খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  ঢাকা শিশু হাসপাতালে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট
  রাজধানীর খিলগাঁওয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় যুবকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
  জাতীয় পতাকার নকশাকার, জাসদ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন

মা

ডা. তনুশ্রী ডাকুয়া

ট্রেনের হুইসেলে ঘুম টা ভাংলো মারিয়ামের। চোখ টা না লেগে কই যাবে সেই সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা কি কম পথ!আরো ইদের বেলা। ১৪ ঘন্টা টানা বসার অভ্যাস ও তো মারিয়াম দের মতো কাজের মানুষ দের নেই।
“ভাইজান ঢাহা কি চইলা আইসি?” পাশে বসা মাঝ বয়সী এক অপরিচিত কে জিজ্ঞাসা করে মারিয়াম।
” জ্বী” ওপাশ থেকে ছোট্ট উত্তর।
ট্রেন থেকে নেমে কোনো ভাবে শুনে শুনে বাস ধরে কোথাও বা হেঁটে পৌঁছে গেসে সে।হা সে মল্লিক নিবাসের সামনে। একদিন তাকে একাই চলে আসতে হবে এত দূরে সে কি কখনো ভেবেসিল! কি করবে নাড়ির টান, না চাইলেও টেনে আনে। সে তার স্বামীর কাছে শুনেছে এই মল্লিক নিবাসেই ৩ বছর আগে রেখে গেছিলো তার চোখের মণিকে। নামও রাখে নি তখন পিচ্চিটার পরী বলে ডাকতো।কি সুন্দর দেখতে, মায়া ভরা চোখ, গ্রামের সবাই বলতো ” কিরে মারিয়াম কার মাইয়া চুরি কইরা আনচ হাচা কইরা ক দেহি” মারিয়াম কিছু বলতো না লজ্জায় যেনো শ্যামলা মুখটা লালচে হয়ে জেতো। আম পাতায় তেল লাগিয়ে কেরসিনের বাতিতে ধরে কাজল বানিয়ে লাগিয়ে রাখতো কপালের মাঝখানে।
“কাকে চাই?” হাতে লাঠি পুলিশের মতন পোশাক পরা লোকটার হাঁকে ঘোর কাটল।
” জ্বী মানে মুই মল্লিক সাহেবের বাড়িতে আইজ থেইক্কা কামে আইছি ওই গেরাম দিয়া” চোখটা মুছে নিয়ে বলল।
পুলিশের পোশাক পরা লোকটা কাকে টেলিফোন করলো, এক জন সাহেবের বউ দের মত মহিলা নেমে আসলেন।
” তুমি মারিয়াম?”
” হ আম্মা”
“আম্মা ডাকবে না আমায়, আপা বলবে”
” আইচ্চা” চোখ নিচু করে উত্তর দেয় মারিয়াম
” জামিল গেট টা খুলে দাও,, এই মারিয়াম তুমি আস”
ওর মধ্যে যেন একটা অস্থিরতা লাগছে, কত দিন পরে দেখবে পরীকে,ওর চোখের মণি।
কই কোথায় পরী, ওর কাছে আসছে নাতো
কি ছাই পাশ ভাবছে ওর কথা কি মনে আছে পরীর সেই ২মাস বয়সে দেখেছে।
” আফা বাসায় কি আফনে একাই থাহেন?”
“না আমি আর আমার মেয়ে, মেয়ের বাবা বিদেশেই থাকেন অর্ধ বছর”
“আফা আম্মাজান কোই?”
“ও ঘুমাচ্ছে, তুমি যাও গোছল করে আস, আর শুন অপরিষ্কার ভাবে কখনো আমার মেয়ের কাছে যাবে না,বুজেছো?আর আম্মা ডাকবা না ওর নাম জেরিন, জেরিন মামনি ডাকবা”
“মামনির ঘর ডা কোন দিকে আফা?অহন যামু না এম্নেই জিগাই”
দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন নিজের কাজে মিসেস মল্লিক।
মেয়ে কে এক পলক দেখার লোভ কিভাবে সাম্লাবে? দূর থেকে দেখলো, চোখ ফেরানই যায় না অখনো একি রকম সুন্দর।
না আফা দেহে নাই, চারপাশে দেখে নিয়ে গোসলে গেল।



