খুলনা, বাংলাদেশ | ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ | ২৯ মার্চ, ২০২৪

Breaking News

  দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫
  গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ২

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্বামী-সন্তানের অপেক্ষায় এখনো দিন কাটে জোহুরার

শেখ নাদীর শাহ্, পাইকগাছা

স্বামী মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে ট্রেনিং শেষে দেশে ফেরার পথে ধরা পড়েন পাক বাহিনীর হাতে, এরপর স্বামীর মৃত্যুর খবরে দেশে ফেরার পথে মেয়েকে ছিনিয়ে নেয় খান সেনারা। সাথে থাকা এক ভাই তার বোনকে উদ্ধারে খান সেনাদের পিছু নিলে সেও গুলিদ্ধি হয়। এরপর কেটে গেছে ৫১ টি বছর। তবু ফিরে আসেনি স্বামী কিংবা মেয়ে। তারপরও অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি বয়োবৃদ্ধা জোহুরা বেগমের।

স্বাধীনতার ৫১ বছরেও কেউ খোঁজ নেয়নি তাঁর। খবর রাখেনি কোন সরকার কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের কেউ। জীবনের পড়ন্ত বেলায় কেবল শৈশব-কৈশর কিংবা দাম্পত্য সর্বোপরী যুদ্ধকালীন লোমহর্ষক মর্মান্তিক বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতি হাতড়ে সময় কাটে তাঁর। সরকারের কাছে স্বীকৃতি চান স্বামী ও সন্তান হারা হতভাগা মা জোহুরা।

যুদ্ধকালীন নির্মম বিয়োগান্তক ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী জোহুরা বেগমের করুণ আর্তি, জীবনের শেষ সময়ে স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চোখে দেখে যেতে চাই। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কান্নামেশানো গলায় কথাগুলো বলছিলেন তিনি। যুদ্ধকালীন বলা না বলা কথা মালার বর্ণনা দিতে গিয়ে খানিকটা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। কথোপকথনের মধ্যে একাধিকবার মূর্ছা যান বয়োবৃদ্ধা শহীদ এ মুক্তিযোদ্ধা পত্নী।

১৯৭১ সাল। চারিদিকে শুরু হয়ে গেছে মুক্তিকামী মানুষের সাথে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের তুমুল লড়াই। প্রান্তর জুড়ে প্রতিরোধ। গোটা দেশ যেন রণক্ষেত্র। বাড়ছে লাশের মিছিল। সর্বহারা উদ্বাস্তুর সারিও প্রসারিত হচ্ছে। সেদিন মুক্তিকামী দামাল ছেলেদের কাতারে নিজের নামটিও সংযুক্ত করেন, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের মহন্দীর নিভৃত পল্লীর মৃত কাতার আলী সরদার ও গুলজান বিবির ছেলে এবং স্থানীয় ওয়ার্ড ইউ‌পি সদস্য আব্দুল সরদার। স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ট্রেনিং নিতে চলে যান ভারতে।

এব্যাপারে সাতক্ষীরার তালা থানার বীর মুক্তিযোদ্ধা অমলকান্তি ঘোষ জানান, তিনি ভারতের বসিরহাট পিপা ক্যাম্প থেকে বিহার-চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে টেনিং নেন। তার র‌্যাঙ্ক ছিল এফ এফ। তার মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং হেড কোয়ার্টার ছিল কল্যাণী। সেখান থেকে সেক্টর অনুযায়ী বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। তিনি মেজর জলিলের অধিনে ৯নং সেক্টরে যুুুুুুুুুুুুুুুুুুুদ্ধ করেন। অন্যদিকে আব্দুল সরদারসহ অন্যরা বসিরহাটের টাকী ক্যাম্প থেকে ট্রেনিং নিয়ে ৬/৭ জন বাংলাদেশে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় পৌছালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আলাউদ্দীন জোয়াদ্দার (সাবেক ডেপুটি কমান্ডার), মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, তালা উপজেলা শাখা বলেন, তিনি শুনেছেন ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন তালার আলী আহমদ, আব্দুল সরদার আরো ৬/৭ জন ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় পৌছালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। এরপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তালা উপজেলা শাখার কমান্ডার মোঃ মফিজ উদ্দীন বলেন, আলী আহমদ, আব্দুল সরদার, মুনতাজসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় পৌছালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। এরপর তাদেরকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর বয়স বিবেচনায় মুনতাজকে ছেড়ে দেওয়া হয়। নির্মম নির্যাতন শেষে অন্যদের সাথে খুলনার গল্লামারী নিয়ে তাদেরকে হত্যা করা হয় বলে তিনি শুনেছেন।

