পথে হাঁটবে সবাই,
উল্টা পথে বিভেদ বিবাদ সামনে আরও আসছে কুদিন।

শব্দ চয়নে কবির মুন্সিয়ানা পাঠকদের মুগ্ধ করবে। ফারসি, তৎসম, আঞ্চলিক ও দেশি শব্দ কবি সফলভাবে চয়ন করেছেন। ভাব অনুযায়ী শব্দ ব্যবহার কবির সাফল্য প্রশ্নাতীত। ফারসি রুবাইকে কবি বাংলার আবহে প্রকাশ করেছেন। গ্রন্থখানা দীর্ঘ কলেবরের হলেও পাঠকের বিরক্তি আসে না। বরং একটানা পড়ে শেষ করতে ইচ্ছা করে। পাঠককে ধরে রাখার কৌশল কবির ভালো জানা আছে। তাই এমন মহাকাব্যসম কবিতা গ্রন্থ কবি আমাদের উপহার দিয়েছেন এবং বাংলা কাব্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। এই গ্রন্থ কবিকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। কবি সুস্থ দেহে শতায়ু হোন এবং তার লেখনী সজীব ও সতেজ থাকুক এই প্রার্থনা।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক, মরমি গবেষক ও শিক্ষাবিদ

খুলনা গেজেট/কেএম

 




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!