খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  নোয়াখালীর হাতিয়ায় ১২ নাবিকসহ কার্গো জাহাজ ডুবি
  অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা চুয়েট; শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ
  প্রতিবাদে বাসে আগুন ও প্রশাসনিক ভবনে তালা
  আগামী রোববার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি, ৪ মে শনিবারও শ্রেণী কার্যক্রম চালু থাকবে : শিক্ষা মন্ত্রণালয়
  সাতক্ষীরায় সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক নিহত

মোস্তফা মোহসীন মন্টু সাহেবকে গ্রেপ্তার

এ এম কামরুল ইসলাম

পুলিশ কন্ট্রোল রুমের গোপন কক্ষে সিদ্ধান্ত হলো রাতের মধ্যেই আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা মোহসীন মন্টু সাহেবকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তিনি তখন ছিলেন আন্দোলনের হোতা। তাঁর কথায় কেরানিগঞ্জ থেকে ঢাকা শহরের অধিকাংশ আন্দোলনকারীরা জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল। তাঁকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত অনেক উপর থেকে আসার কারণে পুলিশের কিছু সিনিয়র অফিসার শুধুমাত্র অবহিত ছিলেন। তাঁর গ্রেপ্তার কার্যকর করার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করার সময় ডিসি সাউথ মহোদয় আমাকে স্মরণ করলেন। মন্টু সাহেবের বাড়ি এলিফ্যান্ট রোডে হওয়ায় তাঁর অনেক খবর আমার জানা ছিল। কারণ এর আগে আমি ধানমন্ডি থানায় চাকরি করেছিলাম।

পুলিশ কমিশনার মহোদয় প্রথমেই বললেন, ‘একটা গোপন বিষয় নিয়ে আলাপ করবো। তুমি কাউকে বলবে না’।

তারপর বললেন, ‘তুমি মন্টু সাহেবকে চিনো? তিনি এখন কোথায় আছেন তা জানো’?

আমি বললাম, আমি চিনি স্যার। তবে এই আন্দোলনের মধ্যে কোথায় তিনি আছেন তা জানতে হবে।

পুলিশ কমিশনার মহোদয় তৎক্ষনাৎ আমাকে মন্টু সাহেবের খবর নিতে পাঠিয়ে দিলেন। আমি রাতের কারফিউয়ের মধ্যে জীবন বাজি রেখে মন্টু সাহেবের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই তাঁর এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ির আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে মনে হলো তিনি বাড়িতে আছেন। তারপরও তাঁর অবস্থান আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য মল্লিকা সিনেমা হলের পিছনে একটা ঝুঁকিপূর্ণ গোপন জায়গায় গেলাম। সেখানে গিয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতা পল এবং ছাত্রদল নেতা সফুকে খুঁজে বের করলাম। আমি জানতাম তারা ওখানেই লুকিয়ে থেকে আন্দোলন করে। ওরা দুজনেই আমার বিশেষ ভক্ত ছিল। কারণ আমি ধানমন্ডি থানায় চাকরি করাকালীন ওদের দুজনকে আটক করার জন্য বারবার নির্দেশ এসেছিল। কিন্তু ওরা দুজন আমাকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা-ভক্তি করায় আটক করতে মন সায় দিতো না। একথা ওরাও জানতেন। ওদের দুজনকে আটক না করার জন্য ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জনাব আবুল হোসেন সাহেব একবার আমার বিরুদ্ধে উপর মহলে নালিশ দিয়েছিলেন। তারপরও ওরা আটক না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত অধ্যক্ষ মহোদয় ঢাকা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব শামসুর রহমান সাহেবের কাছে নালিশ দিয়েছিলেন। জনাব শামসুর রহমান সাহেব ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। তিনি আমাকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ জনাব আবুল হোসেন সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তখন বরিশাল কোতোয়ালি থানায় চাকরি করতাম।

যা বলছিলাম। পল ও সফুর সাথে দেখা করে মন্টু সাহেবের অবস্থান জানতে চাইলে তারা নির্দ্বিধায় বললেন, ‘মন্টু ভাই বাসায় আছেন। তাকে ধরতে গেলে আপনার পুলিশ জান নিয়ে ফিরতে পারবে না। বিশ্বাস না হয় আপনি চলেন। আপনি নিজেই টের পাবেন’।

