খুলনা, বাংলাদেশ | ৪ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  উপজেলা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিল বিএনপি ও জামায়াত
  শ্রম আইন লঙ্ঘন : স্থায়ী নয় ২৩ মে পর্যন্ত জামিনে থাকবেন ড. ইউনূস
  ফরিদপুরের কানাইপুরে বাস-পিকআপ ভ্যান মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১৩

রাহুগ্রাস (শেষ পর্ব)

গৌরাঙ্গ নন্দী

শিবু’র নিরানন্দ জীবনটা একঘেয়েমিতে আটকে গিয়েছে। বাঁধের পাড়ায় ঝুপড়ি ঘরে রাতটুকু কোনমতে কাটায়। সকাল হলেই বাইরে যায়, যদি আশেপাশে কোন কাজ জোটে কখনও কখনও করে। মেয়ে হাসি নিজের মতো করে পড়াশোনার চেষ্টা করে। জেঠিদের সাথে খায়। বাবাকে সে ঠিকমতো কাছে পায় না। ঠিকভাবে সে কথাও বলে না। দু’-একটা ভালো কথার পর শিবু শুরু করে গালমন্দ, চিৎকার-চেঁচামেচি। সেদিন বিকেলে শরতের আকাশে সাদা মেঘের দল পেঁজা তুলোর ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছিল। কয়েকটা যেন পাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে তার মাঝ দিয়ে সোঁ করে চলে গেল। আহা! যদি পাখির পায়ে একটি চিঠি লিখে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়া যেতো, আর মা যদি সেটা দেখে তার হাসিকে কেমন আছে লিখে জানাতো। আচ্ছা, ছোট বোনটা -মিঠু কেমন আছে। নিশ্চয়ই ভালো আছে। সমীরণ কাকু, তাকে নিশ্চয়ই ভালো রেখেছে। সন্ধ্যার আঁধার নামতে শুরু করেছে। ঘরে ঘরে সন্ধ্যা বাতি দিচ্ছে। ওই দূর থেকে আসছে আযানের ধ্বনি। এখানে কেউ কেউ শঙ্খ ধ্বনিও দিচ্ছে। হাসিও দৌড়ে উঠে নিজেদের ঘরে যায়। সেও সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালে। দুটো ধুপকাঠিতে আগুন জ্বেলে ছোট্ট তাঁবুর মতো ঘরটিতে ঘুরিয়ে দেয়। হাতজোড় করে কপালে ঠেকায়। মনে মনে বলে, মা তুমি ভালো থেকো। মিঠু তুই ভালো থাকিস।

জীবনের ধর্মই সবকিছু ফেলে এগিয়ে যাওয়া। দু:খ-যন্ত্রণা পাশ কাটিয়ে মানুষই এগুতে পারে। অতীতকে ভুলতে পারে। হয়তো অনেকেই পারে না, যারা পারে না, তারা কষ্ট বেশী পায়। আবার কেউ অতীত স্মৃতি হাতড়ে কেঁদে মরে। সেদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য হাসি তৈরি হচ্ছে। এমনি সময় আচমকাই শিবু’র উৎপাত। হাসির উপর তার বাবা চোটপাট শুরু করে। ’তোমার স্কুলি যাতি হবে না, মাইয়ে। স্কুলতো না, ওই মা’র মত কোনদিন কোন ছাওলের হাত ধইরে চইলে যাবা। ওসব দরকার নেই।’ বাবার কথার কোন উত্তর দেয় না, হাসি। কি বলবে সে। তারতো বলার কিছু নেই। কেবলি মায়ের ওপর অভিমান জমে। মা-তো দূরে গিয়ে বেশ ভালোই আছে। এখন সকল রাগ-ক্ষোভ তার সইতে হচ্ছে। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে হাসি। এ যেন তার নিত্যদিনকার ছবি।

