ভৈরব সেতুর তৃতীয় পিয়ারের পাইল ক্যাপ ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে আজ বুধবার। তবে ভূমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার কারণে খুলনাবাসীর বহু প্রত্যাশিত এ সেতুর নির্মাণ কাজ থমকে যাচ্ছে।
আজ বুধবার (২০ এপ্রিল ) বেলা ১টায় সেতুর রেলিগেট অংশ ভৈরব নদীর তীর সংলগ্ন সরাকারি খাস জমির উপর ১৩ নং পিয়ারের পাইল ক্যাপ কাষ্টিং এর কাজ শুরু হয়, যা চলমান থাকে একটানা রাত ৮টা পর্যন্ত । পিয়ারটির জন্য ১১৫ ফুট পাইলিং করা হয়। ভূমি থেকে এর উচ্চতা হবে সাড়ে ৬৭ ফুট। আর এই পাইল ক্যাপ ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় আগামীকাল থেকে সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ থমকে যাচ্ছে বলে খুলনা গেজেটের কাছে হতাশা ব্যক্ত করেছেন সেতুর প্রজেক্ট ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার এস এম নাজমুল। তিনি বলেন, কাজের ক্ষেত্র না থাকলেও প্রকল্পের ৫৪ কর্মকর্তা- কর্মচারীকে বসিয়ে প্রতিমাসে ১৫ লক্ষ টাকা বেতন দিতে হবে। বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, ইন্টারনেট বিলসহ অন্যান্য বিল বাবদ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে। সেতু নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য অনেক ইকুইপমেন্ট ভাড়া করে আনা হয়েছে। সেগুলোর জন্যও প্রতিমাসে লক্ষ লক্ষ টাকা গুনতে হবে।
গত ৩০ মার্চ সেতুর দিঘলিয়া অংশে প্রথম ২৪ নং এবং ১০ এপ্রিল দ্বিতীয় ২৫ নং পিয়ারের সরাকারি খাস জমির উপর পাইল ক্যাপ ঢালাইয়ের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়াহিদ কন্সট্রাকশন লিঃ( করিম গ্রুপ)।
আজ তৃতীয় এবং ১৩ নং পিয়ারের পাইল ক্যাপ ঢালাইয়ের সময় উপস্থিত ছিলেন ভৈরব সেতুর তদারকি (কনসালটেন্ট) ফার্মের টীম লিডার ইঞ্জিনিয়ার রইস উদ্দিন মীর্জা, ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার কমলেন্দু মজুমদার, আবাসিক প্রকৌশলী বেনজীর আহমেদ, ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ার ওসমান গনি, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার আঃ আজিজ ও সাদিকুর রহমান, সার্ভেয়ার ইউসুফ হাওলাদার ও মেহেদী হাসান, সওজ এর সাব এসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মোঃ হাবিবুর রহমান, সেতুর প্রজেক্ট ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার এস এম নাজমুল, ইঞ্জিনিয়ার মোঃ নূরুজ্জামান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সার্ভেয়ার মোঃ শহিদুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুর রহমান, হেদায়েতুল্লাহ প্রমুখ।
ভৈরব সেতুর নির্মাণ কাজের সর্বশেষ অগ্রগতি বলতে সেতুর দিঘলিয়া অংশে ২৪ নং এবং ২৫ নং পিয়ারের পাইল ক্যাপ কাষ্টিং এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া সেতুর পশ্চিম পার্শ্বে ভৈরব নদীর তীর সংলগ্ন ১৩ নং পিয়ারের পাইল ক্যাপ ঢালাইয়ের কাজ আজ সম্পন্ন হলো। একই স্থানে নদীর তীরবর্তী ১৪ নং পিয়ারের শীট পাইলিং ড্রাইভের কাজ এবং কেজিং এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ।
২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভৈরব সেতু নামে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। এরপর ২০২০ সালের ২৭ জুলাই খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ সওজ এর খুলনা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ভৈরব নদীর উপর সেতু নির্মাণ কাজের দরপত্র আহবান করেন। প্রক্রিয়া শেষে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিঃ (করিম গ্রুপ) নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ভৈরব সেতুর নির্মাণকাজ দেওয়ার বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর ১৩ দিন পর ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর উক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