অলি-গলি পথ দিয়ে ওরা দুজনে আমাকে মন্টু সাহেবের বাসার পিছনে নিয়ে গেলেন। আমি দেখলাম, কারফিউয়ের মধ্যে অলিতে গলিতে প্রচুর নেতা কর্মী অবস্থান করছেন। মন্টু সাহেবের বিশাল বাড়ির ভিতরে লোকে লোকারণ্য। সেখানে আন্দোলনকারীদের জন্য প্রতিদিন তিন বেলা রান্না খাওয়া চলে এবং মন্টু সাহেবের নির্দেশ মতো সবাই আন্দোলন করেন।

আমি সেখান থেকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফিরে পুলিশ কমিশনারসহ সকল অফিসারকে সব কাহিনী জানালাম। সাথে সাথে বললাম, মন্টু সাহেবকে এই মুহূর্তে আটক করলে পরিণতি খারাপের দিকে যেতে পারে এবং তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে আটক করতে গেলে পুলিশের ক্ষয়ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা আছে।

আমার কথা শুনে পুলিশ কমিশনার মহোদয় একমত হলেন। তাঁর কাছে আমার তথ্যের সমর্থনে আরো নিউজ ছিল বলে জানালেন। তিনি রেড টেলিফোনে এসব কথা উপর মহলে জানালেও কোন ফল হলো না। রাতের মধ্যেই যেকোন প্রকারে মন্টু সাহেবকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ পেয়ে কয়েক প্লাটুন পুলিশ দিয়ে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা ব্যর্থ হলো। বরং আমার দেওয়া তথ্যমতো অনেক পুলিশ আহত হলো এবং পুলিশের দুটো রাইফেল লুট হলো। কিন্তু সারারাত চেষ্টা করেও পুলিশ তাঁর বাড়িতে ঢুকতে পারলো না। অথবা উপরের নির্দেশে পুলিশ কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়ে ভোরবেলায় কন্ট্রোল রুমে ফিরে এলো।

পুলিশের লুন্ঠিত রাইফেল উদ্ধার না করতে পেরে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হলো। এদিকে বিনা রক্তপাতে মন্টু সাহেবকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ এলো। তখন আবার আমার ডাক পড়লো। আমি অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের অফিসার হলেও আমার গুরুত্ব বেড়ে গেল। আমিও বেশ সাহসের সাথে সবকিছু মোকাবেলা করতে লাগলাম।

এক পর্যায়ে পুলিশ কমিশনার মহোদয় নিজে আমাকে বললেন, ‘তুমি কি কোন প্রকারে ম্যানেজ করে মন্টু সাহেবকে আমার কাছে আনতে পারবে? তাঁর কোন অমর্যাদা হবে না। তাঁকে এখান থেকে স্ব- সম্মানে আমার গাড়িতে করে জেলে পাঠানো হবে। তাতে আমার সম্মান বাঁচবে, তিনিও রেহাই পাবেন। অন্যথায় এখনই আমাকে সর্বশক্তি নিয়ে জোর করে তাঁর বাড়িতে ঢুকে গ্রেপ্তার করতে হবে’।

আমি বললাম, স্যার আপনি চাইলে আমি একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি।

কমিশনার মহোদয়ের কথা মতো আমি সকাল দশটার দিকে মন্টু সাহেবের বাড়ির গেটে হাজির হলাম। সারারাত নেতাকর্মীরা পুলিশের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হলেও অনেকে বাড়ির গেটেই অবস্থান করছিলেন। সাদা পোশাকে আমাকে দেখে সবাই অবাক হলেন। পল ও সফু দৌঁড়ে এসে পুলিশের আহত নিহতের খবর জানতে চাইলেন। আমি তাদেরকে বললাম, আগে আমাকে ভিতরে নাও তারপর কথা বলবো। সাথে সাথে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে ওরা আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন।

মন্টু সাহেব আমাকে ভীষণ আদর করতেন। তাঁকে আমি ‘মন্টু ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। তিনিও আমাকে আদর করে ‘কামরুল ভাই’ বলে ডাকতেন। পল ও সফু আমাকে মন্টু সাহেবের সাথে কথা বলার সুযোগ দিয়ে ওরা অন্য ঘরে গেলেন। আমি দ্রুত সব কথা মন্টু সাহেবের সাথে শেয়ার করলে তিনি গতরাতের সকল ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘আমি আপনার সাথে যাবো। তবে একজন পুলিশ আসলেও আমি যাবো না। আপনি আপনার মোটরসাইকেলে করে যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যাবো’।

আমি তাঁকে সকল সম্মান রাখার আশ্বাস দিলাম। তিনি কাপড় পাল্টে নেতাকর্মীদের শান্ত করে আমার মোটর সাইকেলে উঠলেন। আমি তাঁকে নিয়ে সোজা কন্ট্রোল রুমে হাজির হওয়ার পর সকল অফিসার রীতিমতো বিস্মিত হলেন। মোটামুটি সকলেই তাঁকে তোষামোদ করতে লাগলেন। পুলিশ কমিশনার মহোদয় একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিলেন।

কিন্তু, আর এক বিড়ম্বনায় পড়ে গেলাম। পুলিশ কমিশনার মহোদয় মন্টু সাহেবকে একটু খুশি করতে গিয়ে বললেন, ‘আমি সকাল থেকে নাস্তা খাইনি। আপনার জন্য বসে ছিলাম। আপনি কী নাস্তা খাবেন? আমিও তাই খাবো।

মন্টু সাহেব একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘আমি পুলিশের কিছুই খাবো না। আমারও ক্ষুধা লেগেছে। আমার নেতা কর্মীরা সারারাত জেগে আছে। ওদের জন্য আজ সকালে নাস্তা দিতে পারিনি। তবু জান বাঁচাতে কিছু খাবো। তবে সেটা পুলিশের পয়সায় খাবো না। আমার ছোটভাই কামরুল তার পকেটের টাকা দিয়ে যা এনে দেবে আমি তাই খাবো’।

কমিশনার মহোদয়ের মুখ লাল হয়ে গেল। আমিও থতমত খেয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। কমিশনার মহোদয় আমাকে বললেন, ‘কামরুল তুমি তাঁর খাবার ব্যবস্থা কর। তারপর আমার গাড়িতে করে সরাসরি জেলখানায় দিয়ে এসো’।

আমি কমিশনার মহোদয়ের নির্দেশ মোতাবেক সব কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করলাম।

এখানে বলে রাখা ভাল- ঐ আমলে যাদের অগ্রিম ডিটেনশন দেওয়া হতো তাদেরকে কোর্টে পাঠানো লাগতো না। সরাসরি জেলখানায় পাঠানো হতো।

গ্রেপ্তার নাটকের যবনিকাপাত হলো। এবার পুলিশের লুন্ঠিত রাইফেল উদ্ধারের পালা।

আমার গুরুত্ব বাড়তে লাগলো। মন্টু সাহেবকে জেলখানায় রেখে ফেরত আসার পর আমার খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ঘন ঘন সকল অফিসার আমাকে ডেকে পরামর্শ করতে লাগলেন। সকলেই লুণ্ঠিত রাইফেল উদ্ধারের প্রতিযোগিতায় জয়লাভের আশায় সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। যাঁর যাঁর সোর্স নিয়োগ করে তথ্য সংগ্রহ শুরু করলেন। কিন্তু কাজের কাজটি কেউ করতে পারলেন না। সবাই হতাশ হয়ে এক প্রকার হাল ছেড়ে দিলেন।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। কারফিউ কখনও শিথিল, কখনও কঠিন হতে লাগলো। অবরুদ্ধ নগরবাসী কারফিউ পাশ নিতে বরাবরের মতো পুলিশের কাছে ধর্ণা দিতে লাগলেন। কারফিউ পাশ দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ডিবি পিআর অফিসের। আমাকে সেইদিকে বেশি সময় দিতে হতো। সব কাজের মধ্যে গত রাতের লুণ্ঠিত রাইফেল উদ্ধারের জন্য আমাকে সর্বশক্তি ও মেধা প্রয়োগের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। ইতোমধ্যে সকলের চেষ্টা ব্যর্থ ও জারিজুরি শেষ হয়েছিল। উপর মহল থেকে ঘন ঘন চাপ আসতে লাগলো। পুলিশের ব্যর্থতার জন্য কয়েকজন পুলিশকে কন্ট্রোল রুমে এক প্রকার আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। গতরাতের ঘটনার ব্যর্থতার দায় দায়িত্ব নিরূপনের জন্য কমিটি গঠিত হলো। কিন্তু আসল কাজটি কেউ করতে পারলেন না।

অবশেষে ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’ কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত হলো। কন্ট্রোল রুমের রুদ্ধদার বৈঠকে আমাকে ডাকা হলো। সেখানে সকল উর্ধতন অফিসার হাজির ছিলেন। তাঁরা সকলে একত্রিত হয়ে আমার উপরে গতরাতের লুন্ঠিত রাইফেল দুটি উদ্ধারের দায়িত্ব দিয়ে অন্য সকল কাজ থেকে মুক্ত করে দিলেন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় সিনিয়র এসি জনাব খালেক উজ জামান সাহেবকে আমার সকল কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য নিযুক্ত করলেন।