বাঁধের উপর সারি সারি ছাপড়া ঘরগুলো দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই এদিক-সেদিক চলে গেছে। যারা চলে গিয়েছে সেই ঘরগুলো ফাঁকা। চলে যাওয়ারা বেশীরভাগই ভারতে গেছে। কেউ কেউ খুলনা শহরেও গেছে। ওর বান্ধবী মায়া-রাও চলে গেছে। ওর ভারী মন খারাপ। মায়ার সাথেই ছিল তার গভীর বন্ধুত্ব, তার সাথেই সে সকল কথা বলতো। একেবারে অন্তরঙ্গ বন্ধু বলতে যা বুঝায়, তাই। মাঝে-মধ্যে রতন দা খোঁজ-খবর নেয়। এতে তার ভালো লাগে। আবার এক অজানা আতঙ্কও বাসা বাঁধে। বুকটা কেমন যেন চিনচিন করে ওঠে। এ নিয়ে আবার কোন ঝামেলা হবে না-তো!

স্কুলে যাচ্ছে হাসি। মনটা খুব খারাপ। নীরবে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিল। কখন যে পাশে পাশে রতন দা হাঁটতে শুরু করেছে, সে টেরই পায়নি। ’কিরে, তোর কি হয়েছে?’ এ কথায় চমকে ওঠে, হাসি। মুখ ফিরে তাকায়। দেখে, রতন দা। মুখে হাসি-হাসি ভাব আনার চেষ্টা করে, কিন্তু তা আর হয় না। কেন যেন হাসি হাসতে ভুলে গেছে। আচমকাই যেন অনেক কথা বলতে শুরু করে। ’রতন দা, রতন দা; বাবা না আর আমাকে ভালোবাসে না। মা চলে যাওয়ার পর থেকে সে শুধুই আমাকে বকাবকি করে। আমি না-কি মায়ের মতো হবো। তাই, আমি কি তেমন হবো? তুমি আমায় বলো না। বাবা, কি আমাকে একটুও আর আদর করতে পারবে না।’ আচমকাই সে রতনকে উদ্দেশ্য করে বলে, ’আচ্ছা, তুমি কি আমাকে ভালবাসবে! তুমি কি আমায় ভালোবাসতে পারো না? তোমরা কেউই আমাকে ভালোবাসতে পারো না, ভালোবাসবেও না। আমার কোন কিছু ভালো লাগে না। এই ঝুপড়ি ঘর, পড়াশোনা, স্কুলে যাওয়া; বাবার নিত্য-নতুন মুখ ঝামটা। না, আমার কিচ্ছুই ভালো লাগে না। এ থেকে মরে যাওয়াই ভালো। আমি সত্যি সত্যিই একদিন মরে যবো। দেখে নিও, আমি কিন্তু ঠিক মরেই যাবো।’

রতন কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। ’আচ্ছা, কি হয়েছে হাসি! তুই আজ এমন করছিস কেন! আর মরার কথা ওভাবে বলতে হয়। বাবার মন খারাপ, তাই হয়তো তোকে বকাবকি করেছেন। তাই বলে তিনি কি তোকে ভালোবাসে না! নিশ্চয়ই ভালোবাসেন। ছোট বোন আমার। লক্ষ্মী বোন আমার। এতো অস্থির হতে নেই। এতো মন খারাপ করতে হয় না। হ্যাঁ, আমিতো তোমায় ভালোবাসি। বাবা কষ্ট পেয়ে ওসব কথা বলেছেন, তাই বলে কি তাঁর উপর রাগ করতে হয়। না-কি মরার কথা বলতে হয়। ওসব বলবে না। একদম মন খারাপ করবে না।’ কথাগুলো বলে রতন ভাবতে থাকে, সত্যিই কি সে এই কথাগুলো বলতে পারলো। কথাগুলো অনেক ভারী ও ওজনদার মনে হ’ল। সে কবে থেকে এমন ওজনদার কথা বলতে শিখলো। এমন দায়িত্ব নিতে শিখলো!