ভৈরব সেতুর জন্য দিঘলিয়া, মহেশ্বরপাশা এবং দেবনগর মৌজার মোট ১৭ দশমিক ৪৯ একর (৭ দশমিক ০৮ হেক্টর) ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন। এরমধ্যে সেতুর খুলনা শহরাংশ অর্থাৎ নগরীর কুলি বাগান থেকে ভৈরব সেতুর জন্য দিঘলিয়া, মহেশ্বরপাশা এবং দেবনগর মৌজার মোট ১৭ দশমিক ৪৯ একর (৭ দশমিক ০৮ হেক্টর) ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন।
এরমধ্যে সেতুর খুলনা শহরাংশ অর্থাৎ নগরীর কুলি বাগান থেকে রেলিগেট পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭ দশমিক ১১৩৬ একর (২ দশমিক ৮৮ হেক্টর) ভূমি রয়েছে। সেতুর উভয় পাশের উক্ত জমি অধিগ্রহণের জন্য খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এর কার্যালয় থেকে গত বছরের নভেম্বর মাসে ভূমি অধিগ্রহণের এর কাজ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করার জন্য ২টি সংশোধিত প্রস্তাবনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়।
গত ৬ মার্চ খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে ভূমি অধিগ্রহণের সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে ভূমি মালিকদের ধারা ৪ এর (১)উপ ধারা মোতাবেক আনুষ্ঠানিকভাবে নোটিশ প্রদান করা হয়। এদিন সেতুর দিঘলিয়া অংশ নগর ঘাট ফেরি ঘাট থেকে উপজেলা-সদর সংলগ্ন কুকুর মারা পর্যন্ত প্রায় ৪’শ জমির মালিকদের নোটিশ প্রদান করা হয়। বর্তমানে যৌথ ফিল্ডবুক এর এর কাজ চলছে ধীরগতিতে। গত দেড় মাসে দিঘলিয়া অংশে মাত্র ১ হাজার মিটার যৌথ ফিল্ডবুক তৈরীর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কবে নাগাদ ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হবে এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল এ)’র মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর সংগে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
সওজ সূত্রে জানা যায়, ভৈরব সেতুর পিয়ার বসবে মোট ৩০ টি। এরমধ্যে নদীর পশ্চিম পার্শ্বে অর্থাৎ নগরীর কুলিবাগান থেকে রেলিগেট ফেরিঘাট সংলগ্ন নদীর তীর পর্যন্ত ১ থেকে ১৪ নং পিয়ার বসবে। এই অংশের প্রথম পিয়ারটি বসবে নগরীর কুলিবাগান আকাঙ্খা পাট গোডাউনের কর্ণারে। ৫ এবং ৬ নং পিয়ারের মাঝখান দিয়ে রেললাইন ক্রস করবে। এরপর ৭ এবং ৮ নং পিয়ার বসবে। ৯ থেকে ১৩ নং এই ৫ টি পিয়ার বসবে নগরীর রেলিগেট ঢাকা ট্রেডিং হাউজ লিঃ এর অভ্যন্তরে। এর ফলে রপ্তানিকারক এ প্রতিষ্ঠানটি ভাঙ্গা পড়বে।
১৭ থেকে ২৮ নং পিয়ার বসবে ভৈরব নদীর পূর্বপাশ অর্থাৎ দিঘলিয়া উপজেলার নগরঘাট বানিয়াঘাট ফেরী সংলগ্ন মধ্যবর্তী স্থান থেকে উপজেলা সদরের কুকুরমারা পর্যন্ত। পশ্চিম পাশে নদীর পাড় থেকে ৪২ মিটার ভেতরে ১৫ নং পিয়ার এবং পূর্ব পাশে নদীর পাড় থেকে ১৮ মিটার ভেতরে ১৬ নং পিয়ার বসবে। এছাড়া সেতুর উভয় দিকে সেখান থেকে সেতুর স্লোপ শুরু হবে সেখানে A-1 এবং A-2 দুটি এবাটমেন্ট বসবে। নদীর ভেতর কোন পিলার বসবে না। ১৫ এবং ১৬ নং পিলারের উপর ১০০ মিটার স্টিল বসবে। নেভিগেশনের জন্য যাতে সেতুর নীচ দিয়ে অনায়াসে কার্গো এবং জাহাজ চলাচল করতে পারে সেজন্য মূল ব্রিজের স্নাব বটম জোয়ারের পানি থেকে ৬০ ফুট উঁচু হবে।
ভৈরব সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৩১৬ কিলোমিটার। সেতু নির্মাণ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এরমধ্যে মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৩ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮১ কোটি টাকা। বাকী টাকা সেতু সংক্রান্ত অন্যান্য কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে।