খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  ঢাকা শিশু হাসপাতালে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট
  রাজধানীর খিলগাঁওয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় যুবকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
  জাতীয় পতাকার নকশাকার, জাসদ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন
  বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কোন মামলা নেই : প্রধানমন্ত্রী
  জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ আটকে দিল যুক্তরাষ্ট্র

মানব জীবনের আদব-শিষ্টাচার (পর্ব : ২)

মাওলানা জুবায়ের হাসান

নিয়তের আদব

একজন মুসলমান নিয়তের মর্যাদা ও প্রভাবের প্রতি বিশ্বাস করে এবং আরও বিশ্বাস করে তার দ্বীনি ও জাগতিক জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের জন্য নিয়তের ব্যাপক গুরুত্বকে। কারণ, নিয়তের দ্বারাই সকল কাজ অস্তিত্ব লাভ করে এবং নিয়ত অনুযায়ীই তার রূপ-প্রকৃতি তৈরি হয়; ফলে সে অনুসারে তা শক্তিশালী হয়, দুর্বল হয়, শুদ্ধ হয় এবং নষ্ট হয়; আর মুসলিম ব্যক্তির প্রত্যেক কাজে নিয়তের প্রয়োজনীয়তা ও তা বিশুদ্ধকরণের আবশ্যকতার বিষয়টিকেও গুরুত্বারোপ করা উচিৎ। এ ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী আমল করা আমাদের কর্তব্য।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ

অর্থঃ আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে। -সূরা আল-বায়্যেনা, আয়াত: ০৫

হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন :
مَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا، كُتِبَتْ لَهُ حَسَنَةً
যে ব্যক্তি ভালোকাজের পরিকল্পনা করল, কিন্তু বাস্তবে সে কাজ করতে পারল না, সে ব্যক্তির জন্য সাওয়াব লেখা হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদিস নং- ২০৬

সুতরাং শুধু ভালোকাজের পরিকল্পনা করার দ্বারাই কাজটি ভালোকাজ হিসেবে গণ্য হয়ে যায়, প্রতিদান সাব্যস্ত হয়, সাওয়াব অর্জন হয়; আর এটা শুধু ভালো নিয়তের ফযীলতের কারণেই সম্ভব হয়।

রাসূলুল্লাহ ﷺ তাবুক যুদ্ধের সময় তাবুকে অবস্থানকালে বলেন: لَقَدْ تَرَكْتُمْ بِالْمَدِينَةِ أَقْوَامًا مَا سِرْتُمْ مَسِيرًا، وَلَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ نَفَقَةٍ، وَلَا قَطَعْتُمْ مِنْ وَادٍ، إِلَّا وَهُمْ مَعَكُمْ فِيهِ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَكَيْفَ يَكُونُونَ مَعَنَا، وَهُمْ بِالْمَدِينَةِ؟ فَقَالَ: حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ

অর্থঃ তোমরা মদীনাতে এমন সম্প্রদায়কে রেখে এসেছ, যারা কোনো দূরপথ ভ্রমণ করেনি, কোনো অর্থ-সম্পদ খরচ করেনি এবং কোনো উপত্যকাও অতিক্রম করেনি, তবুও তারা তোমাদের সাথে (সাওয়াবে) শরীক রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম রা. নিবেদন করলেন: তারা কিভাবে আমাদের সাথে সাওয়াবের অংশীদার হবে, অথচ তারা মদীনাতেই ছিল? তখন তিনি বললেন: ‘অপারগতা’ তাদেরকে আটকিয়ে রেখেছিল। (অর্থাৎ তারা ভালো নিয়তের মাধ্যেমে আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করেছে)। -সুনানে আবূ দাউদ, হাদিস নং- ২৫১০

সুতরাং ভালো নিয়তের কারণে আমল করতে না পারলেও আমলের সাওয়াবে অংশীদার হবে, গা’যী না হয়েও গা’যীর মত সাওয়াবে অংশীদার হবে, আর মুজাহিদ না হয়েও মুজাহিদের মত সাওয়াব পাবে।

অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
إِذَا التَقَى المُسْلِمَانِ بِسَيْفَيْهِمَا فَالقَاتِلُ وَالمَقْتُولُ فِي النَّارِ، فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ هَذَا القَاتِلُ فَمَا بَالُ المَقْتُولِ قَالَ: إِنَّهُ كَانَ حَرِيصًا عَلَى قَتْلِ صَاحِبِهِ

অর্থঃ যখন দু’জন মুসলিম তাদের তরবারি নিয়ে মুখোমুখি হবে, তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ে জাহান্নামে যাবে। প্রশ্ন করা হল: হে আল্লাহর রাসূল ﷺ ! এ হত্যাকারী (তো অপরাধী), কিন্তু নিহত ব্যক্তির কী অপরাধ? তখন তিনি বললেন: কারণ, সে তার সঙ্গীকে হত্যা করার ইচ্ছা (নিয়ত) করেছিল। -সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ৩১; সহীহ মুসলিম, হাদিস নং- ২৮৮৮

সুতরাং হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির মাঝে জাহান্নাম আবশ্যক হওয়ার বিষয়টিকে সমান করে দিল তাদের উভয়ের মন্দ নিয়ত ও খারাপ উদ্দেশ্য। তার নিয়ত যদি খারাপ না হত, তাহলে সে জান্নাতের অধিবাসী হত।

অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: যে ব্যক্তি এমন পরিমাণ মোহরের বিনিময়ে বিয়ে করেছে, যা তার পরিশোধ করার নিয়ত নেই, সে ব্যক্তি ব্যভিচারী; আর যে ব্যক্তি এমন ঋণ গ্রহণ করেছে, যা তার পরিশোধ করার ইচ্ছা নেই, সে ব্যক্তি চোর। (হাদীসটি ইমাম আহমাদ ও ইবনু মাজাহ রহ. বর্ণনা করেছেন এবং ইবনু মাজাহ রহ. ‘মোহর’-এর বিষয়টিকে বাদ দিয়ে শুধু ‘ঋণ’-এর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বর্ণনা করেছেন।)

সুতরাং মন্দ নিয়ত বৈধ জিনিসকে হারামে রূপান্তরিত করল এবং জায়েয বিষয়কে নিষিদ্ধ বস্তুতে পরিণত করল; আর যা সমস্যামুক্ত ছিল, তা সমস্যাযুক্ত হয়ে গেল। এ সব কিছুই মুসলিম ব্যক্তি যে নিয়তের মর্যাদা ও প্রভাব এবং তার ব্যপক গুরুত্বের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও নিবিড় আস্থা পোষণ করে, সে বিষয়টিকে আরও মজবুত করে; ফলে সে বিশুদ্ধ নিয়তের উপর তার সকল কর্মকাণ্ডের ভিত রচনা করে; ঠিক অনুরূপভাবে সে সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা করে যাতে তার একটি কাজও নিয়ত ছাড়া বা বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া সংঘটিত না হয়; কারণ, নিয়ত হলো কর্মের প্রাণ ও ভিত্তি; সুতরাং নিয়ত সঠিক তো কাজও সঠিক, আর নিয়ত শুদ্ধ নয় তো কাজও শুদ্ধ নয়; আর কর্তার বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কাজ হল মোনাফেকী, কৃত্রিমতা, নিন্দিত ও ঘৃণিত।

অনুরূপ মুসলিম ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, আমলসমূহ বিশুদ্ধ হওয়ার অন্যতম রুকন ও শর্ত হলো নিয়ত; তারপর সে মনে করে যে, নিয়ত শুধু মুখে (হে আল্লাহ! আমি এরূপ নিয়ত করেছি) উচ্চারণ করার নাম নয়, আবার নিয়ত বলতে শুধু মনের ভাবকেই বুঝায় না, বরং নিয়ত হলো সঠিক উদ্দেশ্যে, উপকার হাসিল বা ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথাযথ কাজের প্রতি মনের ঝোঁক বা জাগরণ এবং আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অথবা তাঁর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে কাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়া।

তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, ভালো নিয়তের কারণে বৈধ কাজ প্রতিদান ও সাওয়াবের উপযুক্ত আনুগত্যে পরিণত হয় এবং বিশুদ্ধ নিয়তের অভাবে সাওয়াবের কাজও গুনাহ্ ও শাস্তির উপযুক্ত অন্যায় ও অবাধ্যতায় পরিণত হয়। উপরোক্ত দলীল গ্রহণ করে এমনটি মনে করা যাবে না যে, অন্যায় ও অবাধ্যতার ক্ষেত্রেও ভালো নিয়তের ফলে তা সাওয়াবের কাজে পরিণত হয়ে যায়।

মানব জীবনের আদব-শিষ্টাচার (পর্ব : ০১) পড়তে এখানে ক্লিক করুণ

যেমনঃ কেউ কোনো ব্যক্তির গিবত করবে অপর কোনো ব্যক্তির মন ভালো করার জন্য, তিনি এক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবেন, তার তথাকথিত ভালো নিয়ত এখানে তার কোনো উপকারে আসবে না; অনুরূপ যে ব্যক্তি হারাম অর্থ দ্বারা মসজিদ নির্মাণ করবে, তাকে এ কাজের জন্য সাওয়াব দেয়া হবে না; অনুরূপ যে ব্যক্তি নাচ-গান ও রঙ্গ-তামাশার অনুষ্ঠানে হাজির হয় কোনো নেক কাজে উৎসাহ পাওয়ার জন্য অথবা লটারীর টিকেট ক্রয় করে কল্যাণমূলক কাজে উৎসাহিত করার নিয়তে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবে এবং সাওয়াব পাওয়ার পরিবর্তে গুনাহগার হবে; আর যে ব্যক্তি সৎ ব্যক্তিগণের প্রতি ভালোবাসার নিয়তে তাদের কবরের উপর গম্বুজ তৈরি করবে অথবা তাদের উদ্দেশ্যে পশু যবাই করবে অথবা তাদের জন্য মানত করবে, সে ব্যক্তিও তার এ কাজের জন্য আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবে, যদিও তার ধারণা মতে তার নিয়তটি ভালো হয়ে থাকে; এর কারণ হল, শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত বৈধ কাজের ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো কাজই সৎ নিয়তের কারণে সাওয়াবের কাজ বলে গণ্য হয় না; আর হারাম কাজ তো কোনো অবস্থাতেই সাওয়াবের কাজে রূপান্তরিত হয় না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। বিশুদ্ধ নিয়ত অনুযায়ী সকল আমল বাস্তবায়নের তাওফিক দান করুন। (চলবে ইনশাআল্লাহ)
(লেখক : ইমাম ও খতিব, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)

খুলনা গেজেট/ টি আই

 




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!