আব্দুল সরদারের মেঝ ছেলে আজগর সরদার জানান, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তারা জানতে পারেন, অন্যদের সাথে তার পিতাকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর নির্মম নির্যাতন শেষে অন্যদের সাথে খুলনার গল্লামারী নিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। তবে তখনো খবরটি তাদের কাছে পৌছায়নি।

এর আগে স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গেছেন এমন খবরে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীরা তাদের বাড়িতে হামলাসহ পরিবারের সদস্যদের প্রতি নির্যাতন শুরু করে। অগ্নিসংযোগ করে তাদের বসত-বাড়িতে। এক পর্যায়ে নিরুপায় হয়ে তার স্ত্রী জোহুরা ২ ছেলে আজগর, রহমত ও ৪ মেয়ে আছিয়া, রশিদা, সুফিয়া ও সাহিদাকে নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান। সেখানে আশ্রয় নেন শরনার্থী শিবিরে। সেখানে অবস্থানকালীণ কিছু দিন পর লোক মারফত খবর পান তার স্বামী পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েছে।

এরপর সেখান থেকে তড়ি-ঘড়ি করে সন্তানদের নিয়ে বেনাপোল বন্দর হয়ে সাতক্ষীরার উপর দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তারাও ধরা পড়ে পাকিস্তানীর হাতে। এসময় পাক সেনারা তার কাছ থেকে তার (সেঝ) সুন্দরী কিশোরী মেয়ে সুফিয়াকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তার মেঝ ছেলে আজগর বোনের পিছু নিলে তারা তাকেও লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে একটি গুলি তার ডান হাত ও আরেকটি পাশ ঘেষে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। মূমুর্ষ অবস্থায় সকলে যখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত ততক্ষণে বোন সুফিয়াকে নিয়ে হায়েনারা চলে যায়। তারপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তোবা তাদের পাশবিক নির্যাতনে এক সময় সেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।

এরপর দেশ স্বাধীনের বছর খানেক পর জোহুরা ও তার সন্তানরা লোক মারফত নিশ্চিত হয় তাদের বাবা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফেরার পথে ধরা পড়ে শহীদ হন। অথচ স্বাধীনতার ৫১ বছরেও তাদের খোঁজ রাখেনি কোন সরকার। খবর নেয়নি মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কেউ।

আব্দুল সরদারের নাতনী পাইকগাছার কাশিমনগর গ্রামের ইসহাক আলী মোড়লের মেয়ে লিলিমা খাতুন বলেন, শৈশব থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে তার নানা, খালা-মামাদের উপর ঘটে যাওয়া নির্মম কাহিনী শুনতে শুনতেই বড় হয়েছেন তিনি। গল্প শুনে যুদ্ধকালীন ঘটনার বর্ণনাই তার মুখস্ত হয়ে গেছে। নানী, মা, মামা-খালাদের পাশাপাশি তারও দাবি, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথায় আঁচড় পড়ুক তার নানা ও খালার নাম দু’টিও।

তিনি আরও জানান, বীরঙ্গনা কাকে বলে ঠিক জানেন না। তবে যুদ্ধকালীন সর্বহারা নারীকে বীরঙ্গনার মুকুট দিলে তার খালা সুফিয়াও নিজেকে বিসর্জন দিয়ে বিজয়ীনী লাল-সবুজের পতাকায় নিজের নামটিও লিখে গেছেন।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পর কোন স্বার্থে নয়, এমনকি কোন ভাতা বা ভিন্ন উদ্দেশ্যে নয়, তারা চান ন্যুনতম সম্মান।

আব্দুল সরদারের মেঝ ছেলে ভ‌্যান চালক আজগর সরদার বলেন, তিনি যুদ্ধ করেননি, তবে গর্বের সাথে বীরের ছেলে বলে নিজেকে দাবি করেন। সেদিন দেশে ফেরার পথে পাকিস্তানীদের হাত থেকে নিজের বোনকে বাঁচাতে নিজেও গুলিবিদ্ধ হন। তিনি দাবি করেন, পিতার মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে গত ৫০ বছরে তার মা জোহুরা বেগম কারো সাথে খুব বেশী কথা বলেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে এখনো আৎকে উঠেন। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে এখনো অপেক্ষা করেন, স্বামী ও মেয়ের ফিরে আসার। এক সময় নিরাশ হয়ে আবারো চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। হয়তো স্বামীর বীরত্বগাঁথায় এখনো নিজেকে গর্বিত অনুভব করেন।

জোহুরা বেগম বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এখনো পর্যন্ত স্বামী-সন্তানের অপেক্ষায় আছেন। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, ফিরে আসবে তারা। তাদের যে এখনো অনেক কথা বলার বাকি আছে তার।

 

 

খুলনা গেজেট/ আ হ আ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!