অপেক্ষায় আছে কখন পরীর ঘুম ভাংবে, এক টা বার নিজের কাছে জড়িয়ে নিবে….
বিকেলে চা করছিলো মারিয়াম,সব কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে আপা তাকে।
“কে তুমি,আমাদের বাসায় নতুন বুঝি?”
ছোট্ট আদুরে গলার কথা শুনে তাকিয়ে দেখে তার পরী, হাতে কি সুন্দর একটা পুতুল।একদম রাজকন্যে লাগছে।
“আম্মা,পরী আমার,কেমন আছোস আম্মাজান আমার” বলেই জড়িয়ে নিল সে।
“ভায়ায়ায়ায়ায়ায়ালো” বলেই পালালো।
প্রথম প্রথম পরী আসতে চাইতোনা মারিয়ামের কাছে। বলতো ” এ মা কি পচা কয়ে কতা বয়ও তুমি, আপ্পো না” ” কখোনো বা বলত “তুমি আমাল মত ছুন্দল না কেন?জানো মাম্মা বয়ে আমি কুব্বব্বব ছুন্দল” মায়িয়াম মেয়ের কথা শুনে হাসত মনে মনে, ভাবতো কত্ত সুন্দর কথা বলে আমার মেয়ে, হয়তো আমার কাছে থাকলে আমার মতই হতো। কিন্তু আমি কি ইচ্ছা করে পরকে নিজের মেয়ে দিয়েছি? পরীর যখন দু মাস বয়স ভীষণ অসুখ করলো, ডাক্তার বলল অনেক টাকা লাগবে অনেক দিন চিকিৎসা করাতে হবে, কি অসুক তা তো মারিয়াম জানে না। তার বর একদিন এসে বলল
” মারিয়াম তোরে এক খানা কথা কতাম, ঠান্ডা মাথায় শুনবি”
“কি কন?”
” দ্যাখ আমি পরীর বাবা তোর অর জন্নি জত কষ্ট হয় আমারো হয়, মাইয়ে যদি আমাগে কাছে থাকে অরে আমরা বাচাতি পারবোনা, মল্লিক সাহেব আছে না ওই শহরে থাকে?উনি নিতি চাইছে, সব চিকিৎসার টাহা উনি ই দিবেন, মাইয়ে ডা ওনারে দিয়ে দিতি হবে”
সেদিন মারিয়াম দিতে রাজি হয়নি, ভুল ভুঝে স্বামীকে
“আপনে কি মানুষ না পাষাণ” বলে উঠে চলে গেছিল।
ভুল ভেঙে গেলো কয় দিনেই
পরীর আবারো অসুখ করল টাকা যোগাড় করতে না পেরে দিয়ে দিতে হল ২ মাসের পরীকে।
অনেক কেঁদেছিল সেদিন ও, বার বার স্বামীকে বলেছিল “আমার পরীকে এনে দ্যান নইলে আকটু বিষ দ্যান” আস্তে আস্তে ব্যাথাটা চাপা পরে যাচ্ছিলো….

আজ ২ বছর আছে এই মল্লিক নিবাসে। পরীর সাথে ভাল ভাব জমে গেসে, পরী মারিয়াম থেকে ছোট্ট করর মাম বলে ডাকে,, মামের সাথে খেলা করে মাম ঘুম পারিয়ে দেয়,, ২ বছরে কথা টাও একটু শহুরে করার চেষ্টা করেছে সে, পরী যে গ্রামের কথা পছন্দ করে না..
একদিন একটা চিঠি সব সুখের অবসান ঘটালো তার। গ্রাম থেকে আসা তার স্বামীর চিঠি,,
মিসেস মল্লিক চিঠিটা খুলে দেখলেন। “রহিমের চিঠি!” মাথা যেন ঘুরে গেল মিসেস মল্লিকের। তার মানে মারিয়াম রাহিমের স্ত্রী! না না এ হতে পারে না…. এই মেয়ে জেরিন শুধুই তার আর কারও না!
কেন কি কারন কিছু না বলে সেদিন এক্সট্রা ৬ মাসের বেতন ২ টা শাড়ি দিয়ে ওই দিন ই মারিয়াম কে বলে দিলেন আর কাজ করার দরকার নেই, এখন জেরিন বড় হয়েছে উনি নিজেই সব টা পারবেন। অনেক বলেছিল মারিয়াম “আফা আমার টাকা লাগব না আমারে কাজে রাহেন,,কাজে রাহেন” অনেক কেঁদেছিল। তিনি অনড় কথায়।
আসার সময় অনেক চেয়ে পরীর একটা জামা চেয়ে এনেছিল।পরীও অনেক কেঁদেছিল “মাম কে জেতে দিও না মাম্মা, আমায় রেখে যেও না মাম, তোমায় ছাড়া ঘুমাবোনা মাম যেও না” কিন্তু মাম যে নিরুপায়….



