খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  ঢাকা শিশু হাসপাতালে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট
  রাজধানীর খিলগাঁওয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় যুবকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
  জাতীয় পতাকার নকশাকার, জাসদ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন

রাজনীতিক-সাংবাদিক সৈয়দ ঈসা ও আজকের গণতান্ত্রিক আন্দোলন

কাজী মোতাহার রহমান

দক্ষিণ জনপদের দক্ষ রাজনীতিক ও সাংবাদিক সৈয়দ ঈসা। ছাত্রজীবনে মার্কসবাদী দর্শনে, পরবর্তীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনের মানুষ। রাজনীতির পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে আঁকড়ে ধরে রাখেন আমৃত্যু। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নিজের দর্শনকে পাঠকের কাঁধে চাপিয়ে দেননি। সে কারণে তিনি অনেক মহলে জনপ্রিয় ছিলেন। রাজনীতি ও সাংবাদিকতাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন। জীবনের দুটি ক্ষেত্রেই তিনি নিবেদিত প্রাণ। রাজনীতিতে বেশিরভাগ সময় রাজপথে ছিলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। ভাত কাপড়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে বড় আসন তাকে আকর্ষণ করেনি।

তার রাজনৈতিক জীবন শুরু আইয়ুব শাহীর সামরিক শাসনের বেড়াজালের মধ্যে। পাকিস্তানের লৌহমানব জে. আইয়ুব খান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে জে. এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রগতিশীল শিবিরের তিনি অগ্রসৈনিক।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার তেতুলিয়া গ্রামে অবিভক্ত বাংলার ডেপুটি স্পিকার সৈয়দ জালালুদ্দিন হাশেমীর বংধর তিনি। এ বংশের উল্লেখযোগ্য রাজনীতিকরা হচ্ছেন, সৈয়দ কামাল বখত সাকী, সৈয়দ দিদার বখত ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা সৈয়দ কামেল বখত।

১৯৬২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে দৌলতপুর বিএল কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেই থেকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। তখন দেশে জে. আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। ১৯৬২ সালে শরীফ কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নেন। সামরিক শাসনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। মোঃ আবুল হোসেন রচিত সাতক্ষীরা জেলার ইতিহাস নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৬৭ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৮ সালে কারামুক্ত হন। ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। ছাত্রজীবন শেষে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপে যোগ দেন। মরহুম প্রফেসর বজলুল করিম রচিত ব্রজলাল কলেজের ইতিহাস নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, সৈয়দ ঈসা ১৯৬৯-৭০ সালে রূপসাস্থ পাকিস্তান ম্যাচ কোম্পানী ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে পর পর দুবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শ্রমিক নেতা হিসেবে রূপসায় শ্রমিকদের কাছে প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন।

ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৪-৬৫ সালে সাপ্তাহিক জনতায় যোগদানের মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু। তিনি খুলনা সাপ্তাহিক দেশের ডাক ও সাপ্তাহিক আওয়াজ পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া মাহামুদ আলম খানের সম্পাদনা সাপ্তাহিক স্বাধিকারের সহকারি সম্পাদক, পর্যায়ক্রমে দৈনিক পয়গাম, সংবাদ, দৈনিক বার্তা, দি ডেইলী স্টার, বার্তা সংস্থা ইউএনবি, সাপ্তাহিক হলিডে ও সাপ্তাহিক রোববারে দায়িত্ব্ পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত মুক্তি ও অভিযান নামে দুটি পত্রিকার সম্পাদনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭২ সালে তার সম্পাদনায় শান্তিধাম মোড় থেকে স্বকাল নামের সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়। স্বকাল পত্রিকায় দক্ষিণ জনপদের যুদ্ধাপরাধিদের নাম ও ঠিকানা প্রকাশিত হয়। ১৯৭৪ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক হক কথা’র খুলনা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রেডিও পাকিস্তান পরবর্তীতে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত সংবাদ পাঠক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে বিশেষ কালাকানুনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সাংবাদিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুর পর ন্যাপের ভূমিকা দূর্বল হয়ে পড়ে। তিনি ন্যাপ ছেড়ে জাগদল পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দেন। দীর্ঘসময় জেলা বিএনপির আহবায়ক ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬২ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ তালা থানা সদরে পাকিস্তানের চাঁদ-তারা খচিত পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে খুলনার বন্দুকের দোকান লুট করে অস্ত্র সংগ্রহ, তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক স্বকাল পত্রিকায় দক্ষিণ জনপদের যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রকাশ, ১৯৭৬ সালের ১৬ মেফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চে অংশগ্রহণ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খুলনার সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ্যাড. এ এইচ দেলদার আহমেদকে শীর্ষ নেতৃত্বে আনা এবং জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নামানোর জন্য দক্ষ ভূমিকা পালন করা এবং ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরে খুলনার গণদুশমনদের তালিকা তৈরীতে কারিগরের ভূমিকা পালন করেন।

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে জে. আইয়ুব খান সরকারের সংবাদপত্র বিরোধী কালাকানুন, ১৯৭১ সালে জে. ইয়াহিয়া খানের ৭৭ ও ১১০ নং বিধি, ১৯৭৪ সালের বিশেষ কালাকানুন, ১৯৮২-৯০ জে. এরশাদের স্বাধীন সংবাদপত্র বিরোধী কালাকানুন বাতিলের দাবিতে মিছিলে ও কলমে সরব ছিলেন। যদিও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নিজের মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন না। বলতেন তোমার স্বাধীন মতের সাথে আমি একমত নই, কিন্তু আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকায় তোমার মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কার্পন্য করব না। বানান ও বাক্যগঠনের ক্ষেত্রে তার জুড়ি ছিল না। বিশেষ করে গত দু’যুগে খুলনা বিএনপির বিবৃতি, বিজ্ঞপ্তি ও লিফলেটের ভাষা লিপিবদ্ধ করার সময় তার অনুপস্থিতি অনুভব হয়েছে। বিএনপির সভা-সমাবেশ, হরতাল, শ্রমিক আন্দোলন, পেশাজীবীদের আন্দোলন, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে কর্মসূচির লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দূর্যোগ, সিডর, আইলা, আম্পান, ইয়াস ও দ্রব্যমূল্যর উর্দ্বগতিরপ্রতিবাদে আজকের আন্দোলনে তার সরব উপস্থিতি নেই।