রতনের মুখে দরদভরা কথা শুনেই কিশোরী হাসি হু হু করে কেঁদে ওঠে। ক্ষুব্ধ মনটিতে একটুখানি সান্তনা-আদরের কথা শুনে তার বুকে জমাট-বাঁধা বেদনাগুলো শিশির বিন্দুর মতো চোখের ধারা বেয়ে ঝরতে শুরু করে। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রতনের বুকে মুখ লুকাতে চেষ্টা করে। রতন বেশ হক-চকিয়ে যায়। সে বলে ওঠে, ’এই রে, কি হ’লো তোর? এভাবে কেউ কাঁদে না-কি? আরে চোখ মোছ। এই রাস্তার উপর এভাবে কান্নাকাটি করলে লোকজন কি ভাববে, বলতো দেখি। লোকেতো আমাকেই দোষী ভাবতে শুরু করবে। মনে করবে, আমি কিছু হয়তো বলেছি। অনেকেই নানান কথা বলতে পারে। সকল মানুষের ভাবনা, চোখ এক রকম না। কেউ কেউ আছে, সকল কিছুতে খারাপ দেখে, খারাপ ভাবে।’ হাসি বলে, ’তুমি আমায় রক্ষা করো রতন দা।’ ’আচ্ছা, হবে। আমি আছি। এখন চোখ মোছ। স্কুলে চল।’

হাসি তখনও স্কুল হতে বাড়ি ফেরেনি। অসীম বেশ রসিয়ে রসিয়ে শিবপদকে হাসি’র কথা বলে। যেচে কথা বলার মানুষগুলো যেমন, যা দেখে, তা ঠিক দেখে না, আবার যা দেখে তার মধ্যে কলুষতা আবিস্কার করে; বলার সময় তাই, অনেক বেশী বলে; স্বাভাবিকভাবে ভালোর চেয়ে মন্দটাই বেশী বলে। শিবপদ বেশ বিস্মিত হয়! কি বলতে চায়, অসীম। বেশ ক্ষুব্ধকণ্ঠেই সে অসীমের কাছে জানতে চায়, অসীম তুমি কি বলতি চাইছো? পরিষ্কার কইরে বলো-ত। উত্তরে সে বলে, ’কি আর বলবো, তোর মাইয়ে যে তার মায়ের পথ ধরিছে।’

শিবপদ বিস্ময়ভরা চোখ দুটো নিয়ে অসীমের দিকে তাকায়। কোই, এতো অসীমের মুখ নয়, এতো অনিতার মুখ। যে মুখে বিকৃত হাসি। হাসির গমকে শিবু’র মাথা আরও গরম হয়ে ওঠে। সে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে অসীমকে বলে ওঠে, ’কি বলতি চাও বলো, অসীম দা’। তখন অসীম স্কুলে যাওয়ার পথে হাসি আর রতনের কথা বলে। অসীম বলে, ’সে যে কি ঢলাঢলি! তা যে চোহি দেহা যায় না। রাস্তার মধ্যি তোর মাইয়ে ওই রতন ছ্যামড়াডার বুকির মধ্যি মাথা গুজে দিলো। তারপর কি-যে কান্না। খাতি-পরতি দিস তুই। আর তোর মাইয়ে দু:খির কান্না কান্দে রতনের বুকি পইড়ে। এইটে কিসির ল²ণ। আমি কইয়ে দিলাম, তোর ওই মাইয়েও কিন্তু তার মায়ের মতো ওই রতনের হাত ধইরে একদিন চলে যাবে। এহনও সময় আছে, শাসন কর। লাগাম টাইনে ধর।’

অসীমের কথা শুনে শিবপদ’র মাথায় যেন আগুন জ্বলে ওঠে। সে রাগে ফুঁসতে থাকে। নিজের মনেই হাসির মাকে শাপ-শাপান্ত করতে থাকে। মেয়েটিকেও গালি পারতে থাকে। গ্রাম-সমাজের এই এক অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য। কোন ঘটনার কার্য-কারণ খোঁজার চেয়ে বাগাড়ম্বর বেশী, নেতিবাচকতা বেশী। ভালোর চেয়ে খারাপটি বেশী দেখে, বলেও। এমনিতেই গ্রামের মানুষগুলোর কাছে চিত্তবিনোদন বলে কিছু নেই। পর চর্চা এখানে একটি মুখ্য বিষয়। অন্যে কে কি করলো, কিভাবে হাঁটলো, কিভাবে কথা বললো; এসবও কারও কারও আলোচনার বিষয়বস্তু।