১০টা বছর পরীর জামা বুকে জড়িয়ে কাটাচ্ছে, এক দিন শহর থেকে বড় এক গাড়ি এসে থামল ওদের বাড়ীর সামনে। মল্লিক সাহেব!
মল্লিক সাহেব কি যেন ডেকে বলল মারিয়ামের স্বামীকে, বসল না আবার ওই গাড়িতেই চলে গেল।
ফ্যাকাশে মুখ করে রহিম বসল বারান্দায় মাটির উপরে
“ও পরীর বাপ কি অইচে কথা কও না ক্যান?আমার পরী কেমন আচে?”
“পরীর যে আবার অসুক করচে রে মারি”
“কন কি আপ্নে না না এইডা অইতে পারে না,কিচ্চু অইব না আমার পরীর কিচ্চুনা” কান্নায় গলা বুজে আসে
“ওর নাকি ২ ডা কিডনি না কি আছে তাই নষ্ট, বহুত টাকা করচ করচে, বহুত মানুষ এর কাছে গেসে কারো নাকি মেলে নাই, তুই একবার যাবি মারি?”
.
.
.
.
আজ ক্লিনিক থেকে ছারচে মারিয়াম কে, শরীর ডা মেলা দুর্বল। রাহিমের হাত ধরে বাসে উথতেছে..
“আমার পরী কেমন আছে পরীর বাপ?”
“ভালা”
“আমার পরী,,একটা বার দেহাবা ওরে? মন ডা কেমন করতাসে মনে হয় আর দেহা পামু না, ও পরীর বাপ দেহাবা কও না ক্যান?”
“তার সাথে দেহা হবে না অহন,গাড়িতে উঠ।”
.
.
.
.
আজ কাল চলাচল করতে বড় কষ্ট হয় মারিয়ামের ঘরের কাজ সব রাহিমই করে,,আগে নিজে খাইতে পারত অহন তাও পারে না। দুই টা কিডনি নাই তার আর কয় দিন থাকবে সে তাও ভরসা নাই।
“পরীর বাপ পরীরে একটা চিঠি দিছালা?শেষ দেহা ডা কি পামু না?”
“এই সব কথা কইস না তুই, মাইয়ারে হারাইছি অহন তুইও যাওয়ার পথে,উপর আলা আমারে কেন তুলে নেয় না, জড়িয়ে আসে গলাটা, হ চিঠি দিসি কাইল পরশু আসবে তোর পরী”
আবারো চোখটা বন্ধ করে নেয় মারিয়াম।।
“আম্মা আম্মা চোখ টা খুল আম্মা, আম্মা তোমার পরী আমি দেখনা আম্মা?একটা বার দেখ”

চোখ টা খুলে দেখল মারিয়াম চিনতে কষ্ট হচ্ছে, হা এই তো পরী। মল্লিক সাহেব ও আসছেন। হাত দিয়ে পরীর মুখ খানা একটু ছোঁয়ার চেষ্টা করল,নাহ শক্তি পাচ্ছে না।
“আম্মা তুমি যখন কাছে ছিলে তখন চিনতে পারিনাই,আজ যখন চিনছি তখন আমায় ফেলে যেও না আম্মা একটা বার কথা বল একটা বার পরী বলে সেই ছোট্ট বেলার মত জড়িয়ে ধরো” পরীর কান্নায় ভারী হয়ে উঠলো চারপাশ, মারিয়াম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো, আজ তার মরতেও কষ্ট নাই,তার পরী যে তাকে আম্মা ডেকেছে….

লেখক : এমবিবিএস(ঢাকা মেডিকেল কলেজ),
ইন্টার্ন চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।

খুলনা গেজেট/কেএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!