খুলনার ৯ পাটকল, নিউজপ্রিন্ট মিলস্, হার্ডবোর্ড মিলস্, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরী ও বাংলাদেশ ম্যাচ কোম্পানীর উৎপাদনের চাকা বন্ধের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা শ্রমিক আন্দোলনে তার অনুপস্থিতি এ অঞ্চলের মানুষের স্মৃতির মনিকোঠায় অনুভব করায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে তার সেই সরব কন্ঠের শ্লোগান আজ অনুপস্থিত। ২০১৪-২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের প্রতিবাদ মিছিলে তিনি নেই। থাকলে তার ভূমিকা আজকের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করত।

১৯৯৯ সালের ৩ মে দূরোরোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। ঘুমিয়ে আছেন তালা উপজেলার তেতুলতলা গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে। বিএনপির রাজনীতিতে আজকের সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে এবং দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন। কারাগারের নির্জনতা এড়ানোর জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অনুগ্রহের আশ্রয় নিতে গিয়ে বেগম জিয়ার রাজনৈতিক স্বকীয়তা ও স্বত্ত্বা হারিয়ে যাচ্ছে। আপোষহীন নেত্রীর খেতাবটি বঙ্গোপসাগরের অতল গহ্ববরে তলিয়ে যাচ্ছে। সংবিধানের ৩৮ ও ৩৯ ধারায় রাজনীতির অধিকার সকল নাগরিকের রয়েছে। এ অধিকার অনুযায়ী রাজপথে নামলেই তাদের মামলা ও হামলার শিকার হতে হয়। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ক্ষোভের সাথে বলেছেন কলেরায় মৃত্যু হলেও দলের নেতা-কর্মীদের নাম মামলা হয়। অপশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা অনেক ত্যাগের পরিচয় দিচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। আজকের বিরোধী শিবিরের রাজনীতিতে দিবস পালন, সাংবাদ সম্মেলন এবং দু-একটি প্রাণহীন বিবৃতি ছাড়া বিএনপির আর কিছুই নেই। নিষ্প্রাণ, ¤্রয়িমান বিরোধীদলের নেতাদের সরকার পতনের বুলি সরকারের গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগে না। বড় শহরগুলোতে দ্বিধাবিভক্ত নেতৃত্বের কারণে দলের বিকাশ হচ্ছে না। সমর্থকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা কাটছে না। কর্মী-সাথীরা নেতৃত্বের কমান্ডের বাইরে চলে গেছে। ভাড়া করা লোক দিয়ে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে তত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন বেগবান হবে না।

ইফতার মাহফিলে বচসা এবং হাতাহাতি নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণ। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতৃত্ব সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। প্রায় সমাবেশগুলোকে দলীয় কর্মীরা একে অপরের দিতে তেড়ে আসে। দক্ষ ও অভিজ্ঞ নেতৃত্বের জন্য সৈয়দ ঈসাকে বড় মনে পড়ে। বিএনপির নগর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ভাষা সৈনিক এম. নুরুল ইসলাম আক্ষেপ করে বারবার বলতেন সংকটাপন্ন মুহুর্তে বিএনপির বিবৃতি লেখার ক্ষেত্রে সৈয়দ ঈসার অভাব পূরণ হয়নি। রাজপথের মিছিলে তার সোচ্চার কন্ঠের শ্লোগান, মুষ্টিবদ্ধ উত্তোলিত হাত এবং দর্শকদের মন জয়করা তথ্যপূর্ণ ইতিবাচক এবং বিরোধী শিবিরের জনসমর্থন আদায়ের জন্য সেই বক্তব্যের অভাব রয়েই গেল। গণতন্ত্র আজ গুমরে গুমরে কাঁদছে। স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত কোন স্তরেই মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভুলুন্ঠিত হল। কিন্তু সৈয়দ ঈসার নেতৃত্বের শুণ্যতার পূরণ হল না।

সাবেক ছাত্রনেতা নুরে আলম সিদ্দিকীর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়, ইতিবাচক কর্মসূচি দিতে না পারায় বিএনপি বারবার হোচট খাচ্ছে। শীর্ষ নেতৃত্ব তৃণমূলের মতবিরোধ নিরসন করতে পারছে না। প্রতি মুহুর্তেই দলের নেতা-কর্মীরা হামলা মামলার শিকার হচ্ছে। দলের গঠনমূলক কর্মসূচী না থাকায় হতাশার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে তৃণমূলের কর্মীরা। এটি গণতন্ত্র চর্চার ব্যর্থতার নামান্তর মাত্র। তার মৃত্যুবার্ষিকীর এমন একটি মূহুর্তে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ত্যাগ স্বীকার ও মানুষের কল্যাণে ভূমিকা রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তার কর্মময় জীবন ত্যাগী রাজনীতিকদের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন ত্যাগী রাজনীতিকদের হৃদয় মন্দিরে। মৃত্যু বার্ষিকীর এই সময় তার আত্মার মাগফেরত কামনা করি।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!