আঁধার ঘনিয়ে এলো। আমার কাজও শুরু হলো। কন্ট্রোল রুম থেকে বের হয়ে আমি নেমে পড়লাম পল ও সপুর খোঁজে। আগেই বলেছি, পল ছিলেন ছাত্রলীগ ও সপু ছিলেন ছাত্রদলের নেতা। এরশাদ পতন আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। পুলিশি ধরপাকড়ের মধ্যে তাদেরকে খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য ছিল। আজকালের মতো তখন মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না।

কারফিউ উপেক্ষা করে রাতের আঁধারে জীবন বাজি রেখে ওরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন; আর আমি ওদের সাথে দেখা করার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগলাম। আমার জানামতে কারফিউ এর ভিতর টহলরত আর্মি, বিডিআর, পুলিশের গুলিতে প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছিল। এমনকি রাজারবাগে কর্মরত একজন পুলিশের হাবিলদার সিভিল ড্রেসে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন। সবকিছু উপেক্ষা করে আমার সেই লুন্ঠিত রাইফেল উদ্ধারের চেষ্টা এগিয়ে চললো।

বহু সাধনার পর এক পর্যায়ে পলকে পাওয়া গেলেও সপুর সন্ধান মিললো না। পলের সাথে থাকা সকলকে সরিয়ে দিয়ে আমরা দু’জনে একটা গোপন জায়গায় চলে গেলাম। তারপর পলকে আমার অসহায়ত্ব ও কয়েকজন পুলিশের চাকরির সমস্যার কথা জানালাম। কিন্তু কোনমতেই তিনি রাইফেলের সন্ধান দিতে রাজি হলেন না। আমি দেখলাম, তার মধ্যে দুটো জিনিস কাজ করছিল।

এক. পুলিশের কাছ থেকে লুন্ঠিত রাইফেল যার কাছ থেকে উদ্ধার হবে সেই প্রকৃত দোষী হবে।

দুই. রাইফেল লুট হওয়ার ঘটনা তার পুরাপুরি নলেজে ছিল, কিন্তু লুট হওয়ার পর কার হেফাজতে ঐ রাইফেল দুটো ছিল তা সঠিকভাবে তার জানা ছিল না।

পল আমার অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে আমাকে সকল প্রকার সহায়তা করতে রাজি হলেন। তবে দুটো কঠিন শর্ত জুড়ে দিলেন।

এক. রাইফেল দুটোর বর্তমান অবস্থান জেনে তার হেফাজতে আনতে কয়েক ঘন্টা সময় চাইলেন।

দুই. তিনি রাইফেল ফেরত দিলে তার বিরুদ্ধে বা তার কোন লোকের নামে মামলা করা যাবে না।

প্রথম শর্তে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম, রাইফেল দুটি অন্ততঃ তার কাছে নেই। অতএব তাকে সময় দিতেই হবে। কিন্তু দ্বিতীয় শর্ত নিয়ে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। কারণ ঐ শর্ত মেনে নেওয়ার ক্ষমতা আমার একার ছিল না। কোন ঘটনায় পুলিশ আহত নিহত হলে বা পুলিশের অস্ত্র লুট হলে মামলা নিশ্চিত তা আমি জানতাম।

সুতরাং পলকে রাইফেল সন্ধানের সুযোগ দিয়ে আমি আবার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গিয়ে মাননীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের সাথে দেখা করে খোলামেলা আলাপ করলাম। তৎকালীন পুলিশ কমিশনার জনাব গোলাম মোর্শেদ সাহেবকে যারা চিনতেন তারা সহজেই বুঝবেন, তাঁর কলিজা কত বড় ছিল। তিনি যা ভাল মনে করতেন তা করতে কোন প্রকার পিছপা হতেন না। আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে, দূর্দান্ত সাহসী পদক্ষেপ নিতে তিনি একটুও বিচলিত হতেন না।

এখানে একটা ঘটনা বললে তাঁর সাহসের কিছুটা নমুনা বুঝা যাবে।

ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কারফিউ যখন মানুষের জন্য দুর্বিষহ হয়ে পড়লো তখন একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘এই কামরুল, জামান কোথায়’ (এসি জনাব খালেক উজ জামান)?

আমি বললাম, ডেকে আনি স্যার।

তিনি বললেন, ‘ডাকা লাগবে না। তুমি জলদি একটা প্রেস রিলিজ লিখে আনো’।

আমি বললাম, কি বিষয় স্যার?