আর প্রাকৃতিক ও সমাজিক দুর্যোগে পীড়িত এই মানুষগুলোর যেন বোধ-বুদ্ধিও হারিয়ে যেতে বসেছে। শিশু-কিশোরকালের মানসিক যন্ত্রণাগুলোও স্বাভাবিকভাবে দেখা বা বিবেচনা করার চেষ্টা নেই বললেই চলে। কেবলি দু:সহ যন্ত্রণা। কাছের মানুষদেরও সহজভাবে নিতে না পারা। আর অভাবের তাড়নায় ভিন্নপথে মুক্তির চেষ্টা করা। হাসির মা চলে যাওয়ার পর থেকে এই তিন বছর শিবুতো আর স্বাভাবিক হতে পারেনি। জীবনের সকল কিছুই যেন ওই নারী ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেছে। তাকেতো সে ধরে রাখতে পারেনি, এর জন্যে অনিতার অন্যের প্রতি দুর্বলতাকে সে প্রধান হিসেবে দায়ী করে। অবশ্য, নিজের কোন ত্রুটি আছে কি-না, তা সে কখনও খুঁজে দেখেনি। মানুষ এ ব্যাপারে বড্ড স্বার্থপর। নিজের ত্রুটি সে দেখতে চায় না, শুধুমাত্র পরের দোষ দেখে, তাতেই মজা পায়; আনন্দ খুঁজে নেয়।

হাসি বাড়ি ফিরলেই শিবু তার উপর হামলে পড়ে। মেয়েটির চুলের মুঠো ধরে মারতে শুরু করে। বাবার হাতে মার খেয়ে হাসি চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়। মেয়েটির কান্না আর শিবুর চিৎকারে আশেপাশের অনেক মানুষ ভিড় জমায়। সকলেই যেন একটু দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে শুরু করে। কেউ কেউ প্রশ্ন করে, ’কি হচ্ছে, মাইয়েডারে মারতিছে। তা বাপে মারলি আর কে কি কবে।’ কোথা থেকে যেন ঝড়ের বেগে হাজির হন রাঙা বৌদি। তিনি হাসিকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন, যারা মজা দেখছিল, তারা কেউ মেয়েটাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। রাঙা বৌদি হাসিকে জাপটে ধরে শিবুপদকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। সে বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠেই বলে ওঠে, ’ঠাকুরপো, মাইয়ে বড় হচ্ছে, তারে তুমি এইভাবে মারতিছো কেন? কি অন্যায় করিছে। কারও সাথে কথা বললি কি, খারাপ কিছু হয়ে যায়। রতনতো ওর দাদা হয়। মাসতুতো ভাই। তার সাথে কথা বলে কি অন্যায় করিছে ও। বারেবারে মা-ডা চইলে গেছে, কও। তারে তুমি রাখতি পারোনি কেন? তোমার কি কোন দোষ নেই। বৌরে কাছে রাখতি পারোনি কেন? নিজির বৌরে কাছে রাহার ক্ষমতা নেই, লম্বা লম্বা কথা। যত দোষ মাইয়েগে, না? মা-ডার কারণে মাইয়েডারে মাইরে চলিছো। আরে আমার বীরপুরুষ!’

এক নাগাড়ে অনেকগুলো কথা বলে রাঙা বৌদি কেমন যেন হাঁফাতে থাকে। ভাবতে থাকে, কি সব কথা বলেছে সে। নিজে যেন নিজের মধ্যেই চুপসে যেতে থাকে। রাগের মাথায় ঠাকুরপোকে সে অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে। আসলেই সে এইভাবেই ঠাকুরপোর দোষগুলো চিহ্নিত করেছিল, যা হয়তো বলতে পারছিল না, আজ রাগের মাথায় হাসির কান্না দেখে আর চুপ থাকতে পারেনি। একজন স্ত্রী, স্বামী সন্তানকে রেখে চলে যাবে কেন? তা-কি শুধুমাত্র খাওয়ার অভাবে। নানান বিচার করে তিনি দেবরটার অনেক দোষ খুঁজে পায়। কিন্তু তা-সে দেবরটাকে গুছিয়ে বলে উঠতে পারে না। সঙ্কোচ, কিসের যেন ভয়, লজ্জা। দেবরকে তা বলা যায় না। আজ সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। মায়ের অবর্তমানে সেইতো হাসিকে মায়ের ছায়া দিয়ে রেখেছে। সেই মেয়েকে মারতে দেখে রাঙা বৌদি আর ধৈর্য রাখতে পারেনি। হাসিকে জড়িয়ে ধরে সে আদর করতে থাকে। ’মাগো, কাঁদে না। কাঁদতি নেই। মা নেই, তা কি হইছে, আমিতো আছি। বাবা মারধর করিছে, কাজটা মোটেই ভালো করেনি, আমিতো বকেছি। তুমি আর কাইন্দে না।’