তিনি বললেন, ‘সারাদেশে সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হলো বলে সুন্দর একটা প্রেস রিলিজ লিখে আমার স্বাক্ষর নিয়ে এখনই টেলিভিশন, রেডিও এবং সকল মিডিয়ায় দিয়ে আসো’।

আমি সাহস করে বললাম, স্যার সমগ্র দেশের কারফিউ শিথিল করার প্রেস রিলিজে আপনি স্বাক্ষর করবেন কিভাবে? শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার কারফিউ শিথিল করতে হলে আপনার স্বাক্ষর করার ক্ষমতা আছে।

তিনি আমার কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিজে আমাকে রেড ফোনে বলেছেন। এখন কি করি?

আচ্ছা, সারাদেশের কারফিউ শিথিল করতে হলে প্রেস রিলিজে কে স্বাক্ষর করবে’?

আমি বললাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউ স্যার।

স্যার বললেন, ‘আচ্ছা। তুমি প্রেস রিলিজ লিখে আমার নাম দিয়ে লেখো, গোলাম মোর্শেদ, পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়’।

আমি তাঁর সাথে তর্কে না গিয়ে তাঁর কথামতো কাজ করলাম। তিনি তাতে স্বাক্ষর করে তখনই আমাকে টেলিভিশন, রেডিও এবং খবরের কাগজে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কারফিউয়ের ভিতরে আমি সামনে পিছনে দুটো আর্মড গার্ড নিয়ে সব জায়গায় পৌঁছে দিলাম।

যাহোক, আমি কন্ট্রোল রুমে ফিরে গেলাম। পল চলে গেলেন রাইফেলের সন্ধানে। মাননীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের সাথে দেখা করে সব কথা খুলে বললাম। তিনি এক বাক্যে বললেন, ‘রাইফেল দুটো ফেরত দিলে গতকাল রাতের ঘটনায় কারো নামে মামলা হবে না। তুমি তোমার মতো কাজ কর’।

মাননীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের আশ্বাস পেয়ে আমি আবার রাইফেল দুটোর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম এবং পলকে খুঁজে বের করলাম। মাননীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের দেওয়া আশ্বাসের কথা তাকে শুনানোর পর তিনি আমাকে বিশ্বাস করলেন এবং রাইফেল উদ্ধারের জন্য আরো তৎপর হলেন। দীর্ঘ চেষ্টার পর গভীর রাতে তিনি আমাকে একটা ঝুপড়ি ঘরের ভিতর নিয়ে রাইফেল দুটো দেখিয়ে দিয়ে সাথে সাথে চলে গেলেন।

আমি আবারও ঝামেলায় পড়লাম। এতো রাতে দুটো রাইফেল নিয়ে আমি সাদা পোশাকে কিভাবে এলিফ্যান্ট রোড থেকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যাবো, তাই ভাবতে লাগলাম। তখন না ছিল কোন রিকশা বা কোন বাহন। রাতভর ছিল কারফিউ। মোবাইল ফোনের আবিস্কারও তখন হয়নি। আমার কাছে ছিল না কোন ওয়ারলেস। আবার লুন্ঠিত রাইফেল এত কষ্টে হাতে পেয়ে হাতছাড়া করার প্রশ্নই ওঠে না।

শেষ পর্যন্ত মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। দুটো রাইফেল দুই হাতে নিয়ে পাশ্ববর্তী মল্লিকা সিনেমা হলের পিছনের গেটে গিয়ে দারোয়ানকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। তিনি এতো রাতে আমাকে দুটো রাইফেল হাতে দেখে মারাত্মক ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় সাহস করে ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে ম্যানেজার সাহেবের রুমে নিয়ে বসতে দিলেন। কারফিউ এর কারণে তখন সিনেমা হল বন্ধ থাকায় ম্যানেজার সাহেব সেখানে ছিলেন না। সিনেমা হলের টেলিফোন খোলা পেয়ে দ্রুত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে মল্লিকা সিনেমা হলের সামনে ফোর্সসহ গাড়ী পাঠাতে বললাম। দশ মিনিটের ভিতর গাড়ী চলে এলে আমি রাইফেল দুটো নিয়ে যুদ্ধজয়ীর মতো গাড়িতে উঠে পড়লাম। আমাদের গাড়ি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে পৌঁছার সাথে সাথে সমগ্র কন্ট্রোল রুম এলাকায় স্বস্তি ফিরে এলো। গতরাত থেকে যারা বন্দীদশায় ছিলেন তারা সকলেই মুক্তি পেলেন। উর্ধতন অফিসারবৃন্দ সরকারের উপর মহলে সংবাদ দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!