হাসি জেঠিমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফুঁপাতে থাকে। যারা জড়ো হয়েছিল, তারা ধীরে ধীরে চলে যায়। জেঠিমাও একসময় চলে যায়। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের রাঙ্গা আভা উঁকি দিতে শুরু করেছে। পূর্ণ জোয়ারে ঢাকির জল একেবারে স্থির। তাতেও রঙিন আভা। ধীরে ধীরে তা কালচে বর্ণ ধারণ করছে। ওই দূরে খেয়াঘাটটি কেমন যেন আলো-আঁধারিতে ভরে উঠেছে। ঢাকিকেও আস্তে আস্তে আঁধারে ঘিরে ধরছে। ওই দূর থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। কিছু পরে ঢাকির পাড়ে ঝুপড়ি ঘরগুলো থেকেও শাঁখের ধ্বনি ওঠে। না, সন্ধ্যা প্রদীপ দিতে আর হাসির ভালো লাগে না। কিসের আশায়, কোন মঙ্গল আকাক্সক্ষায় সে সন্ধ্যা প্রদীপ দেবে? এই পরিবারের মঙ্গল? তাঁর বাবার মঙ্গল? নিজের মঙ্গল? না-কি ছেড়ে যাওয়া মা, অবুঝ বোনের জন্যে মঙ্গল? না, কারও মঙ্গল সে আর চায় না। হাসি ছাপড়া ঘরটির কোণায় গিয়ে আস্তে আস্তে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে।

ঢাকির জোয়ারের জল মন্ডল বাড়ির পাশে ভাঙ্গা জায়গা দিয়ে হু হু করে ছুটে চলেছে। অনেক দূরে আবারও আংটির মতো ঘুরিয়ে দেওয়া বাঁধের পাড়ে তা গিয়ে আছড়ে পড়ছে। ওটাও যেন ভেঙ্গে ফেলবে। আগে মানুষ বাঁধ কেটেছে, এখন ঢাকি তা গিলে খাচ্ছে। এভাবেই কি দুনিয়াটারও একদিন সমাপ্তি হবে। হাসির চোখের সামনে যেন এক কালো দৈত্য ভেসে ওঠে। কি ভয়ঙ্কর তার হাসি। তার দাঁতগুলো বড় বড়, তাতে যেন রক্ত ছিটকে বেরুচ্ছে। ভয়ে আরও সিটিয়ে যায় হাসি। কি যেন বলতে থাকে। বলার চেষ্টা করে, পারে না। বিড়বিড় করতে থাকে। গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা মেয়েটিকে শিবপদ ডাকতে থাকে। কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে তার কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখে। অস্পষ্ট কিছু শব্দ তার কানে আসে, কিন্তু কি বলছে, তা বুঝতে পারে না। মেয়েটাকে আবারও ডাকে। ’ওঠো হাসি; হাসি-মা, খাবে ওঠো।’ হাসির ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনে করার চেষ্টা করে রক্তখেকো দৈত্য। বুঝতে পারে, সে তাহলে স্বপ্ন দেখছিল। বলে, ’বাবা, তুমি খাও; আমি পরে খাবো।’

পরদিন সকালে বাঁধের পাড়ায় বসতিদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে শিবপদ’র। অনেকেই তার ঘরের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তাকে ডাকছে। সে ধরপড় করে ওঠে। কেউ কিছু তেমন একটা বলে না। কে যেন বলে, ঘরে কি হাসি আছে? এদিক-ওদিক তাকিয়ে শিবপদ বলে, না। কেউ একজন বলে ওঠে, তাড়াতাড়ি চলো। কিছু একটা ঘটেছে বুঝে নিয়ে শিবপদ তাদেরকে অনুসরণ করে।

বাঁধ ছেড়ে তারা পাড়ার রাস্তায় নামে। রামনগর বাজারের দিকে গিয়েছে রাস্তাটা। সেদিকেই সকলে ছুটছে। শিবপদও ছুটছে। কিছুদূর গিয়ে একটি জায়গায় এসে সকলে থামে। একটি গাছের দিকে সকলের চোখ। শিবপদ কৌতুহল ভরে ওইদিকে তাকায়। আমগাছটির দিকে নজর পড়তেই শিবপদ চিৎকার করে ওঠে। ’একি, করলিরে তুই? ওরে হাসি, তুই একি করলি। তুইও আমারে ছাইড়ে চইলে গিলি। আমি অপদার্থ। আমি কাউরে ধরে রাখতি পারলাম না।’

গাছের একটি ডালের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হাসি ঝুলে আছে। পা-টা তার মাটি থেকে হাত পাঁচেক উপরে। হাসি ছোটখাট এসব গাছে উঠতে পারতো। বোঝাই যাচ্ছে, গাছে উঠে সুবিধামত মোটা ডালের সঙ্গে ওড়নাটি নিজের গলায় দিয়ে ঝুলে পড়েছে। ঘাড়টি একদিকে কাত করা। চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। শিবু গাছে উঠে তাকে নামানোর চেষ্টা করে। আরও কয়েকজন তাকে সহযোগিতা করে। ধীরে ধীরে তাকে নামিয়ে আনা হয়। ধরাধরি করে হাসির মরদেহটি বাঁধের ওপর নিয়ে আসে। সেখানেই তাকে শুইয়ে দেয়। শিবু এক নাগাড়ে বকে চলেছে। ’এ কি করলি মা, তুইও আমারে ছাইড়ে চইলে গেলি। আমিতো কাউকেই ধরে রাখতি পারলাম না। তুইও চইলে গিলি।’

বাঁধের উপর সারি সারি ছাপড়া ঘরগুলোর মাঝে যে জায়গা, সেই জায়গায় হাসির মরদেহটি শুইয়ে দেয়া হয়েছে। বাঁধের পাড়ার ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়ি, যুবক-যুবতী সকলেই উপচে পড়ে। নানান জন নানা কথা বলতে শুরু করে। এরই মধ্যে কে যেন বলে ওঠে, মাসতুতো ভাইয়ের সাথে প্রেমের ঘটনা মেনে না নেয়ায় মেয়েটা আত্মহত্যা করলো। একজন আর একজন হতে হতে সেই কথাই এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ঝড়ের কবলে পড়ে সব হারিয়ে বাঁধের উপর বাস করা পরিবারটির মেয়েটাও প্রেমের কারণে আত্মহত্যা করলো। পরদিন সকালে তা খুলনা শহর হতে প্রকাশিত সংবাদপত্রে খবর আকারে প্রকাশিত হয়।

বোশেখের তপ্ত বাতাসে মাথাটা বাঁশের খুঁটিতে ঠেকিয়ে দিয়ে শিবপদ দিনগুলোর কথা মনে করে আর অজান্তেই চোখের জলে বুক ভাসায়। ’ঠাকুরপো, ও ঠাকুরপো; ভাত খাবানা, আসো।’ রাঙা বৌদি’র ডাকে শিবু নড়েচড়ে বসে। রাঙা বৌদি তাকে খাওয়ার জন্যে ডাকছে। সোজা হয়ে বসে শিবপদ। মাথায় আসে কার যেন কথা, ’বাঁইচে থাকলি পেটেতো কিছু দিতি হবে।’ কেঁপে ওঠে শিবপদ। বাঁধ, চিংড়ি চাষ, নোনা পানি, ঝড় — সে আর স্থির থাকতে পারে না। আর্তনাদ করে ওঠে, ’আমার মানুষগুলো সক্কুলি আমারে ছাইড়ে গেছে।’

ঢাকি নদীর দিকে তাকিয়ে শিবু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বাঁধের উপর দিয়ে এক পা, দু’ পা ফেলে সামনের ঝুপড়ির দিকে এগুতে থাকে শিবপদ। (সমাপ্ত)

খুলনা গেজেট/ টি আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!